পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে বিভিন্ন জঙ্গল বা অরণ্য। অরণ্যপ্রেমী পর্যটকেরা সবুজ বনভূমির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেইসব স্থানে ভিড় জমান। এইসব অরণ্যের কয়েকটিকে আবার সুশৃঙ্খলভাবে সুরক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে, এবং সেখানে বন্যপ্রাণীদের যথাযথভাবে পালন করা হয়। এই ধরনের অরণ্যকেই বলা হয়ে থাকে অভয়ারণ্য। পর্যটকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় এমনই একটি অভয়ারণ্য হল বল্লভপুর অভয়ারণ্য। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ঘন জঙ্গল এবং এখানে যত্নে লালিত হরিণের দল পর্যটকদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। পায়ে হেঁটে এই নিবিড় বনভূমির পথে চলাফেরা করলে রোমহর্ষক এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায়। নিস্তব্ধ অরণ্যভূমির প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করবার জন্য এই বল্লভপুর অভয়ারণ্য সুন্দর একটি স্থান।
বীরভূম জেলার বোলপুর সাবডিভিশনের অন্তর্গত শান্তিনিকেতনে শ্যামবাটির কাছে বল্লভপুর অভয়ারণ্য অবস্থিত। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বল্লভপুর অভয়ারণ্য দেড় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এবং বোলপুর স্টেশন থেকে এই অভয়ারণ্যটির দূরত্ব মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটার।
বল্লভপুরে অবস্থিত বলে এই অভয়ারণ্যের নামকরণ করা হয়েছে বল্লভপুর অভয়ারণ্য। ১৯৫৭ সালে প্রথম এই অঞ্চলটিকে রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং কুড়ি বছর পর ১৯৭৭ সালে দুই বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই অভয়ারণ্যটি গঠিত হয়েছিল। এখানে শালবন তো ছিলই, তাছাড়াও ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সালে আকাশমণি, শিশু, কাজুবাদাম ইত্যাদি আরও নানারকম গাছ রোপণ করা হয়েছিল। বক্সা জঙ্গলের বাঘেদের খাদ্যের জন্য এখানে চল্লিশ হেক্টর জমি জুড়ে হরিণ প্রতিপালন করা হয়ে থাকে। পূর্বে নেকড়ে, শিয়াল, হনুমান, গন্ধগোকুল, ভারতীয় সজারু ইত্যাদি নানারকম প্রাণীর দেখা মিললেও বর্তমানে হরিণ ছাড়া তেমন কোনও প্রাণীর দেখা মেলে না। বিশেষভাবে চিতল হরিণ প্রতিপালন করা হয় বলেই এর আরেক নাম ডিয়ার পার্ক। স্থানীয় মানুষদের কাছেও ডিয়ার পার্ক নামটিই বেশি পরিচিত।
ট্রেনে করে বল্লভপুর অভয়ারণ্য যেতে হলে হাওড়া, শিয়ালদহ বা বর্ধমান স্টেশন থেকে বোলপুরগামী অনেক ট্রেন পাওয়া যাবে। বোলপুর স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করে এই অভয়ারণ্যে যাওয়া যাবে। এছাড়াও ধর্মতলা বা বর্ধমান থেকে সরাসরি বোলপুরের বাসও পাওয়া যায়। বাসে করে বোলপুর নেমে সেখান থেকে টোটো ধরে বল্লভপুর অভয়ারণ্য যাওয়া যায়। গাড়িতে যেতে চাইলে কলকাতা থেকে ১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে সেকামপুর-সাহাপুর রোড ধরে চলে যাওয়া যাবে এখানে। কলকাতা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার এবং গাড়িতে যেতে সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টার কিছু বেশি। অপরদিকে বর্ধমান থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার এবং গাড়িতে যেতে সময় লাগবে দেড় ঘণ্টার মত।
