নওশাদ আলী (Naushad Ali) ছিলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে সম্মানিত এবং সফল সঙ্গীত পরিচালকদের একজন হিসেবে তাঁর স্থান। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে চলচ্চিত্রে প্রথমবার সার্থকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করার জন্য বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন তিনি। নওশাদ আলী ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’র মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় ও বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। মেলোডি সুরকার হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত।
১৯১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের লখনউ- এর এক রক্ষণশীল শিয়া পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন নওশাদ আলী । তাঁর বাবা ওয়াহিদ আলী ছিলেন একজন মুন্সি। নওশাদ আলীর ছয় মেয়ে এবং তিন ছেলে। এদের মধ্যে বড় ছেলে রহমান তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজকরেছেন। নওশাদ, রহমান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মাই ফ্রেন্ড’ (১৯৭৬) এবং ‘তেরি পায়েল মেরে গীত’ (১৯৮৯) দুটির জন্য সুর করেন।
শৈশব থেকেই গানের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল নওশাদ আলীর। বাবার শাসন অমান্য করে সিনেমা দেখে রাতে বাসায় ফিরে পিটুনি খেয়েছেন অনেকবার। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়ায়, সঙ্গীত চর্চা তাঁর জন্য ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু সেইসব শাসনকে তোয়াক্কা না করে নিজের আগ্রহ থেকেই নওশাদ লখনউ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে বারাবঁকির দেবা শরীফের মেলায় যেতেন। সেখানে সেই সময়ের শিল্পীরা দর্শকদের জন্য কাওয়ালী সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। নওশাদ আলী সেখানে হারমনিয়াম মেরামত করতেন। পাশাপাশি সেখানে ওস্তাদ ঘুরবত আলী, ওস্তাদ ইউসুফ আলী, ওস্তাদ বাব্বান সাহেব এবং অন্যান্যদের কাছে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করতেন।
পরে তিনি একটি জুনিয়র থিয়েট্রিকাল ক্লাবে যোগ দেন। থিয়েটার মালিকরা তবলা, হারমোনিয়াম, সেতার এবং বেহালা বাজানোর জন্য সঙ্গীতশিল্পীদের একটি দল ভাড়া করতেন। মিউজিশিয়ানরা প্রথমে চলচ্চিত্র দেখবে, নোট তৈরি করবে, এরপর প্রয়োজনীয় সুরের স্কেল চূড়ান্ত করবে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হলে তাঁরা পর্দার সামনে বসে চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখতেন আর সুর বাজাতেন। নওশাদ আলীর জন্য এটি একই সাথে যেমন বিনোদন ছিল আবার গান শেখার জন্য একটি সুন্দর পন্থাও ছিল। মূলত নির্বাক সিনেমার যুগে চলতে থাকা সিনেমার সঙ্গে বাজানো যন্ত্রীদলের বাদন দেখেই তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন সঙ্গীতের প্রতি। এই কাজটি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করার জন্য বেশ প্রভাব ফেলেছিল তাঁর মধ্যে।
একটা সময় তিনি উইন্ডসোর মিউজিক এন্টারটেইনার্সের নামে একটি গানের দল খোলেন। এই গানের দলের সুবাদেই স্থানীয় এক নাটকের দলে যোগ দেন। সেখানে নওশাদ লাদ্দন খানের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতেন। এই দলের ঘুরে ঘুরে কাজ করার সময় তিনি পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট, সৌরাষ্ট্র ইত্যাদি অঞ্চলের লোক সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হন যা তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারকে পুষ্ট করেছিল।
১৯৩৭ সালের শেষের দিকে মাত্র ১৮ বছর বয়সে একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার জন্য বোম্বে যান নওশাদ আলী। শুরুতে তিনি কোথাও সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তাই সেখানে তাঁকে বেশ অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয় । না খেয়ে রাত পার করেছেন অনেক। ক্ষুধার্থ ও ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়েছেন ফুটপাতে। সিনেমায় কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি ব্রডওয়ে থিয়েটারের বিপরীতে ফুটপাতে থাকতেন। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে রোজগারের জন্য পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় হ্যারি ডারউইটজের সঙ্গে। তিনি তখন ‘সমুন্দর’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন। তাঁর এই ছবিটির জন্য নিয়মিত কাজ করতে পারবেন এমন গোয়ানিজ পিয়ানিস্ট খুঁজছিলেন। তখন তিনি তাঁর কলকাতার নিউ থিয়েটার্স থেকে আনা বিখ্যাত কম্পোজার মুশতাক হুসেনের অধীনে নওশাদকে ৪০ টাকা বেতনে পিয়ানিস্ট হিসেবে কাজ দিলেন।এরপর খেমচন্দ প্রকাশ তাঁকে মাসিক ৬০ টাকা ভাতায় সহকারী সঙ্গীত পরিচালনার কাজ দেন। আর তাঁর অসাধারণ কাজে মুগ্ধ হয়ে তাকে সহকারী করে নিলেন খ্যাতিমান মুশতাক হোসেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি নওশাদ।
