লতা মঙ্গেশকর

লতা মঙ্গেশকর

লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar) একজন ভারতীয় প্লেব্যাক কণ্ঠশিল্পী যিনি ভারতের সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় গায়িকা হিসেবে জনমানসে আদৃত হয়ে আছেন। প্রায় ৩৬টিরও বেশি ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় হাজারের বেশি গান গেয়েছেন তিনি। গায়িকার পরিচয়ের বাইরেও সঙ্গীত পরিচালক বা চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে তাঁর খ্যাতি থাকলেও, লতা মঙ্গেশকরের নাম উচ্চারিত হলেই সেই সাথে উঠে আসে ভারতীয় সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের স্মৃতি, যা একইসাথে শ্রুতিমধুর এবং আনন্দঘন। এই “আনন্দঘন” ছদ্মনামেই সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন এই কালজয়ী শিল্পী। লতা মঙ্গেশকর মানে শুধুই এক সুমধুর সুরেলা কণ্ঠের অধিকারীর নাম নয়, দারিদ্র, পুরুষকেন্দ্রিক দুনিয়ায় নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর একা এক মহিলার লড়াইয়ের নামও বটে।

১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অধুনা মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরে লতা মঙ্গেশকরের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম হেমা মঙ্গেশকর। তাঁর বাবার নাম পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর এবং মায়ের নাম সেবন্তি। পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী এবং মঞ্চাভিনেতা। তাঁদের পারিবারিক পদবী ছিল হারিদকর। পরিবারসূত্রে মঙ্গেশকরেরা ছিলেন গোয়ার মঙ্গেশ মন্দিরের পুরোহিত। গোয়ার মঙ্গেশ মন্দিরের সাথে তাঁদের যোগসূত্রের কথা স্মরণ করে দীননাথ হারিদকর উপাধি পাল্টে তাঁদের পদবী রাখেন মঙ্গেশকর। পরবর্তী সময়ে দীননাথ মঞ্চাভিনয় পেশা থেকে সরে আসেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধনার উদ্দেশ্যে। হেমা তাঁদের প্রথম সন্তান। দীননাথ অভিনীত নাটকের এক প্রিয় চরিত্র লতিকার নাম অনুসারে হেমার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লতা। সঙ্গীতের আবহে বড় হওয়ার সুবাদে লতার তিন বোন মীনা, আশা, ঊষা এবং এক ভাই হৃদয়নাথও ভবিষ্যতে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর মেজবোন আশা মঙ্গেশকর (ভোঁসলে)পরবর্তীকালে প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজের আলাদা পরিচিতি তৈরি করেন লতার ছত্রছায়া থেকে বেড়িয়ে এসে। তাঁর ভাইবোনেরা সংসারী হলেও নিজের সংসারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লতা কোনোদিনই বিবাহ করে সংসারী হননি।

