ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাঁটলে বিস্মৃতপ্রায় অথচ নির্ভীক, পরাক্রমী বহু বিপ্লবীর সন্ধান মিলবে যাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছাড়া হয়ত স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ কঠিন ছিল। সেই তালিকায় প্রায় উপরের দিকেই স্থান পাবেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল (Sachindranath Sanyal)। মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গঠনের উদ্দেশ্যে নির্মিত ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই তিনি পরিচিত অনেকের কাছে। চন্দ্রশেখর আজাদ এবং ভগত সিংয়ের মতো ইতিহাসখ্যাত বিপ্লবীরাও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধীজির অহিংস রাজনৈতিক পন্থায় বিশ্বাস ছিল না শচীন্দ্রনাথের। রাসবিহারী বসুর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি। গদর ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কারণে আন্দামানে কারাবাস করতে হয়েছিল তাঁকে। এছাড়াও বিখ্যাত কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যও জেলযাপন করেছিলেন তিনি৷ রাসবিহারী যখন জাপানে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তখন ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সবচেয়ে প্রবীণ নেতা ছিলেন শচীন্দ্রনাথ। দিল্লি ষড়যন্ত্রের সময় লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর এই শচীন্দ্রই হামলা চালান, সঙ্গী ছিলেন সেই রাসবিহারী। মওলানা শওকত আলী শচীন্দ্রনাথকে অস্ত্রও সরবরাহ করেছিলেন এই হামলার জন্য। নিজের জেলজীবন নিয়ে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।
১৮৯৩ সালের ৩ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত উত্তরপ্রদেশের বারাণসী শহরের উত্তর-পশ্চিমে এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম হরিনাথ সান্যাল (Harinath Sanyal) এবং মায়ের নাম ক্ষীরোদবাসিনী দেবী (Kherod Vasini Devi)। তাঁর কিছু খুড়তুতো ভাইও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরিবারে একটি ব্রিটিশ-বিরোধী আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলেন শচীন্দ্রনাথ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে বিপ্লব সম্পর্কে একটা ধারণা এবং সেই সংক্রান্ত এক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠতে শুরু করেছিল।
বারাণসীতেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শুরু হয়েছিল তাঁর। তিনি বারাণসীর বাঙালিটোলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন৷ কিন্তু তাঁর যখন কৈশোরকাল, তখনই বাংলা জুড়ে ব্রিটিশরাজের জঘন্য বিভাজন নীতির কারণে বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছিল চারদিক। মিছিল, স্লোগান, নানারকম কর্মসূচী তখন রাস্তায় রাস্তায়। ব্রিটিশের রাজধানী কলকাতা তখন হয়ে উঠছিল বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু। বারাণসী থেকেও সেই আঁচ তিনি পেয়েছিলেন বলেই মনে হয়। তাছাড়া কেবল বাংলা নয়, সারা ভারতেরই নানা প্রান্তে তখন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে সদ্য জাগ্রত ভারতবাসী। সেই অগ্নিময় পরিস্থতিতে শচীন্দ্রনাথের মতো মানুষের পক্ষে অবিচলিত চিত্তে শান্ত হয়ে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। কলকাতায় এসে ১৯০৭ সালে তিনি কলকাতার গুপ্ত বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। ১৯১৩ সালে পাটনাতে বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ব্রিটিশ-বিরোধী সহিংস বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র একটি শাখা নির্মাণ করেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল।
বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যাওয়ার পর ১৯১২ সালে দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল এবং রাসবিহারী বসু তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে দিল্লির নতুন রাজধানীতে প্রবেশের সময়ে বোমা নিক্ষেপ করে আক্রমণ করেছিলেন। হার্ডিঞ্জ অবশ্য আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যান কিন্তু সেই আক্রমণে লেডি হার্ডিঞ্জের মৃত্যু হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তপ্রদেশের বিপ্লবী কর্মী নগেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে গিরিজাবাবুর মতো শচীন্দ্রনাথও রাসবিহারী বসুর সহকারী হিসেবে ভারতীয় সৈন্যদলের, বিশেষ করে সপ্তম রাজপুত রেজিমেন্টের সাহায্যে ব্রিটিশ সরকারের উচ্ছেদের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
গদর ষড়যন্ত্রের সময়ে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। এই ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহ মূলত ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং ভারত থেকে ব্রিটিশকে সমূলে উৎখাত করা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনার শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গদর পার্টি, জার্মানিতে ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বার্লিন কমিটি এবং ভারতীয় গুপ্ত বিপ্লবীদের মধ্যে এই বিদ্রোহের উদ্ভব ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার পাঞ্জাবি সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই পরিকল্পনার বিশিষ্ট অংশগ্রহণকারী ছিলেন। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সারা ভারতব্যাপী বিদ্রোহ শুরু করার জন্য ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে যেসব হিন্দু-জার্মান বিদ্রোহের পরিকল্পনা হয়েছিল, তার মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। পাঞ্জাব থেকে বিদ্রোহ শুরুর পরিকল্পনা হয়েছিল৷ ১৯১৫ সালে গদর দলের উদ্যোগে সমগ্র ভারতব্যাপী এই ব্রিটিশ-বিরোধী যে কার্যকলাপ শুরু হয়, তা গদর ষড়যন্ত্র বা গদর বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সেসময় ইংরেজ-বিরোধী বিদ্রোহ শুরু করার জন্য প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভারতে পাচার হবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে গোয়েন্দাদের তথ্য, গুপ্তচরের খবরে ব্রিটিশরা আন্দোলনের হাওয়া টের পেয়ে গিয়েছিল ফলত ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশরা আন্দোলন দমনের কাজ শুরু করে। বিদ্রোহের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং ভারতের অভ্যন্তরের নানা ছোট ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও চূর্ণ করে ব্রিটিশ। এসময় লাহোর ও বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হন এবং ইংরেজদের থেকে বাঁচতে এবং স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভূগর্ভে আত্মগোপন করে থাকেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। যদিও শেষরক্ষা হয়নি, তিনি ধরা পড়েন এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের সেলুলার জেলে তাঁকে কারাবন্দি করে রাখা হয়। সেই সেখানকার জীবন নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বন্দী জীবন’ নামে একটি গ্রন্থ। কারাগারে অসহ্য অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু এতসব অত্যাচার, অনাচার স্বাধীনতার জন্য লড়াইতে এতটুকু হতোদ্যম করে দেয়নি তাঁকে।
যখন অল্প সময়ের জন্য একটু মুক্তি পেয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, তখন পুনরায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রস্তুতি শুরু করার ফলে পুনর্বার তাঁকে জেলে ফেরত পাঠানো হয়। অবশেষে ১৯২০ সালে মুক্তি পান। রামপ্রসাদ বিসমিল সহ প্রথিতযশা সব বিপ্লবীদের নিয়ে তিনি ১৯২৪ সালের অক্টোবরে গঠন করেন ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি’। এটি ১৯২৮ সালের পরে ‘হিন্দুস্থান স্যোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে পরিচিত হয়। তিনি ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি’র একটি ইশতেহার ‘দ্য রেভল্যুশনারি’ রচনা করেছিলেন যেটি ১৯২৫ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর ভারতের বড় শহরগুলিতে বিতরণ করা হয়েছিল।
১৯২০ থেকে ১৯২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে শচীন্দ্রনাথের মতাদর্শগত বিরোধ ও বিতর্ক ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিল। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের পথে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পথকে বিশ্বাস করতে পারেননি শচীন্দ্রনাথ। ভারতকে মুক্ত করতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের শক্তি ও সামর্থ্যের প্রদর্শন প্রয়োজনীয় ছিল বলেই মনে করতেন তিনি। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’তে প্রকাশিত এই বিতর্ক তৎকালীন সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নিজে তিনি হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাঁর অনুগামী অনেকেই মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন, ফলে কোনও ধর্মে তাঁদের বিশ্বাস ছিল না।
১৯২৫ সালে বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টায় তিনি গ্রেপ্তার হন এবং দু’বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। শচীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা এবং ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি অর্জনের উপায় সারা দেশের যুবকদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদদের মতো বিপ্লবীরাও ব্রিটিশ শক্তির মোকাবিলা করার জন্য তাঁর পন্থায় বিশ্বাস রেখেছিলেন, তাঁর উপদেশ গ্রহণ করেছিলেন। ভগত সিং তাঁর গ্রন্থ ‘হোয়াই আই অ্যাম অ্যান অ্যাথেইস্ট’ গ্রন্থে শচীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষ শচীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। এমনকি কংগ্রেস সমর্থক মৌলানা শওকত আলী, কৃষ্ণকান্ত মালব্য প্রমুখ ব্যক্তি তাঁকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন।
১৯৪২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গোরক্ষপুরের জেলে থাকার সময়েই শচীন্দ্রনাথ সান্যালের মৃত্যু হয়।
শচীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি লক্ষ্ণৌয়ের কাছে কাকোরি নামক গ্রামে ব্রিটিশদের ট্রেন লুঠ করবার পরিকল্পনা করেছিল। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল এবং আসফাক্উল্লাহ খান। ব্রিটিশ সরকারের কোষাগার লুঠ করার এই পরিকল্পনা ‘কাকোরি ষড়যন্ত্র‘ নামে খ্যাত। কাকোরিতে ট্রেন থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রায় ৮০০০ টাকা লুঠ করা হয়েছিল। এই লুঠ অভিযানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯২৭ সালে পুনরায় শচীন্দ্রনাথকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দিয়ে আন্দামানের জেলে বন্দি করা হয়। বারাণসীতে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। ১৯৩৭ সালে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু জাপানের সাহায্যে ভারতকে মুক্ত করার ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহে পুনরায় ১৯৪১ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলে থাকাকালীন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন তিনি। সুভাষচন্দ্র যখন জাপানে পালিয়ে যান তখন ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের সবচেয়ে প্রবীণ নেতা ছিলেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। আন্দোলনের তরুণ সদস্যরা তাঁর পরামর্শ মেনেই কাজ করতেন তখন। আজীবন স্বাধীনতার লড়াই লড়ে যাওয়া এই মানুষটি বহু প্রবন্ধসহ রচনা করেছেন বেশ কিছু গ্রন্থ। তাঁর ‘বন্দী জীবন’ বইটি তো অনেক বিপ্লবীকে অনুপ্রেরণাও জুগিয়েছিল। তাছাড়া ‘অগ্রগামী’ নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। জেলে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সরকার তাঁকে আন্দামান থেকে মুক্ত করে দেয় এবং গোরক্ষপুরের কারাগারে স্থানান্তরিত করে।