নওশাদ আলীর এককভাবে সঙ্গীত পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘‘প্রেম নগর’’ মুক্তি পায় ১৯৪০ সালে। আর এই ছবি দিয়েই তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রথম সাফল্য আসে। এরপর আরও পরিচিত হয়ে উঠেন‘রতন’ ছবির মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালে গোটা ভারতবর্ষে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এই ছবিটি। ৭৫ হাজার টাকার বাজেটের সিনেমা ‘রতন’ মুক্তির প্রথম বছরেই শুধুমাত্র গ্রামোফোন বিক্রি থেকেই আয় করল ৩ লাখ টাকা। এর ফলে হিন্দী সঙ্গীত পরিচালকদের শীর্ষ আসনে পৌঁছে গেলেন তখনকার ২৪ বছরের যুবক সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলী। এরপর একের পর এক সাফল্য পেতে থাকেন তাঁর প্রতিভা ও পরিশ্রমের দ্বারা। একে একে কাজ করেন শাহজাহান (১৯৪৬), আনমোল ঘড়ি, (১৯৪৬), আনোখি আদা (১৯৪৬), আন্দাজ (১৯৪৭),দরদ (১৯৪৭), মেলা (১৯৪৮), চাঁদনি রাত (১৯৪৯), দিল্লাগি (১৯৪৯) প্রভৃতি সুপার হিট সিনেমায়। পঞ্চাশের দশকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নওশাদ পৌঁছে গেলেন সাফল্যের শীর্ষে। এই সময় তাঁর সুর করা জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে: দোড় বাবুল কি ঘোর, তারা কি তারা রি, ইনসাফ কি মন্দির, এসবির বানাত হু ইত্যাদি। সেই সময়েই তিনি লতা মঙ্গেশকর এবং মহম্মদ রফিকেও প্রতিষ্ঠিত করেন বলিউডের সঙ্গীত জগতে। নওশাদই প্রথম ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও উত্তর ভারতীয় লোকসঙ্গীত চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেন। এতে তিনি সফলও হন। মুঘল-ই-আজম চলচ্চিত্রে (১৯৬০) ‘‘মহব্বত জিন্দাবাদ’’ গানের জন্য, ১০০ জনের একটি কোরাস ব্যবহার করেছিলেন তিনি।
নওশাদ তাঁর সুরের প্রতিটি দিক নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। পনেরো দিন সময় নিয়ে তিনি একটি গান কম্পোজ করতেন। যদি তিনি কোনো একটি মাত্র শব্দেও সন্তুষ্ট না হন তবে তিনি গীতিকারকে পুরো লাইনটি আবার লিখতে বলতেন। বছরে মাত্র দুটি চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত সৃষ্টি করতেন।
হিন্দুস্তানি সঙ্গীত প্রচারের লক্ষ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্লট অনুমোদন চেয়ে মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন নওশাদ আলী। সেই অনুমোদন তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি সেখানে একটি একাডেমি তৈরি করেছিলেন, যা ‘নৌশাদ একাডেমি অফ হিন্দুস্তানি সঙ্গীত’ নামে স্থাপিত হয়েছিল।
বলিউডের বিখ্যাত এই সুর স্রষ্টা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য সুন্দর সুন্দর গান। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে অতৃপ্ত। ১৯৫২ সালে ‘‘বৈজু বাওরা’’ গানটি যখন ব্রডওয়ে থিয়েটারে প্রিমিয়ার হয়েছিলো, থিয়েটারের একটি জানালার কাছে গিয়ে ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন যে, সেখান থেকে এখানে পৌঁছাতে তাঁর ১৫ বছর সময় লেগেছে। তারও অনেক পরে বিবিসিকে দেয়া এক হিন্দি সাক্ষাতকারে তিনি নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি এখনও তাঁর সেরা গানটি সৃষ্টি করতে পারেননি।
সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি নওশাদ একজন কবিও ছিলেন। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে এক ‘‘বইমেলা’’য় তাঁর উর্দু কবিতার বই ‘আঠওয়াঁ সুর’ (“The Eighth Note”) প্রকাশিত হয়।
নওশাদ তার বর্ণাঢ্য জীবনে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন মোট ৬৭টি চলচ্চিত্রে । এর মধ্যে ২৫টি রজতজয়ন্তী, ৯টি সুবর্ণজয়ন্তী এবং ২টি হীরকজয়ন্তীর গৌরব অর্জন করে। ১৯৮২ সালে তিনি ভূষিত হন দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে । ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁর আজীবন অবদানের জন্য এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে নওশাদকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মভূষণে’ ভূষিত করা হয়।
২০০৬ সালের ৫ মে ৮৬ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মুম্বাইয়ের নানাবতী হাসপাতালে নওশাদ আলীর মৃত্যু হয়।
One comment