খুব ছোটবেলায় লতাকে স্কুলে ভর্তি করা হলেও তাঁর স্কুলজীবনের মেয়াদ মাত্র একদিন, কারণ, তাঁর স্কুল থেকে বলা হয়েছিল স্কুলে আসতে হলে একা আসতে হবে কোলে করে ছোটবোন আশাকে আনা যাবেনা। এই সিদ্ধান্তে বিরক্ত হয়ে আর কোনদিন স্কুলের চৌহদ্দিতে পা রাখেননি লতা। তার ফলে বাড়িতে গানবাজনা, খেলাধুলোর মধ্যেই কাটতে থাকে তাঁর শৈশব। একদিন তাঁর কানে যায় তাঁর বাবার এক ছাত্র কিছুতেই শেখানো রাগের অনুশীলন সঠিকভাবে করতে পারছেনা। বাবাকে লুকিয়ে সেই ছাত্রের ভুল শুধরে দেন লতা। ঘটনাটি তাঁর বাবা লক্ষ্য করেছিলেন আড়াল থেকে। এই ঘটনার পর দিন থেকেই শুরু হয় লতার সঙ্গীত শিক্ষা। ৫ বছরের ছোট্ট লতা তানপুরা হাতে বাবার কাছে পুরিয়া ধানেশ্রী তুলতে শুরু করেন অবলীলাক্রমে। এর দু’বছরের মাথায় বাবার সাথে মঞ্চে অভিনয় ও সঙ্গীত পরিবেশন শুরু হয় তাঁদের সঙ্গীত নাটকের গোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রযোজনায়। এই ভাবে আরও ২ বছর কেটে যাওয়ার পর একদিন বাবার একক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পান ন’বছরের লতা। খুব পরিপাটি করে রাগ খাম্বাওয়াটি গাওয়ার পর মঞ্চের ওপর বাবার কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এমন একটা রূপকথার মতো শৈশব আচমকা হোঁচট খায় ১৯৪২ সালে হৃদরোগে তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে। চার ভাইবোন আর মাকে নিয়ে অকূলপাথারে পরেন ১৩ বছরের লতা। বিনায়ক দামোদর কর্নাটকি বা মাস্টার বিনায়ক ছিলেন লতাদের পারিবারিক বন্ধু। তিনি তাঁর নবযুগ ফিল্ম কোম্পানিতে ছোটখাটো চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় করার সুযোগ করে দেন লতাকে। শুরু হয় এক নতুন যাত্রা। অভিনয় করতে ভাল না লাগলেও নিজের পরিবারের কথা ভেবে দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকেন লতা। চরিত্রের প্রয়োজনে চুল কেটে বা ভুরু প্লাক করে দিলে বাড়িতে ফিরে মা’র কোলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা তাঁর। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার একটাই পথ জানা ছিল তাঁর,সঙ্গীত। সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে শুধু গান গেয়েই দিন এবং সংসার চালানো যায়। কয়েকটি মারাঠি ছবিতে অভিনয় এবং গান গাওয়ার পরে ১৯৪৩ সালে মারাঠি ছবি গজভাউ’য়ে প্রথমবার হিন্দিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান লতা। ১৯৪৫ সালে মাস্টার বিনায়কের আহ্বানে সপরিবারে বম্বে’তে পা রাখেন লতা মঙ্গেশকর। মাস্টার বিনায়কের উদ্যোগেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নাড়া বাঁধেন বম্বে’র বিখ্যাত ভিন্ডিবাজার ঘরানার ওস্তাদ আমান আলি খানের কাছে। লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও ওস্তাদ ওয়ালি আহমেদ খাঁ, নিসার বাজমি, মান্না দে’র মতো নক্ষত্ররাও তৈরি হয়েছিলেন ওস্তাদ আমান আলি খানের হাতে। মাস্টার বিনায়কের প্রথম হিন্দি ছবি ‘বড়ি মা’-তে অভিনয়ের সুযোগ পান লতা এবং আশা। এই ছবিতে “মাতা তেরি চরনো মে” নামের একটি চমৎকার ভজন গান লতা। প্রশিক্ষণ ও পেশা এক সাথেই চলতে থাকে তাঁর। একটা সময় তিনি বুঝতে পারেন যে সকাল থেকে রাত অবধি স্টুডিওতে কাজ করার পরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম চালিয়ে যাওয়া ক্রমশই অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাঁর প্রাণের আরাম, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের থেকে পরিবারের চাহিদা, ভাইবোনদের মানুষ করার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব পায় বেশী। এই সময়ে ১৯৪৮ সালে মৃত্যু হয় তাঁর পিতৃতুল্য মাস্টার বিনায়কের।

লতা ঠিক করেন অভিনয় আর নয়। এবার শুধুই সঙ্গীত নিয়ে পথ চলা শুরু। এই সময় আলাপ হয় সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের সাথে। বহু বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে লতা স্বীকার করেছিলেন গুলাম হায়দারই ছিলেন তাঁর আসল পথপ্রদর্শক। লতার ক্ষমতার উপর অগাধ আস্থা ছিল তাঁর। ১৯৪৮ সালে শশধর মুখার্জি তাঁর শহীদ ছবিতে নায়িকা কামিনী কৌশলের কণ্ঠে গান গাওয়ার জন্য নতুন কণ্ঠ খুঁজছিলেন। গুলাম হায়দার লতার নাম প্রস্তাব করলে শশধর মুখার্জি মানতে চাননি। তাঁর মনে হয়েছিলো, নায়িকার তুলনায় লতা’র কণ্ঠ একটু বেশী পাতলা। গুলাম হায়দারের পছন্দ হয়নি এই মন্তব্য। তিনি তখন মজবুর নামের একটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করছিলেন। সেই ছবিতে গাওয়া “দিল মেরা তোড়া” গানটি হয়ে ওঠে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীত জীবনের প্রথম হিট গান। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে কোনও আলাদা প্রশিক্ষণ তখন হতনা। তাই প্রতিটি গান তাঁর কাছে ছিল একেকটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা, প্রত্যেক সঙ্গীত পরিচালকের থেকেই কোনও না কোনও ভাবে প্রশিক্ষিত হচ্ছিলেন তিনি। শুরুর দিকে তাঁর গায়কিতে যে নুর জাহানের গায়কির ছাপ খুঁজে পাওয়া যেত, ক্রমশ তাঁর প্রভাব কাটিয়ে উঠছিলেন তিনি। একবার কথাপ্রসঙ্গে দিলীপ কুমার তাঁকে বলেন, তাঁর উর্দু উচ্চারণে মারাঠি ছাপ স্পষ্ট। সেই সময়ে অধিকাংশ হিন্দি গানে উর্দু শব্দের ব্যবহার হত। এই সমস্যার সমাধানে লতা শরনাপন্ন হলেন সহকারী সঙ্গীত পরিচালক মহম্মদ শফি’র। কিছুদিনের মধ্যেই এক মৌলবিসাহেব নিযুক্ত হলেন লতাকে উর্দু শেখাতে। সদ্য স্বাধীন ভারতে অনেক কিছুর মতই গান রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও কোনও প্রযুক্তিগত সুবিধা পাওয়া ছিল দুষ্কর। গোটা অর্কেস্ট্রার সাথে বহুবার রিহার্সালের পর একবারে রেকর্ড করা হত এই সব অসাধারণ গান। কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ হলে আবার গোটা পর্বটির পুনরাবৃত্তি করতে হত। এইভাবেই সৃষ্টি হয়ে এসেছে একের পর এক কালজয়ী গান। ১৯৪৯ সালে মহল ছবিতে “আয়েগা আনেওয়ালা”র মতো গানও এই ভাবেই খ্যাতির শিখরে তুলেছে লতাকে।

