দশমহাবিদ্যা

দশমহাবিদ্যা

হিন্দু ধর্মে দেবী দুর্গার দশমহাবিদ্যার রূপ কল্পনা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিভিন্ন পুরাণে বলা হয়েছে যে কালী হল দশমহাবিদ্যার প্রধান রূপ। কালীই এই বিশ্বের সৃষ্টি করেছেন। আবার অনেক পুরাণে কালীকে দেবী দুর্গারই এক রূপ বলে কল্পনা করা হয়েছে। শাক্ত বিশ্বাস মতে, কালী আসলে মহাকালের প্রতীক যিনি সর্বগ্রাসী। এই কালীই আদ্যাশক্তি মহামায়া যার দশটি রূপকে একত্রে বলা হয় দশমহাবিদ্যা। মূলত এই দশমহাবিদ্যার ধারণা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয়পুরাণ থেকে। সংস্কৃত শব্দ ‘মহা’ এবং ‘বিদ্যা’ এই দুটি শব্দের সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে মহাবিদ্যা শব্দটি। ‘মহা’ কথার অর্থ হল মহান আর ‘বিদ্যা’ বলতে প্রকাশ, রূপ, জ্ঞান ও বুদ্ধিকে বোঝায়। তন্ত্রমতে, এই দশমহাবিদ্যা হলেন যথাক্রমে – কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলেকামিনী। নারায়ণের দশাবতারের মতো নারীশক্তির জাগরণের প্রতীক হিসেবে দেবীর এই দশমহাবিদ্যা রূপকে কল্পনা করা হয়।

কিন্তু এই দশমহাবিদ্যা রূপ কল্পনা করা হল কেন? সেই প্রসঙ্গে পুরাণে বলা হয়, দক্ষরাজের জামাতা ছিলেন শিব এবং দক্ষের কন্যা সতী। একটা বড়ো যজ্ঞ আয়োজন করেছিলেন দক্ষ আর তাতে শিবকে অবজ্ঞা করার জন্য দক্ষ তাকে এমনকি পার্বতীকেও নিমন্ত্রণ করেননি। নারদের মুখ থেকে এই সংবাদ জানতে পেরে সতী তাঁর পিতার কাছে যাবার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন এবং শিবকে অনুরোধ করেন তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যেহেতু শিবকে নিমন্ত্রণ করেননি দক্ষ তাই শিব এই অনুরোধ রাখতে চাইলেন না। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে সতী এই দশমহাবিদ্যা রূপ ধারণ করে শিবকে ভয় দেখিয়ে অনুমতি আদায় করতে চাইলেন। এই দশমহাবিদ্যা রূপের প্রতিটিরই বিশেষ বিশেষ তাৎপর্য আছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক।

শুম্ভ আর নিশুম্ভের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতাদের মিলিত প্রার্থনায় দেবী দুর্গার ভ্রুকুটি থেকে আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী কালী, দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ। তার গলায় নরমুণ্ডের মালা, ঘন কৃষ্ণবর্ণের দেবী ভয়ালরূপিণী। প্রকাণ্ড রক্তাভ জিভ প্রসারিত করে চার হাতে রণরঙ্গিনী ধ্বংসের মূর্তি হিসেবে কালীকে কল্পনা করা হয়। খড়্গ, চন্দ্রহাস, নরমুণ্ড আর পাশ এই চার প্রকার অস্ত্র নিয়ে কালী এই জগৎ সংসারের অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটান।

দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় রূপ তারা ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা এক নবযৌবনা নারী। প্রজ্জ্বলিত চিতার মধ্যে শিবের বুকের উপর পা দিয়ে দেবী তারা আবির্ভূতা হয়েছেন। নীল গাত্রবর্ণের কারণে তাঁকে বলা হয় মহানীল সরস্বতী।

দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ ষোড়শীকে পুরাণে ললিতাসুন্দরী বা ত্রিপুরাসুন্দরীও বলা হয়। ‘ত্রিপুর’ অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্নাতে অবস্থিত এই ষোড়শী। এই ত্রিপুর আসলে মন, চিত্ত ও বুদ্ধি। মহাদেবের নাভিপদ্মের উপর অধিষ্ঠিত দেবী ষোড়শীর রঙ ভোরের সূর্যের মতো কোমল। ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ষোড়শী ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী ও রুদ্রাণীর মিলিত রূপ।

চতুর্থ রূপ ভুবনেশ্বরী বিশ্বজননী রক্ষক। পুরাণের কাহিনি অনুযায়ী উন্মত্ত হয়ে দেবী যখন ষোড়শী রূপ ধারণ করেন, তখন শিবের বুকে নিজের ভয়াল ছায়া দেখে খুবই ভীত হয়ে পড়েন। তারপর সেই ছায়া দেখে নিজের বলে যখন চিনতে পারেন, তখন কিছুটা সুস্থিত হন দেবী। এই অবস্থার রূপই হলেন ভুবনেশ্বরী। চার হাতে বরাভয় মুদ্রায় অধিষ্ঠিত এই দেবী জগতের সৃষ্টিকর্তা।

