মান্না দে

বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক প্রবাদ প্রতিম সঙ্গীতশিল্পী হলেন মান্না দে (Manna Dey)। তিনি বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও পাঞ্জাবি, গুজরাতি, মারাঠি, কন্নড়, মালায়ালম ইত্যাদি ভাষাতেও গান গেয়ে গানের জগতে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছিলেন।

১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতার এক একান্নবর্তী পরিবারে মান্না দে ‘র জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম পূর্ণ চন্দ্র দে ও মায়ের নাম মহামায়া দে। বাবা’র দেওয়া নাম ‘প্রবোধ চন্দ্র দে’ হলেও ডাক নাম ‘মান্না দে’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। শিশু মান্না তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামক একটি প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে। এরপর ‘স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল’ ও ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’-এ তিনি পড়াশোনা করেন এবং বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছোট বেলায় গান বাজনার থেকে খেলাধুলায় মান্না বেশি আগ্রহী ছিলেন। কুস্তি ও বক্সিং-এ তিনি প্রশিক্ষণ প্রাপ্তও হয়েছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবর গুহ’র কাছে। মান্না দে’র পরিবার আইনি পেশার সাথে যুক্ত থাকার দরুন তাঁর বাবা চাইতেন ছেলে বড় আইনজীবি হোক কিন্তু তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র (বিখ্যাত সংগীত পরিচালক) দ্বারাই বেশী অনুপ্রাণিত হন এবং সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গীত জগতে প্রবেশ।

মান্না দে’র গানের জগতে প্রথম প্রবেশ স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েটে পড়ার সময়। এই সময় থেকেই তিনি গান সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পড়াশোনার ফাঁকেই তিনি বন্ধুদের নিয়ে গানের আড্ডা বসাতেন। এই সময়ে তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে, উস্তাদ দাবির খান ও আরো কয়েক জনের কাছে সংগীতে চর্চা করতেন। কলেজে পড়ার সময় পরপর তিনটি প্রতিযোগিতায় তিনি সাফল্য লাভ করেন- ‘ইন্টার কলেজ কম্পিটিশন’ ও ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশন’ যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘ইন্টার কলেজ কম্পিটিশন’-এ প্রথম হয়ে তিনি ‘রুপোর তানপুরা’ উপহার পেয়েছিলেন যা আজও কলেজে বর্তমান রয়েছে গর্বের স্মৃতি হিসাবে। এভাবেই ধীরে ধীরে গানের জগতে তাঁর প্রবেশ ক্রমশ নিশ্চিত হতে থাকে। কাকা সঙ্গীত শিল্পী হওয়ায় তাঁর সাথে স্টুডিওতে গিয়ে গান রেকর্ড, গান সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার শেখেন এবং গানের জগতের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সাথে তাঁর পরিচয় হতে শুরু হয়।

১৯৪২ সালে মান্না দে বোম্বে(মুম্বাই) গিয়ে কাকার সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে শচীন দেববর্মনের সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হয়েও কাজ করেন তিনি। মান্না দে স্বাধীনভাবে অনেক হিন্দি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন এবং এই সময় তিনি উস্তাদ আমান আলি খান ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে উর্দু সঙ্গীতের তালিম নিতেন।

কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র পরিচালনায় ‘তামান্না’ ছবিতে “জাগো আয়ে ঊষা পঞ্চি বলে জাগো” গানটি সুরাইয়া’র সাথে দ্বৈত ভাবে রেকর্ড করেছিলেন। গানটি সেই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।১৯৪৩ সালে ‘রাম রাজ্য’ ছবিতে একক ভাবে “গায়ি তু গায়ি সীতা সতী” গানটি গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্লেব্যাক গায়ক হিসাবে কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে বাংলা ও মারাঠি ভাষায় একই নামে ‘আমার ভূপালি’ নামে একটি ছবি তৈরি হয়। এই ছবিতে গান গেয়ে তিনি দর্শকদের মনে পাকাপোক্ত ভাবে জায়গা করে নেন এবং একজন উঁচু দরের গায়ক হিসাবে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলেন। এই ছবিতে তিনি বাংলা ও মারাঠি দুটি ভাষাতেই গান গেয়েছিলেন।

১৯৪৯ সালে মান্না নবাগতা সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সাথে ‘নরসিংহ অবতার’ ছবিটির জন্য দ্বৈত ভাবে গান রেকর্ড করেন। ১৯৫১ সালে কিশোর কুমারের সাথে ‘আন্দোলন’ ছবিটির জন্য দ্বৈত ভাবে গান রেকর্ড করেন। ১৯৫৩ সালে আশা ভোঁসলের সাথে ‘বুটপালিশ’ ছবিটির জন্য দ্বৈতভাবে গান রেকর্ড করেন। এভাবেই মান্না দে’র গায়ক জীবন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে।

