বাংলাদেশ ৬৪টি জেলাতে বিভক্ত। বেশিরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনই ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। সেইরকমই একটি জেলা হল লালমনিরহাট জেলা (Lalmonirhat)।
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত রংপুর বিভাগের একটি অংশ হল লালমনিরহাট জেলা । বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে লালমনিরহাট জেলায়। ৩৩টি ছিটমহল এই জেলার মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এই জেলাটিকে ছিটমহলের জেলাও বলা হয়ে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে লালমনিরহাট শহর রেলওয়ে জংশন হিসেবে সুপরিচিত। সিদল ভর্তা এই জেলার অন্যতম বিখ্যাত একটি খাবার।
এই জেলার উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ (কোচবিহার, জলপাইগুড়ি), দক্ষিণে রংপুর জেলা, পূর্বে কুড়িগ্রাম জেলা ও কোচবিহার এবং পশ্চিমে রংপুর ও নীলফামারী জেলা অবস্থিত। লালমনিরহাট জেলার মধ্যে দিয়ে সাতটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এখানকার প্রধান নদী তিস্তা। এছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি হল: ধরলা, সানিয়াজান, সারনামতী, ত্রিমোহিনী, রত্নাই ও সতী। এই জেলাটির আয়তন ১২৪১.৪৬ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের বাংলাদেশের আদমশুমারি অনুসারে লালমনিরহাট জেলার জনসংখ্যা ছিল ১৪,২৮,৪০৬ যার মধ্যে ৭,১৪,২০৩ জন পুরুষ এবং ৭,১৩,৫৬৬ জন মহিলা। নানা ধর্মের মানুষ লালমনিরহাট জেলায় বাস করলেও এখানে ইসলাম ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেশি।
লালমনিরহাট জেলার নামকরণ নিয়ে সাধারণত বেশ কয়েকটি জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। একটি মতানুযায়ী, উনিশ শতকের শেষের দিকে বেঙ্গল দুরাস রেলওয়ের (বিডিআর) শ্রমিকরা রেললাইন স্থাপনের জন্য মাটি খনন করার সময় একটি লাল রঙের পাথর খুঁজে পান এবং তখন থেকেই জায়গাটি লালমনি নামে পরিচিতি পায়। অন্য একটি মত অনুযায়ী লালমনি নামের এক মহিলার মালিকানাধীন জমিতে রেল কোম্পনি রেললাইন পেতেছিল। সেই মহিলার জমিদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁর নামে জায়গাটির নাম রাখা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। অন্য মতে ১৭৮৩ সালে লালমনি নামের এক নারী কৃষক নেতা নুরুলদীনের সাথে সাধারণ কৃষকদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইংরেজ সৈন্য ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে স্থানটির নামকরণ করা হয় লালমনি। পরে সময়ের সাথে সাথে এই নামের সঙ্গে হাট কথাটি জুড়ে যায়।
লালমনিরহাট জেলার মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস খোদিত আছে। পাক সেনারা রেলওয়ের বহু বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হত্যা করে। ৩০ নভেম্বর পাকসেনারা এই জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা ছেড়ে কালীগঞ্জ উপজেলায় আশ্রয় নেয়। ৪ ও ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকসেনারা লালমনিরহাট জেলা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। লালমনিরহাট মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর।
১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে লালমনিরহাট একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বাংলা ভাষাই এই জেলার সরকারী ভাষা। তবে এখানে রংপুরিয়া উপভাষার প্রচলন রয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা যে ৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত, সেগুলি হলো পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদর। ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ লালমনিরহাট সদর থানা উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষিই লালমনিরহাট জেলার আয়ের প্রধান উৎস। এই জেলায় মূলত ধান, তামাক, আখ, গম, ভুট্টা, আলু, বাদাম, সরিষা, টমেটো, পেঁয়াজ, মরিচ, মুলো, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ হয়ে থাকে।
লালমনিরহাট জেলার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণস্থানের তালিকা অপূর্ণই থেকে যাবে যদি তালিকার শুরুতেই নিদারিয়া মসজিদের উল্লেখ না থাকে৷ এটি ছাড়াও আরও বিখ্যাত কয়েকটি ভ্রমণস্থলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সিন্ধুমতি দীঘি, হোসেন সরোবর (শুকনো পুকুর), মোগলহাটের ধরলা ব্রিজ, তুষারবন্দর জমিদার বাড়ি, ইজারাদার মসজিদ, কাকিনা রাজবাড়ী, কবি বাড়ি (কবি শেখ ফজলুল করিমের বাড়ি ও সংগ্রহ), হযরত শাহ সুফি মুহাম্মদ ফজলুর রহমান (অন্ধ হাফেজ নামে পরিচিত) এর সমাধি ইত্যাদি।
এই জেলার কৃতী মানুষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: আবিদ আলী (রাজনীতিবিদ), শেখ ফজলল করিম (সাহিত্যিক), মুসা ইব্রাহিম (বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট জয়ী), সাথিরা জাকির (ক্রিকেটার), চিত্তরঞ্জন দেব (সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য), জয়নুল আবেদিন সরকার (প্রাক্তন সংসদ সদস্য), শাফিয়া খাতুন (ভাষা সৈনিক ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য) প্রমুখ।
এই জেলায় লোকসংস্কৃতির যে ধারাগুলি আজও বিদ্যমান সেগুলির মধ্যে রয়েছে ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, মেয়েলিগীত (নারীদের গাওয়া গান), মন্ত্র, লোকগীতি, পল্লীগীতি, বাউল গান ইত্যাদি।
লালমনিরহাট জেলার অন্যতম বিখ্যাত একটি খাবার হল সিদল ভর্তা।
One comment