সুরেলা কন্ঠের অধিকারী, ভারতের সর্বকালীন খ্যাতিসম্পন্ন গায়ক কিশোর কুমার সম্বন্ধে কোনও ভূমিকাই উপযুক্ত হবে না। বিখ্যাত গায়কের পাশাপাশি তিনি একজন সফল অভিনেতা, প্রযোজক, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর আসল নাম আভাষ কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। আভাষ কুমার গঙ্গোপাধ্যায় থেকে কিশোর কুমার। যাত্রাপথ খুব সহজ ছিল না। কিন্তু ওই যে বলে না অবলীলায় সবকিছুকে উড়িয়ে দেওয়া, যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাকে শুধু হাসি মজায় উড়িয়ে ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি।
১৯২৯ সালে আগস্টের ৪ তারিখে ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর খান্ডওয়ার এক ছোট গলির ছোট্ট বাড়িতে জন্ম কিশোর কুমারের। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা আইনজীবী শ্রী কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি। বড় ভাই ভারতের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম দিকপাল শ্রী কুমুদলাল গাঙ্গুলি (অশোক কুমার)। বলিউডের সবাই তাঁকে দাদামণি বলে ডাকতেন। বড় ভাই আর কিশোর কুমারের মাঝে বয়সের পার্থক্য ১৮ বছর।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর অন্যকে নকল করে দেখানোর শখ ছিল। সবার নকল করে বেড়াতেন তিনি। আর শখ ছিল ইওডেলিংয়ের, যেখানে বিভিন্ন পিচে সুর করে গাইতে হয়। ভারতে কিশোর কুমারই প্রথম ইওডেলিং আনেন।
ছোট বেলায় নাকি তাঁর গানের গলা ভাল ছিল না একদম। অশোক কুমার পরে বিভিন্ন জায়গায় বলেছিলেন, একবার কিশোর কুমার পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত পাওয়ার পর তিন-চার দিন নাকি তিনি শুধু কেঁদেছেন। সেই কান্নার পর তাঁর গলায় কী এক পরিবর্তন আসলো, গলায় সুর চলে আসলো, আওয়াজ পরিবর্তন হয়ে গেল। কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেই কয়েক দিনের কান্না অনেক যুগের কোটি মানুষের মনের খোরাক হয়ে চলে আসছে।
১৯৪৮ সালে প্রথম ‘জিদ্দি’ চলচ্চিত্রে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দের জন্য গান গেয়ে চলচ্চিত্র জগতে পদচারণা শুরু করেন। এরপর ১৯৫১ সালে ‘আন্দোলন’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের পর থেকে ‘নউকরি’, ‘নিউ দিল্লী’, ‘আশা’, ‘চালতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পড়োসান’, ‘ঝুমরু’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই গান গেয়েছেন শুধু নিজের জন্য। ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত তিনি হয় নিজের জন্য, না হয় দেব আনন্দের জন্য গেয়েছেন, অন্য কোনও অভিনেতার জন্য নয়। দেব আনন্দ আর রাজেশ খান্না—কিশোর–কম্মের দুই প্রচ্ছদ। এই দু’জনের ‘প্লে–ব্যাক’ ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িত কিশোরের সঙ্গীত কেরিয়ারের দুটি অধ্যায়ের উত্থান–বৃত্তান্ত। এবং কিশোর–গীতির আকাশে দুই ধ্রুবতারা বাবা ও ছেলে শচীনদেব বর্মন ও রাহুলদেব বর্মনের সঙ্গে কিশোরকুমারের সুরের পথে ‘জার্নি’র নানা অ্যাডভেঞ্চার–বৃত্তান্ত। আর একটা কথাও উল্লেখের, তা হল কিশোর–ইতিহাসে বম্বের দুই বাঙালি শশধর মুখার্জি (বা তাঁর ভাই সুবোধ মুখার্জি) আর শক্তি সামন্তের অবদান। যা এই ‘ভিনি–ভিসি–ভিডি’র সঙ্গে জড়িত।
তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘চালতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পড়োসান’– এখনো বিখ্যাত। গানগুলোর সবই প্রায় বিখ্যাত। গানগুলোর মধ্যে তাঁর হাস্যরসাত্মক কাণ্ডগুলো যে কাউকেই অভিভূত করবে। এ সময় অভিনয় করলেও তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সলীল চৌধুরী, এস ডি বর্মণ এর মতো বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকরা। এ সময়ে তাঁর বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে ছিল- ‘ছোটা সা ঘার হোগা বাদাল কি ছাও মে’ (নউকরি), ‘ইনা মিনা ডিকা’ (আশা), ‘নাখরে ওয়ালি’ (নিউ দিল্লী), ‘পাঁচ রুপিয়া বারা আনা’ ও ‘এক লাড়কি ভিগি ভাগি সি’ (চালতি কা নাম গাড়ি), ‘চিল চিল চিল্লাকে’ (হাফ টিকিট), ‘এক চাতুর নার’ ও ‘মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে’ (পড়োসান), ‘মেরি মেহবুব কেয়ামাত হোগি’ (মি. এক্স), ‘দুখি মন মেরে’ (ফানটুস) ইত্যাদি।