মান্না দে’র জীবনে শচীন দেববর্মনের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শচীন দেববর্মনের সুরে ও তাঁর সহকারী হয়ে একাধিক ছবিতে গান গেয়ে তিনি শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। শচীন দেববর্মনের সাথে মান্না’র কাজ শুরু সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। এছাড়াও সলিল চৌধুরী ও রবিজি’র সুরেও তাঁর গান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। রাজ কাপুরের সাথে কাজ করেও তিনি শ্রোতাদের অনেক অমূল্য গান উপহার দিয়ে গেছেন। হিন্দি ছবিতে গাওয়া তাঁর বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ”জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি”, ‘প্যার হুয়া ইকরার হুয়া”, “আ্য মেরি জোহরা জবি”, “ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরেঙ্গে” ইত্যাদি।

বাংলা ছবিতে গাওয়া তাঁর গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল – “যদি কাগজে লেখো নাম”, “চম্পা চামেলি গোলাপের-ই বাগে”, “কে প্রথম কাছে এসেছি”। এছাড়াও আরও অসংখ্য চিরকালীন জনপ্রিয় গান তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। মান্না দে গানের অ্যালবামের জন্যও অনেক গান রেকর্ড করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে “মধুশালা” গানের অ্যালবামটি উল্লেখযোগ্য। এই অ্যালবামের গানগুলি ছিল অমিতাভ বচ্চনের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চনের লেখা উর্দু কবিতার উপর। স্পষ্ট উর্দু উচ্চারণ ও এক অসামান্য অভিজাত কণ্ঠে কবিতা পাঠে তিনি এক আলাদা অধ্যায় তৈরি করেছিলেন। যদিও এই অ্যালবামের জন্য তিনি সেভাবে বাঙালি শ্রোতা পাননি। তাঁর কণ্ঠে “কফি হাউসের আড্ডা”, “সে আমার ছোট বোন”, “আমায় একটু জায়গা দাও মন্দিরে বসি”, “আমার সাধ না মিটিল আশা না ফুরিলো” বাংলা গানের জগতে চিরকালীন জায়গা নিয়ে নিয়েছে। ২০০৪ সালে মান্না দে “ভারত তীর্থ” নামে একটি অ্যালবামের জন্য গান রেকর্ড করেন। ২০০৬ সালে মান্না দে’র পুজো অ্যালবাম “ঠিক ছবির মতো” বের হয়। এই অ্যালবামের গানগুলির সুরকার ও গায়ক দুইই ছিলেন মান্না দে। এছাড়াও বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে তিনি সুরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন যেমন- ‘বাবুমশাই’, ‘প্রেয়সী’ ইত্যাদি। ২০০৭ সালে ওয়ান-ডে বিশ্বকাপের সময় ক্রিকেট নিয়ে তিনি একটি গান রেকর্ড করেছিলেন।

মান্না দে’র গানের কেরিয়ারের উল্লেখযোগ্য সময় ছিল ১৯৫৩-১৯৭৬। এই সময়ে তিনি অনেক অমূল্য গান শ্রোতাদের উপহার দিয়ে গেছেন। গানের পরেই তাঁর সব থেকে প্রিয় বিষয় ছিল খেলা। ফুটবল খেলা তিনি খুব ভালোবাসতেন। মান্না দে’র গলায় ও নচিকেতা ঘোষের সুরে বিখ্যাত গান “আহা সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল” আজও বাঙালির মনে জায়গা করে আছে। খেলায় অনুশীলন ও সংযমী জীবন যাপনের কারণে তিনি আশি বছর বয়সেও বিদেশ সহ অন্যান্য জায়গায় গানের অনুষ্ঠান করতে যেতেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তাঁর স্ত্রী সুলোচন দেবী কে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁর গানের অনুপ্রেরনা হিসাবে স্ত্রী’র নাম উল্লেখ করতেন। মান্না দে দুই কন্যা’র পিতা ছিলেন। তাঁর দুই মেয়ের নাম সুরমা ও সুমিতা। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে সুরমা ক্যান্সারে মারা যান। স্ত্রী এবং মেয়েকে হারিয়ে শেষ জীবনে অনেক সময়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়েই জলসায় গান গাইতে যেতেন।

সঙ্গীত জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের তিনি সারাজীবনে অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করেন। এছাড়া
২০০৫ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’, ২০০৯ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’, ২০১১ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।

২০১৩ সালে ২৪ অক্টোবর মান্না দে’র ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে মৃত্যু হয়।

6 comments

আপনার মতামত জানান