শরৎচন্দ্র বসু (Sarat Chandra Bose) একজন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। শরৎচন্দ্র বসুর অন্যতম পরিচয় একটি পরিচয় হল তিনি সম্পর্কে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা।
১৮৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর উড়িষ্যার কটক শহরে শরৎচন্দ্র বসুর জন্ম হয়। বাবার নাম জানকীনাথ বসু এবং মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। প্রভাবতী দেবী এবং জানকীনাথ বসুর ১৪ টি সন্তানের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সুনীল চন্দ্র বসু।
শরৎ চন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেন। এরপর শরৎচন্দ্র আইনে ডিগ্রি নিয়ে কিছুকাল ওকালতি করেন। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে যান ব্যারিস্টারি পড়তে এবং ১৯১১ সালে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন। ১৯১৮ সালে ভারতে ফেরার পর তিনি অত্যন্ত সফলভাবে ওকালতি করতে থাকেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য দলের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৬-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার তিনি কারাবরণ করেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় মহাসভার কার্যকরী সমিতির সদস্য, বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতি, বঙ্গীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা, কেন্দ্রীয় আইন সভার বিরোধী দলীয় নেতা এবং স্বাধীন ভারতে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ফজলুল হক সরকারের ক্যাবিনেট মিনিস্টার হিসেবে যোগদান করার আগের দিন তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রথমে মারকারা জেলে এবং পরে কুনুর জেলে পাঠানো হয়। এখানে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অবশেষে সাড়ে চার বছর জেলে বন্দী থাকার পর ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভায় কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন । তিনি নেতাজি কর্তৃক ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (Indian National army or INA) গঠনের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন এবং ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৪৬ সালে, তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘কাজ, খনি ও শক্তি’ সম্পর্কিত মন্ত্রকের সদস্য নিযুক্ত হন । জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে জাতীয় কার্যনির্বাহী পরিষদে মন্ত্রীর পদ এবং ভারতের ভাইসরয়ের পদ অলংকৃত করেন।
তিনি ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুযায়ী হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ করার বিষয়ে মতভেদের কারণে এআইসিসি থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বাঙালি মুসলিম লীগ নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের সাথে একত্রিত হয়ে অখণ্ড এ বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। মহাত্মা গান্ধী শুরুতে এই প্রস্তাব সমর্থন করলেও পরবর্তীকালে তাঁর মত থেকে সরে এসেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে, তিনি তাঁর ভাইয়ের গঠিত ফরোয়ার্ড ব্লক দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। ‘স্যোসালিস্ট রিপাবলিকান পার্টির’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
১৯০৯ সালে শরৎচন্দ্র বসু অক্ষয় কুমার দে এবং সুবলা দে-এর কন্যা বিভাবতীদেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের আটটি সন্তান হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অশোক নাথ বসু,অমিয় নাথ বসু, শিশির কুমার বসু, সুব্রত বসু। অশোক নাথ বসু জার্মানি থেকে রসায়ন শাস্ত্রে ডক্টরেট এবং একজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার। অমিয় নাথ বসু, ভারত ছড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, পরে সংসদ সদস্য হন এবং বার্মায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। শিশির কুমার বসু, শিশু চিকিৎসক এবং বিধানসভার সদস্য ছিলেন।সুব্রত বসু ছিলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং সংসদ সদস্য। তাঁদের কনিষ্ঠ কন্যা প্রফেসর চিত্রা ঘোষ ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, একজন সমাজ বিজ্ঞানী, এবং সংসদ সদস্য।
১৯৫০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শরৎচন্দ্র বসু প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
কলকাতা হাইকোর্টের পাশে শরৎচন্দ্র বসুর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ লিওনার্ড এ গর্ডন গর্ডন শরৎচন্দ্র বসু এবং তাঁর ছোট ভাই সুভাষ চন্দ্র বসুর যৌথ জীবনী লিখেছেন, বইটির নাম-‘ব্রাদার্স অ্যাগেইনস্ট দ্য রাজ’ (Brothers Against The Raj)।
2 comments