এর পরের রূপ ভৈরবী চতুর্ভূজা এবং তার হাতে রয়েছে অক্ষমালা। অস্ত্রহীনা এই দেবী বিদ্যা ও ধন-সম্পদের দেবী। চৌষট্টি যোগিনীর মধ্যে এক অন্যতম যোগিনী এই ভৈরবী। দেবী দুর্গার সহচরী রূপে তাঁকে বর্ণনা করা হয়। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এই দেবীর নামেই একটি বিশেষ রাগিণী রয়েছে। ত্রিপুরা ভৈরবী নামেও এই দেবী পরিচিতা হন।

সবথেকে ভয়ঙ্করী রূপ ছিন্নমস্তার দেবী মূর্তি কল্পনায় দেখা যায় দেবী এক হাতে নিজের মাথা নিজের হাতেই কেটে সেই খণ্ডিত মস্তক থেকে নির্গত রক্ত নিজেই পান করছেন। তার সহযোগী ডাকিনী আর যোগিনীও সেই রক্ত পান করছেন। রতি এবং কামদেবের বুকের উপর দণ্ডায়মান দেবী ছিন্নমস্তা সম্পূর্ণ নগ্ন এবং তার গলায় ঝুলছে নরমুণ্ডের মালা। ভয়ঙ্কর ভয়াল রূপের এই ছিন্নমস্তা ধ্বংসের প্রতিরূপ। এই ছিন্নমস্তা রূপের পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনী লুকিয়ে আছে। একবার ছিন্নমস্তার সহকারী ডাকিনী ও যোগিনী নদীতে স্নান করে উঠে আসার পর প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে দেবীর কাছে খেতে চাইলেন। কিন্তু তাদের খাদ্য শুধু রক্ত ও মাংস, তাই দেবী ক্ষুধার্ত সহকারীদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নিজের কণ্ঠচ্ছেদ করে ফেলে নিজে ও ডাকিনী-যোগিনীকে রক্ত পান করান।

দশমহাবিদ্যার সপ্তম রূপ হল ধূমাবতী। ‘ধূম’ কথার অর্থ হল ধোঁয়া। যিনি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন তাঁকেই ধূমাবতী বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী প্রচণ্ড ক্ষুধায় ঘরে খাদ্যদ্রব্য বা অন্ন কিছুই না থাকায় পার্বতী শিবকে গ্রাস করে ফেলেন আর সেই সময়েই তাঁর দেহ থেকে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হতে থাকে। সেই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দেবী ম্লান ও বিবর্ণ হয়ে যান। শিবকে গ্রাস করার পরে তিনি বৈধব্যে উপনীত হন। আর দেবীর এই বৈধব্য বেশই ধূমাবতী। এই দেবীর দুই হাতের এক হাতে থাকে কুলো আর অন্য হাতে থাকে ধর। রথে আসীন দেবী ধূমাবতীর সঙ্গে শিব থাকেন না এবং তাঁকে দেখে মনে হয় অত্যন্ত বৃদ্ধা, কৃশা ও মলিনবসনা। তাঁর রথের চারটি ধ্বজায় উপবিষ্ট থাকে চারটি কাক।

বগলা দেবী অনেক ক্ষেত্রে পুরাণে পীতাম্বরা নামেও পরিচিতা। দশমহাবিদ্যার অষ্টম দেবী বগলা রুরু নামক দৈত্যের পুত্র দুর্গমকে যুদ্ধে পরাজিত করে দেবতাদের রক্ষা করেন। শবদেহই দেবীর বাহন। বগলা দেবীর চিত্ররূপে দেখা যায় দেবী তাঁর বাঁ হাত দিয়ে দুর্গমের জিভ টেনে ধরে ডান হাত দিয়ে তাঁকে গদাঘাত করছেন। এই দেবীর চারটি হাতের বদলে দুটি হাত লক্ষ করা যায়।

এরপরেই আসেন শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না দেবী মাতঙ্গী। ‘মাতঙ্গ’ কথার অর্থ হল হাতি। হাতি হল এই দেবীর সন্তান। পুরাণে বলে, মাতঙ্গ নামের এক মুনির আশ্রমে দেবতারা যখন সাধনা করছিলেন, তখন দেবী মাতঙ্গী আবির্ভূতা হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। এই দেবীর মাথায় চাঁদ শোভিত হয়।

সবশেষে দশমহাবিদ্যার দশম রূপ হলেন দেবী কমলা। বরাভয়দাত্রী দেবী কমলা আসলে লক্ষ্মীরই অপর রূপ। দেবী কমলাকে অনেক সময় কমলেকামিনীও বলা হয়ে থাকে নানা পুরাণে। পদ্মাসনা দেবী চতুর্ভূজা এবং তার দুই হাতে রয়েছে কামিনী অর্থাৎ পারিজাত ফুল আর দুই হাতে আশীর্বাদ দেন দেবী। এই কমলেকামিনী রূপটি আসলে দেখা যায় সরোবরের মধ্যে দু পাশে দুটি হাতি শুঁড় দিয়ে দেবীকে স্নান করাচ্ছে। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের বণিক খণ্ডে ধনপতি সদাগর সমুদ্রের মধ্যে দেবীর এই রূপই দেখেছিলেন।

পুরাণে বলা হয়, এই দশটি রূপ ধারণ করে দশ দিক দিয়ে শিবকে ঘিরে ফেলেন এবং অবশেষে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে শিবকে সম্মত করাতে সমর্থ হন দেবী। এই দশমহাবিদ্যার রূপ হিন্দু ধর্মে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

2 comments

আপনার মতামত জানান