৫০’এর দশক ছিল এক ঝাঁক নতুন তারকার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার দশক। অনিল বিশ্বাস, শঙ্কর-জয়কিশেন, নওশাদ আলি, এস ডি বর্মণ, হেমন্ত কুমার, সি রামচন্দ্র, সলীল চৌধুরী, খৈয়াম, রবি, সাজ্জাদ হুসেন, রোশান, কল্যানজি-আনন্দজি, বসন্ত দেশাই, বা মদনমোহনের মতো প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতপরিচালকদের সাথে একাদিক্রমে কাজ করে যাওয়া এবং নতুন নতুন গানের সুরে নিজের কণ্ঠের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করার দশক। বৈজু বাওরা, মাদার ইন্ডিয়া, আহ, শ্রী ৪২০, দেবদাসের মতো অসামান্য সব ছবিতে গান গাওয়ার পর ১৯৫৮ সালে প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান মধুমতী ছবিতে “আজা রে পরদেশি” গানের জন্য। ১৯৬০ সালে মুঘল-এ-আজম ছবিতে “প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া” আজও মানুষের মনে থেকে গেছে। ১৯৬২ সালে বিশ সাল বাদ ছবিতে হেমন্তকুমারের সুরে “কহি দীপ জ্বলে কহি দিল” গানটি তাঁকে এনে দেয় তাঁর দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। ১৯৬৩ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে “অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো” জল এনে দেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর চোখেও।

এরপরের কয়েক দশক ধরে লতা শুধু যে সঙ্গীতের সেবা করে গেছেন তাই নয়, ধীরে ধীরে এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পীর থেকে সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছেন। সঙ্গীত পরিচালকদের একাধিক প্রজন্মের সাথে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করে গেছেন। আর তাই নতুন শতাব্দীতে এসেও তিনি একই রকম প্রাসঙ্গিক। তাঁর গুণগান করার জন্য নওশাদ আলি থেকে এ আর রহমান পর্যন্ত সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকেন। মহম্মদ রফি, হেমন্তকুমার, কিশোরকুমার, শামশাদ বেগম, আশা ভোঁসলে, মুকেশ, তালাত মেহমুদ, মান্না দে-র মতো সহশিল্পীরাও যখন তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন নব্বই বছর বয়সে পৌঁছে তাঁর মনে হতেই পারে, তাঁর প্রাপ্তির ঘড়া পূর্ণ হল। তিনটি জাতীয় পুরস্কার, ১৫টি বিএফজেএ পুরস্কার, ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ছাড়াও পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের পর ২০০১ সালে তিনি অর্জন করেন ভারতরত্ন সম্মান। ২০০৭ সালে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ নাগরিক সম্মান লিজিওন অফ অনার এও ভূষিত হন তিনি।

এত পুরস্কার, এত খ্যাতির পরেও লতা মঙ্গেশকর মনে করতে পারেননা কোনটা তাঁর জীবনের সেরা গান, সেরা মুহূর্ত। গোটাটাই একটা যাত্রাপথ, একটা প্রশিক্ষণ পর্ব বলে মনে হয় তাঁর। এখনও তাঁর মনে হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার ছিল, আরও কিছু কাজ করা হয়ত এখনও বাকি।

২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৯২ বছর বয়সে লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যু হয়।

ওনার জীবনী ভিডিও আকারে দেখুন এখানে

6 comments

আপনার মতামত জানান