সাধারণত শান্তিনিকেতনে ঘুরতে গিয়ে পর্যটকেরা সাইটসিইং হিসেবে বল্লভপুর অভয়ারণ্য ঘুরতে যায়। সেক্ষেত্রে তারা শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন হোটেলে থাকতে পারেন। বল্লভপুর অভয়ারণ্যের কাছে শ্যামবাটি অঞ্চলে কিংবা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ধারেকাছে নানারকম ভাড়ার অসংখ্য হোটেল পাওয়া যাবে। এছাড়াও স্থানীয় পড়ুয়াদের কাছে জায়গাটি খুবই জনপ্রিয়। তাদের ক্ষেত্রে থাকার ব্যাপার নেই। দিনের দিন গিয়ে ঘুরে আসা যায়।
অরণ্যপ্রেমী মানুষদের জন্য এই বল্লভপুর অভয়ারণ্য একটি সুন্দর দর্শনীয় স্থান। সবুজ অরণ্য, বোলপুরের লাল মাটি, পাখির কুজন এবং অপার নির্জনতা পর্যটকদের এক নৈসর্গিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেবে। প্রায় ৭০০ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত রোমাঞ্চ তৈরি হতে পারে মনে। এখানে জঙ্গলে মূলত চিতল হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। একটু অপেক্ষা করলেই দলে দলে হরিণদের আনাগোনা দেখা যাবে। যেহেতু বিস্তীর্ণ এলাকা জু্ড়ে অসংখ্য হরিণ ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তাই বাচ্চা থেকে বড়ো সকলেরই খুব উপভোগ্য হবে জায়গাটা। অনেকসময় জালের যে ঘেরাটোপ থাকে, তার অনেক কাছাকাছিও চলে আসে হরিণের দল, ফলে তাদের আরও ভালো করে দেখবার সুযোগ মেলে। তবে এই বেড়া পেরিয়ে ভেতরে ঢুকবেন না বা আনন্দে চেঁচামেচি করে জঙ্গলের পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
পথে ছোট একটি ওয়াচ টাওয়ার চোখে পড়বে। এই ওয়াচটাওয়ারের ওপরে উঠে সেখান থেকে অরণ্যের এক অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। বিভিন্ন পাখি, হরিণ বা অন্যান্য প্রাণী দেখার জন্য ক্যামেরা হাতে ওয়াচ টাওয়ারে অপেক্ষা করতে করতে কখন যে সময় কেটে যাবে বুঝতে পারবেন না। এরকম একাধিক ওয়াচটাওয়ার জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে ওয়াচটাওয়ারের গায়ে নিজের নাম লিখে একে কলুষিত করবেন না। জঙ্গলের আরও গভীরে প্রবেশ করলে বিরাটকার ঝিল দেখতে পাওয়া যাবে। সেই ঝিলে পান্ডুবি, মেটেহাঁস, তিতির ইত্যাদি পাখি ছাড়াও শীতকালে হর্নবিল, পোকার্ড, গাডওয়াল, শোভেলার, এগ্রেট, পিনটেইল-সহ আরও নানারকম পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলবে। সেই ঝিলে প্রচুর কচ্ছপেরও বাস। বিশেষত সূর্যাস্তের সময় সেই ঝিলের ওপর আকাশের রক্তিম আভা প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য তৈরি করে। সেই রঙিন আকাশের প্রেক্ষাপটে কোলাহল করতে করতে দলবেঁধে পাখিদের ঘরে ফেরার দৃশ্যে উদাসীন হয়ে পড়ে মন, সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে আনন্দে মন ভরে ওঠে। শীতকালে বেড়াতে গেলে রঙবেরঙের পরিযায়ী পাখিদের ভিড় দেখা যায় সেখানে। পাখিপ্রেমীদের জন্য তা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য টিকিট মূল্য ন্যুনতম হওয়ার ফলে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এখানে আড্ডা দিতে আসে। অনেকে নিরিবিলিতে আড্ডা দিতে গিয়ে জঙ্গলের অনেক ভেতরে প্রবেশ করে থাকে, যা খুবই বিপদজনক হতে পারে।