গুরু দত্ত মারা গেলেন ১৯৬৪ সালে। আর তার পরের বছর ‘ভূত বাংলো’ তৈরি হল তাঁর স্মৃতিকে উৎসর্গ গরে। এই ছবিই রাহুলদেব ও কিশোরকুমারের প্রথম রসায়ন। তার ফল কী হতে পারে, তার প্রমাণ ‘জাগো শোনেওয়ালো শুনো মেরি কাহানি।’ আবির্ভাবের আত্মঘোষণার এর থেকে যথোচিত বয়ান আর হতে পারে কি? ‘সি–মাইনর’–এ গাঁথা এক দুরন্ত অর্কেস্ট্রা। গানের ভেতর পর্দার বদলে–বদলে যাওয়াটা দারুণ সামলালেন কিশোর। বোঝা গেল তাঁর কম্মকে অন্যভাবে ব্যবহারের লোক এসে গেছে। কিন্তু পর্দার এই রসায়েন তখনও একজন আসতে বাকি। তিনি রাজেশ খান্না।
পাঁচের দশকের দেব–শচীন–কিশোর ত্রিভুজের পাল্টা ত্রিভুজ হিন্দি ছবিতে এল সাতের দশকের রাজেশ–রাহুল–কিশোর–এ। ঘুরপথে যার শুরু ১৯৬৯–এ। ‘আরাধনা’য়। এ ছবির ‘অফিসিয়াল’ সুরকার কিন্তু শচীনদেব বর্মনই। কিন্তু ছবির নেপথ্য–বৃত্তান্ত যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন কিশোরকুমারের যুগান্তকারী দুটি গানের সুরে রাহুলদেবের কী ভূমিকা ছিল।
‘মেরে স্বপনো কি রানি কব আয়েগি তু’র রেকর্ডিং–এ কিছুতেই ট্রেনের ছন্দ আর সুরটাকে মেলাতে পারছিলেন না শচীনদেব। সেদিন রেকর্ডিং প্রায় ‘ক্যানসেল’ করতে বসেছেন তিনি। সে সময় এগিয়ে এলেন পঞ্চম। মিউজিশিয়ান ভানু গুপ্তকে বললেন, গিটারে ‘রিদম্’ বাজাতে আর নিজে মাউথ অর্গানে চটপট একটা সুর বানিয়ে ফেললেন, যেটা এখন আমরা গানে শুনি। একইভাবে ‘রূপ তেরা মস্তানা’র জন্য একটা চিরাচরিত সুর বানিয়েছিলেন শচীনদেব। রাহুলদেব তার কিছুদিন আগেই কিশোরের মুখে একটা ছড়া–গান শুনেছিলেন ‘কালকে যাব শ্বশুরবাড়ি’ (এমন অনেক গান তখন কিশোর জলসায় মজা করে গাইতেন)। সেটাই তিনি কিশোরকে বললেন বাবার সামনে গাইতে। আর সেই সুরটাই একটু বদলে হয়ে উঠল ‘রূপ তেরা মস্তানা’।
তিনি শুধু যে হিন্দি গান গেয়েছেন, তা কিন্তু নয়। বাংলা গানও গেয়েছেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্য গেয়েছেন তিনি অনেক গান। ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চির দিনের সাথী’, ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’, ‘যদি হই চোর কাঁটা’, ‘এই তো জীবন’, ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি। তাঁর চারুলতাতে ‘আমি চিনিগো চিনি তোমারে’ গানটি গেয়েছিলেন। আবার তাঁর ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রেও গান করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের মতে, কিশোর কুমারের গানের গলা চলচ্চিত্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোতাবেক দৃশ্যে মানিয়ে যায়।
বাংলা গানের ঐতিহ্যে ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ একটা ধাক্কা ছিল। প্রথমে যিনি শুনবেন তাঁর এই গানকে মনে হবে ‘বিশৃঙ্খলা’র চূড়ান্ত। তাল, লয়, মেলোডি সব ঘেঁটেঘুটে দিচ্ছে! যেন এক মূর্তিমান কালাপাহাড়! কিন্তু ভাল করে শুনলে বোঝা যাবে, এ গানের ভিত্তি আসলে চূড়ান্ত শৃঙ্খলাময় এক ব্যান্ডের তাল। একেবার মিলিটারি ব্যান্ড। তার এক–দুই–তিন/এক–দুই–তিন–চার ছকে গাঁথা ‘রিদম’–এ পা ফেলেই তালে তালে গান এগোচ্ছে। সেভাবেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরটা তৈরি করেছেন। অথচ এমনভাবে কিশোরকুমার গাইছেন যে শুনলে মনে হবে ‘বিশৃঙ্খলা’র চূড়ান্ত! এই যে ‘ইলিউশান’টা, এটা পুরোটাই তৈরি করছে কিন্তু কিশোরকুমারের গায়কি!
