ভারতীয় সঙ্গীতের ভান্ডারকে যে সমস্ত সঙ্গীতসাধকেরা অতুলনীয় প্রতিভায় সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বাঙালি সুরকার নচিকেতা ঘোষ (Nachiketa Ghosh)। ডাক্তারি পাশ করেও তিনি চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে বেছে নিয়েছিলেন সুর-তাল-লয়ের জগতকে। বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে তাঁর অবদান আজও বাঙালি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। তবে কেবলমাত্র বাংলা সিনেমার জন্যই নয়, হিন্দি এবং ওড়িয়া ভাষার ছবিতেও সঙ্গীত নির্মাণের কাজ করেছিলেন এবং নিজস্ব এক স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন নচিকেতা। শুধুই সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নন, একজন গীতিকার হিসেবেও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন তিনি।
১৯২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি কলকাতায় এক শিক্ষিত পরিবারে নচিকেতা ঘোষের জন্ম হয়। তাঁর বাবা সনৎ কুমার ঘোষ পেশায় একজন নামজাদা ডাক্তার ছিলেন। ফলত তাঁর ছেলে নচিকেতাকেও বড় হয়ে একদিন নামী ডাক্তার হবে এই স্বপ্ন দেখতেন। ডাক্তার হলেও গান বাজনার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক। যার ফলস্বরূপ তাঁদের শ্যামবাজারের বাড়িতে প্রতি রবিবার বিখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্ত, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সুবল দাশগুপ্ত, কানা সাতকড়ির মতো বিশিষ্ট সব সুরকাররা এসে জড়ো হতেন এবং গানবাজনার এক জমকালো আসর বসত। সঙ্গীতের সেইসব দিকপালদের সাথে তবলা বাদক হিসেবে সঙ্গত দিতেন নচিকেতা। ছোট থেকেই নচিকেতা সঙ্গীতের তালিম নিতেন ওস্তাদ দ্রাবিড় খান এবং অনাথ বসুর কাছে। নচিকেতার স্ত্রীয়ের নাম শিবানী দত্ত। শ্রাবণী এবং সম্পূর্ণা নামে তাঁদের দুই মেয়ে এবং সুপর্ণকান্তি নামে এক ছেলে রয়েছে তাঁদের। সুপর্ণকান্তি ঘোষও বাংলার একজন সুপরিচিত সঙ্গীত নির্মাতা এবং গত তিন দশক ধরে তিনি তাঁর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’র মতো বেশ কিছু কালজয়ী গানের সুরকার এই সুপর্ণকান্তি ঘোষ।
বাবার ইচ্ছানুযায়ী নচিকেতা আরজিকর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডাক্তারি পড়বার জন্য ভর্তি হয়ে সফলভাবে ডাক্তারি পাস করলেন। ডাক্তারি পাস করেও নচিকেতার মন পড়ে রইল গানের জগতে।
ডাক্তারি ছেড়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নচিকেতা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করা শুরু করেছিলেন। অবশ্য কলেজে থাকতেই তিনি এই কাজ শুরু করেছিলেন। ‘টোয়েন্টি ফিফথ জুলাই’ নামে একটি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর হাতে খড়ি হয় যদিও শেষ পর্যন্ত সেই সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে ‘বৌদির বোন’ চলচ্চিত্র থেকে একজন পেশাদার সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন নচিকেতা। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জয়দেব’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি প্রভূত প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
ষাট সত্তরের দশকে এমন কোনো প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না যিনি নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে কাজ করেননি। তবে মান্না দে-কে দিয়েই বোধহয় সবচেয়ে বেশি গান গাইয়েছিলেন তিনি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে এক বিপ্লব এনেছিলেন নচিকেতা। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ‘স্ত্রী’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মৌচাক’ ইত্যাদি উত্তমকুমার অভিনীত চলচ্চিত্রে নচিকেতা তাঁর অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেনের সাথেও অত্যন্ত হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল নচিকেতার।
নচিকেতা ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনাতেই লতা মঙ্গেশকর প্রথমবার বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। আবার ‘ইন্দ্রানী’ ছবির জন্য নচিকেতাই মহম্মদ রফিকে দিয়ে প্রথমবার কোন বাংলা ছবির জন্য একটি হিন্দি গান গাইয়েছিলেন। ‘সবহি কুছ লুটাকর হুয়ে হাম তুমহারে’ নামের সেই গানটি শুনে রফির পছন্দ হলেও সেই ছবির প্রযোজক ফি হিসেবে পাঁচশো টাকার বেশি দিতে পারবে না জেনে রফি চমকে উঠেছিলেন প্রায়৷ ফলত নচিকেতা নিরাশ হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিলেন রফি তাঁকে ডেকে বলেছিলেন এই গান তিনি বিনা পারিশ্রমিকেই গেয়ে দেবেন।
‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ’, ‘সূর্য ডোবার পালা’, ‘পুতুল নেবে গো’, ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’, ‘মানুষ খুন হলে পরে’, ‘পাগলা গারদ কোথায় আছে’, ‘কিচিমিচি কিচিমিচি’, ‘যদি ভাবো এতো খেলা নয়’, ‘মৌ বনে আজ’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ ইত্যাদি অবিস্মরণীয় সমস্ত বাংলা গানের নেপথ্য নায়ক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ।
তবে কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের সঙ্গীতই নয়, মৌলিক গানেও নচিকেতার প্রতিভার বিচ্ছুরণ লক্ষ করা যায়। মুকুল দত্ত, শ্যামল গুপ্ত, পবিত্র মিত্র, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো গীতিকারদের লেখা থেকে নচিকেতার অসাধারণ সঙ্গীত নির্মাণ বাংলা আধুনিক গানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। এই ধরনের আধুনিক গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘তুমি এলে অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এল’, ‘একগোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘মরি মরি একি লজ্জা’, ‘ক’ফোঁটা চোখের জল’, ‘বনে নয় মনে মোর’, ইত্যাদি। এছাড়াও গ্রামোফোনের জন্যও গান রেকর্ড করেছিলেন তিনি। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ নামক শিশুদের একটি অডিও অ্যালবামের জন্যেও নচিকেতার সঙ্গীত নির্মাণ চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
সাহিত্যিক সমরেশ বসুর সঙ্গেও বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল নচিকেতার। অনেক সময় গানের কথার মধ্যে অভিনব শব্দ প্রয়োগের জন্য তিনি নির্ভর করতেন সমরেশ বসুর ওপরেই। পার্কস্ট্রিটের একটি বারে বসে দুজনে এই শব্দ নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। ‘ফরিয়াদ’ সিনেমার একটি গান ‘এ ছুরি জানে ভানুমতির খেল’ গানে ‘লুটেরা ছুরি’, ‘খুনেরা ছুরি’র মতো শব্দের নেপথ্যে কিন্তু ছিলেন সমরেশ বসু।
কেবল সুরই নয়, মাঝেসাঝে গান রচনাও করতেন নচিকেতা। অনেক সময় গানের প্রথম লাইনটি রচনা করে বাকিটা সম্পূর্ণ করার জন্য গীতিকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাধিয়ে দিতেন তিনি। ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে নচিকেতা কলকাতা ছেড়ে বম্বে চলে যান সেখানকার চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য। সাত-আট বছর সেখানে থেকে ছয়ের দশকের শেষদিকে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন বাংলায়। এতবড় সঙ্গীতশিল্পী অবশ্য বম্বেতে খুব বেশি পসার জমাতে পারেননি। বম্বেতে অভিনেতা সঞ্জীবকুমারের সঙ্গে নিজের অফিস শেয়ার করতেন নচিকেতা।
বম্বে থেকে ফিরে এসে ১৯৬৯ সালে বাংলা সঙ্গীতের জগতে নচিকেতার একরকম দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছিল ‘শেষ থেকে শুরু’ সিনেমাটির মাধ্যমে। এই ছবিতে ‘বল হরি হরি বল’ গানটি নচিকেতা গাইয়েছিলেন কিশোর কুমারকে দিয়ে। নচিকেতার পরিচালনায় কিশোরকুমারের গাওয়া এটিই একমাত্র বাংলা গান। উত্তমকুমারের কন্ঠে দীর্ঘদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান গেয়েছিলেন এবং জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন। নচিকেতা ‘চিরদিনের’ ছবিতে উত্তমকুমারের জন্য মান্না দে-কে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন এবং তা মানুষের প্রশংসাও অর্জন করেছিল। নচিকেতা ঘোষ উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়াদেবীকে দিয়েও একটি গান গাইয়েছিলেন। গানটি ছিল ‘এই মনজোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’।
মানুষ হিসেবে খুবই খাদ্যরসিক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ । বাইরে থেকে গুরুগম্ভীর হলেও আসলে তাঁর মন ছিল খুবই কোমল এবং প্রকৃতপক্ষে একজন উদার মানুষ ছিলেন তিনি।
এত গুণী একজন সঙ্গীত পরিচালক হয়েও নচিকেতা সারা জীবনে বড় কোন পুরস্কার পাননি।
১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নচিকেতা ঘোষের মৃত্যু হয়।
One comment