বল্লভপুর অভয়ারণ্য ছাড়াও এর আশেপাশে আরও যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্র-স্মৃতিধন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, সোনাঝুরি, কোপাই নদী, কঙ্কালীতলা মন্দির, সুরুল জমিদারবাড়ি, আমার কুটির, সৃজনী শিল্পগ্রাম ইত্যাদি।
সারাবছরই প্রায় বল্লভপুর অভয়ারণ্যে পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে, কিন্তু বোলপুরে গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া প্রচন্ড গরম এবং অস্বস্তিকর হওয়ার কারণে সেই সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এখানে বেড়াতে গেলে ভ্রমণটি আরামদায়ক এবং উপভোগ্য হতে পারে। বুধবার এটি বন্ধ থাকে। সকাল নটা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে এই অভয়ারণ্য। তবে টিকিট কাটার শেষ সময় দুপুর সাড়ে তিনটে। বড়দের জন্য প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। ১২ বছরের নিচে শিশু এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য টিকিট মূল্য পাঁচ টাকা। গাড়ি পার্কিং-এরও ব্যবস্থা রয়েছে এবং তার জন্য আলাদা করে ভাড়া লাগে। গাড়ির জন্য লাগে ৩০ টাকা, বাইকের জন্য ২০ টাকা এবং সাইকেলের জন্য ১০ টাকা।
ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – ট্রেনে যেতে হলে শিয়ালদহ, হাওড়া বা বর্ধমান স্টেশন থেকে বোলপুরগামী অনেক ট্রেন পাওয়া যাবে। বোলপুর স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করে চলে যাওয়া যাবে বল্লভপুর অভয়ারণ্য। এছাড়াও সড়কপথে বাসে যেতে হলে ধর্মতলা থেকে বাস পাওয়া যাবে।
- কোথায় থাকবেন – বল্লভপুর অভয়ারণ্যের কাছেই শ্যামবাটি অঞ্চলে এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে নানারকম ভাড়ার অসংখ্য হোটেল পাওয়া যাবে থাকবার জন্য।
- কী দেখবেন – বল্লভপুর অভয়ারণ্যের প্রধান আকর্ষণ চিতল হরিণ প্রতিপালনের ক্ষেত্রটি, এছাড়াও জঙ্গলের মধ্যেকার ওয়াচটাওয়ার এবং বিশালাকার ঝিলটি, যেখানে শীতের সময় পরিযায়ী পাখিরা ভীড় জমায়।
- কখন যাবেন – বোলপুরে গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম পড়ে, সেই কারণে শীতের মরশুমে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বল্লভপুর অভয়ারণ্যে গেলে আরামে ঘোরা যাবে এবং পরিযায়ী পাখিদের দেখাও মিলবে। বুধবার এটি বন্ধ থাকে।
- সতর্কতা –
- যেহেতু অনেকটা বড় ঘন জঙ্গল, সেহেতু সঙ্গে ছোট বাচ্চা থাকলে তাদের একটু নজরে রাখা প্রয়োজন।
- জঙ্গলের গাছের ডাল ভেঙে নষ্ট করবেন না এবং বাচ্চাদের সেই কাজ থেকে বিরত রাখবেন।
- জঙ্গলের মধ্যে বড় এবং বিষাক্ত সাপ রয়েছে, তাই সাবধানে চলাফেরা করবেন।
- ওয়াচটাওয়ারের গায়ে নিজের নাম লিখে একে কলুষিত করবেন না।
- চেঁচামেচি করে জঙ্গলের পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
- অনেকে নিরিবিলিতে আড্ডা দিতে গিয়ে জঙ্গলের অনেক ভেতরে প্রবেশ করে থাকে, যা খুবই বিপদজনক হতে পারে।
সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩
তথ্যসূত্র
- নিজস্ব প্রতিনিধি
- https://en.m.wikipedia.org/
- https://indianchacha.com/
- https://www.theholidaystory.com/