বহু ছবি ছেড়েছেন। বহু ছবি অর্ধসমাপ্ত থেকেছে। তবু তাঁরই ভেতর ছেড়ে দেওয়া তিনটি ছবি ইতিহাস হতে পারত। তাঁদের কথা তাই আলাদা করে বলতেই হয়। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দ’ ছবির নাম–চরিত্রের জন্য ভেবেছিলেন কিশোরকুমারকে। সেই মর্মে ‘পাবলিসিটি’ও শুরু হয়েছিল। অভিনয় করবেন। গানও গাইবেন। শেষমেশ পিছিয়ে গেলেন কিশোর। অদ্ভুত কিছু শর্ত আরোপ করলেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল কিশোরের। রুমাদেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে তা পরিণত হয়েছিল পারিবারিক বৈবাহিক সম্পর্কে। ‘পথের পাঁচালী’র জন্য অর্থ সাহায্যও করেছিলেন একটা পর্বে। অথচ এই সত্যজিতের ছবিতেই অন্তত দুবার অভিনয়ের প্রস্তাব ছেড়ে দেন কিশোর। প্রথমবার ‘পরশপাথর’–এ। সম্ভবত পরেশবাবুর যুবক সেক্রেটারির চরিত্রে কিশোরকে ভাবেন সত্যজিৎ। আর পরেরবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’–এ। সত্যজিতের ভাবনায় প্রথম ‘গুপী’ ছিলেন কিশোরই। গানে। এবং অভিনয়েও।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। যেমন বিয়ে করেছেন চারবার, প্রত্যেকেই চলচ্চিত্র জগতের নামকরা শিল্পী – রুমা গুহঠাকুরতা (১৯৫০-৫৮), মধুবালা (১৯৬০-৬৯), যোগিতা বালি (১৯৭৬-৭৮), লীনা চন্দবরকর (১৯৮০-৮৭)। শোনা যায় মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সঙ্গীত শিল্পী অমিত কুমার তাঁর ও রুমা দেবীর সন্তান এবং সুমিত কুমার তাঁর ও লীনা দেবীর সন্তান। ‘No pay no work’ নীতিতে চলে অনেক গান, সিনেমা ছেড়েছেন আবার অনেক গান বিনা পারিশ্রমিকেও করেছেন বা সিনেমার জন্য নিঃশর্তে টাকা দিয়েছেন। তাঁর খামখেয়ালী স্বভাবের জন্য অনেকেই তাঁকে পাগল বলেছেন, অবশ্য জিনিয়াসরা কমবেশি পাগল হয়েই থাকেন – তিনিও একজন ‘একসেন্ট্রিক জিনিয়াস’।
১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান এই মহান শিল্পী। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি গান রেকর্ড করেছিলেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর গান এখনো রয়ে গেছে, তাঁর সুরেলা কণ্ঠ এখনও রয়ে গেছে। নতুন কোনো সঙ্গীত পরিচালক যখন কোনো গানে সুর দেন, সুর দেওয়ার পর এখনও অনেকে আফসোস করে বলেন, যদি তাঁর সেই গানটি কিশোর কুমার গাইতেন! কিশোর কুমার বেঁচে থাকবেন আজীবন সবার মনে, শুধু তাঁর গাওয়া গানগুলো দিয়ে।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/wiki/Kishore_Kumar
- https://roar.media/bangla/main/biography/kishore-kumar-whose-will-never-be-old-in-thousand-years/
- Kishore Kumar: An Authorised Biography by Kishore Valicha, Viking (১৯৯৮)।
- Composer Kishore Kumar by Kamal Dhiman, Nikita Publications (২০১৭)।
- ২রা আগস্ট ২০১৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী দেবপ্রসাদ মুখার্জি'র লিখিত প্রবন্ধ।
- আজকাল পত্রিকা, ৪ঠা আগস্ট ২০১৮ সাল।
3 comments