তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (Tarasankar Bandyopadhyay) ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর পর্বের একজন যথার্থ শিল্পী। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তিনি বাংলা সাহিত্যের জগতে পদচারণা করেছেন। ছোটোগল্প থেকে উপন্যাস এবং নাটকে চলমান জীবনকে রূপ দিয়েছেন তিনি।
১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই বীরভূমের লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়৷ তাঁর বাবার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তাঁর বাবার বাগানের শখ ছিল অন্যদিকে প্রভাবতী দেবী ছিলেন আধুনিক রুচিসম্পন্না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র গঠনে তাঁর মা প্রভাবতী দেবীর প্রভাব ছিল যথেষ্ট। তারাশঙ্করের বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পিসিমা চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর জমিদার হয়ে উঠুক। কিন্তু তাঁর মা সর্বদাই চাইতেন জমিদারির বাইরের বহির্বিশ্বে তারাশঙ্করের বিচরন হোক৷
প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তারাশঙ্কর লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী তারাশঙ্কর প্রথমবার পাশ করতে পারেননি৷ ১৯১৬ সালে দ্বিতীয়বার এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা) পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৷ প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের পরে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য তিনি বহরমপুর যান কিন্তু সেখানেও কোনও কলেজে তাঁর স্থান হয়নি। তাই তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারেননি কারণ এই সময় তিনি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হলেও পরে মুক্তি পেয়ে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি আবার কলেজে ভর্তি হন৷ এইবার সাউথ সুবারবন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, যার বর্তমানে নাম আশুতোষ কলেজ । কিন্তু এবারও ম্যালেরিয়ার প্রকোপে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর পড়া হল না। তিনি আবার লাভপুরে ফিরে আসেন৷
তারাশঙ্কর জীবনের শুরুর দিকে জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে তিনি গ্রেপ্তারও হন। জেল থেকে বেরিয়ে এরপর তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলেন এবং আত্মনিয়োগ করলেন ছোট গল্প, উপন্যাস এবং নাটক রচনায়।
তারাশঙ্কর শুরুর দিকে কালিকলম,বঙ্গশ্রী,শনিবারের চিঠি,প্রবাসী,পরিচয় ইত্যাদি পত্রিকায় গল্প লিখে পাঠকদের কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তারাশঙ্করের উপন্যাসের পটভূমি অনেক ব্যাপক, বিস্তীর্ণ। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা ষাটটি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালি ঘূর্ণি’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে এবং শেষ উপন্যাস ‘নবদিগন্ত’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। তাঁর উপন্যাসগুলি কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। উপন্যাসের প্রথম পর্বে দেখা যায় রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তির ব্যাকুলতা। দ্বিতীয় পর্বের উপন্যাস গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম ইত্যাদি। তৃতীয় পর্বে তারাশঙ্কর লিখেছেন হাঁসুলী বাঁকের উপকথা যেটি আঞ্চলিক উপন্যাসের সার্থক নিদর্শন। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গুলি হল নাগিনী কন্যার কাহিনী, আরোগ্য নিকেতন, বিচারক, সপ্তপদী ইত্যাদি। চতুর্থ পর্বের উপন্যাস গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাশ্বেতা , যোগভ্রষ্ট, নিশিপদ্ম ইত্যাদি। উপন্যাসের শেষ পর্বে তারাশঙ্কর প্রচলিত রীতি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করা হয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মানব চরিত্র এবং প্রকৃতি তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। তারাশঙ্করের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ তাঁর উপন্যাসে আঞ্চলিকতার প্রভাব। রাঢ় অঞ্চলের বিচিত্র পরিবেশে তারাশঙ্করের বাল্য এবং কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছিল যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই তাঁর উপন্যাসে। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে সামগ্রিক ভাবে ঘিরে রয়েছে কোপাই নদ এবং তার চারপাশের কাহারপাড়া মানুষের বহু যুগ ধরে বয়ে আনা সংস্কার। লোককল্পনা, কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এই উপন্যাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। পুরাতনের চলে যাওয়া এবং নবীনের আগমন এই উপন্যাসের পটভূমিকে করে সুদৃঢ় করে তুলেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষকে ভয় হীনতা দীনতা মুক্তির কথা বলেছেন।
‘রসকলি’ ছোটোগল্প দিয়েই তারাশঙ্করের সাহিত্যজীবন শুরু ৷ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকায়৷ তাঁর রচিত গল্পের বইয়ের সংখ্যা ৩৫, গল্পের সংখ্যা ১৯০। য়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছলনাময়ী (১৯৩৬), জলসাঘর (১৯৩৭), রসকলি (১৯৩৮), বেদেনী (১৯৪৩), জাদুকরী (১৯৪৪), দিল্লিকা লাড্ডু (১৯৪৩), হারানো সুর (১৯৪৫), ইমারত (১৯৪৭), অ্যাক্সিডেন্ট, কালান্তর, দীপার প্রেম, এক পশলা বৃষ্টি ইত্যাদি। তারাশঙ্করের প্রথমদিককার গল্পে রয়েছে বৈষ্ণব ভাবনা। যেমন, রসকলি, রাইকমল, মালাচন্দন, এইসব গল্পগুলিতে বীরভূমের গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থ বৈষ্ণব সমাজের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। রসকলি তাঁর প্রথম গল্প হলেও সন্ধ্যামণি গল্প থেকে তারাশঙ্করের সমৃদ্ধি সূচনা ঘটেছে। গ্রামীণ জীবনের জমিদারদের দম্ভ ও গর্ব নিয়ে রচিত হয়েছে জলসাঘর, ও রাইবাড়ি। তারাশঙ্কর বীরভূমের গ্রামীণ সমাজের জমিদার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় এবং নিচু শ্রেণীর মানুষদের চিত্র এঁকেছেন। “আমার সাহিত্য জীবন” ( দ্বিতীয় খন্ড) গ্রন্থে লেখক বলেছেন, ”জমিদার শ্রেণী ছাড়াও বেদে, পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার,ডাকহরকরা প্রভৃতি যারা সমাজের বিশেষ অংশ জুড়ে ছিল তাদের নিয়ে গল্প রচনা প্রেরণায় হোক বা অভিপ্রায় হোক আমার মধ্যে এসেছিল বোধকরি এদের কথা অন্য কেউ বিশেষ করে আগে লেখেননি বা লেখেন না বলে।”
১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিতে ‘শেষকথা’ গল্পটি রচিত হয়েছে। রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় নাট্যকার হিসেবেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। যদিও কথা সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর প্রতিভা যতটা পরিলক্ষিত হয় নাটকে ততটা প্রকাশ পায়নি। তাঁর লেখা প্রথম নাটক ‘দুই পুরুষ’ (১৯৪২) প্রাচীনপন্থী জমিদার পিতা ও আধুনিকতা সম্পন্ন ছেলের বিরোধকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে নাটকটি। তাঁর ‘কালিন্দী ‘ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি নিজেই৷ তাঁর ‘পথের ডাক’ নাটকে আধুনিক কালের আর্থ সামাজিক সমস্যা চিত্রিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য নাটকগুলি হল বিংশ শতাব্দী (১৯৪৫), দ্বীপান্তর (১৯৪৫), যুগবিপ্লব (১৯৫১), কবি (১৯৫৭), কালরাত্রি (১৯৫৭), সংঘাত (১৯৬২)।
তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন যেমন, সাহিত্যের সত্য (১৯৬১), ভারতবর্ষ ও চীন (১৯৬৩), রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী (১৯৭১)। স্মৃতিকথা: আমার কালের কথা (১৯৫১), বিচিত্র স্মৃতিকাহিনী (১৯৫৩), আমার সাহিত্য জীবন, প্রথম খণ্ড (১৯৫৩), কৈশোর স্মৃতি (১৯৫৬), আমার সাহিত্য জীবন, দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬২)।তারাশঙ্করে বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়।
আজীবন সাহিত্যকীর্তির জন্য তিনি বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন৷ ১৯৫৫ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তাঁর উপন্যাস ‘আরোগ্য নিকেতন’ এর জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ লাভ করেন৷ ১৯৫৬ সালে তিনি ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ পান। ১৯৬৬ সালে তিনি ‘ গণদেবতা’ উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন৷ ১৯৬২ সালে তারাশঙ্কর ভারত সরকারের পদ্মশ্রী ও ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়৷
তথ্যসূত্র
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য (পৃঃ ৪৭৯)
- https://en.m.wikipedia.org/
- http://en.banglapedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.bongodorshon.com/
- https://www.parabaas.com/
3 comments