ভগত সিং একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ভিতরে বটুকেশ্বর দত্তের সাথে বোমা নিক্ষেপ ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অতুলনীয় অবদানের কারণে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন।
১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের বাঙ্গা গ্রামে একটি জাঠ পরিবারে ভগত সিংয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম কিষান সিং এবং মায়ের নাম বিদ্যাবতী সিং। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক উচ্চবিদ্যালয়ে যা তখন আর্য সমাজের দ্বারা পরিচালিত হত। পরে তিনি লাহোর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর পরিবার রাজনৈতিকভাবে খুবই সক্রিয় ছিল। সেই কারণেই তাঁকে কোন ব্রিটিশ পরিচালিত বিদ্যালয়ে না ভর্তি করে এই বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। এই বিদ্যালয়ে থেকে পাওয়া শিক্ষা ভগতের পরবর্তী জীবনে বিশেষ ছাপ ফেলেছিল। ভগতের বাবা এবং কাকারা সবাই স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এমনকি যখন ভগতের জন্ম হয় তখন তাঁর বাবা জেলবন্দী ছিলেন।
চোদ্দ বছর বয়স থেকেই ভগত সিং স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। এই বয়সেই তিনি সাধারণ মানুষের উপর ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করেন। নানখানা সাহিব গুরুদ্বারে ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা নিহত নিরীহ ভারতবাসীর জন্য তিনি গর্জে ওঠেন। তিনি যখন ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছেন ঠিক সেই সময় ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর প্রভাব বিস্তারিত হচ্ছে। তরুণ ভগত গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের সাথে একমত হলেন না। তিনি সশস্ত্র আন্দোলনকেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলেন।
১৯২৩ সালে তিনি যখন লাহোরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তখন তাঁর জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃতি লাভ করল। এই সময় কলেজের নাট্য দলে তিনি যোগ দেন। এছাড়াও তিনি এই সময় পাঞ্জাবের সমস্যার উপর প্রবন্ধ লিখে একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। তিনি সাহিত্য পাঠ করতে ভালবাসতেন, তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন মহম্মদ ইকবাল। যুব ইতালীয় আন্দোলনের (Young Italy Movement) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় তরুণদের নিয়ে একটি দল গড়ে তুললেন। এই দলটির নাম দিলেন ‘নওজোয়ান ভারত সভা’। এছাড়াও তিনি হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (Hindusthan Republican Association) নামক একটি দলে যোগদান করেন। এই দলটিতে সেই সময়ের অনেক নামকরা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছিলেন যেমন চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকাল্লাহ খান ও আরও অনেকে। একবছর বাদেই তাঁর পরিবার তাঁর বিয়ে ঠিক করে। এই বিয়ে আটকানোর জন্য ভগত চাওনপুরে পালিয়ে যান। এই পলায়নের কারণ হিসাবে পরে ভগত বলেন যে তাঁর জীবন তিনি দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, তাই আর সংসার করার কোন ইচ্ছাই তাঁর ছিল না।
১৯২৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যোগাযোগের জন্য পুলিশ ভগত সিংকে আটক করে। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯২৬ সালের লাহোরে একটি বোমা বিস্ফোরণের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। পাঁচ সপ্তাহ বাদে তাঁকে টাকার বিনিময়ে জামিন দেওয়া হয়। ভগত সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। এছাড়াও তিনি উর্দু এবং পাঞ্জাবি কিছু সংবাদপত্র সম্পাদনা করতেন যা অমৃতসর থেকে প্রকাশিত হত। তিনি মাঝেমধ্যেই বাল বলওয়ান্ত, রঞ্জিত এবং বিদ্রোহী ছদ্মনামে লিখতেন।
১৯২৮ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা তৈরি করা সাইমন কমিশনের বিরোধিতায় লাহোরে একটি বড় প্রতিবাদ মিছিল হয়। সেই মিছিলেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বনামধন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়। কিন্তু পুলিশের আক্রমণে লালা লাজপত গুরুতরভাবে আহত হন এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। মনে করা হয় যে পুলিশের দ্বারা আহত হওয়ার কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়। মিছিলের উপর লাঠি চার্জ করার আদেশ দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার জেমস স্কট। কিন্তু ব্রিটিশ আদালত এ বিষয়টি অস্বীকার করে। লালা লাজপত রায়ের অনুগামীদের মধ্যে ভগতও ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন যে এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবেন। তাঁর সাথে চন্দ্রশেখর আজাদ, রাজগুরু এবং শুকদেব থাপারও যোগ দেন। কিন্তু ভুলবশত তাঁরা স্কটের বদলে অ্যাসিট্যান্ট পুলিশ সুপার স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর ভগতকে ছদ্মবেশে লাহোর ছেড়ে লক্ষ্ণৌ হয়ে হাওড়ায় পালিয়ে আসতে হয়।
একটা সময় ভগত নাটকের মাধ্যমে জনতার মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করেছিলেন। এরপর তিনি সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির (Central Legislative Assembly) ভিতরে বোমা নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর পিছনে মূল কারণ ছিল পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। যদিও তাঁর দল প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু পরে তাঁকে এই কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। পরিকল্পনা মতো ৮ এপ্রিল ১৯২৯ সালে বটুকেশ্বর দত্তের সাথে ভগত অ্যাসেম্বলির ভেতর অধিবেশন চলাকালীন দুটি বোমা ছোঁড়েন। এই বোমা ছোঁড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবাদ করা, কাউকে হত্যা করা নয়। সেই মতো বেশ কিছু কাউন্সিলের সদস্য আহতও হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বোমা দুটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে তা নিক্ষেপ করার পর এত ধোঁয়া বেরোবে যে অ্যাসেম্বলির চারিদিক ভরে যাবে, আর সেই ফাঁকে তাঁরা দুজন পালাতে পারবেন। কিন্তু ভগত পালালেন না। সেখানেই দাঁড়িয়ে “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” বলে স্লোগান দিতে লাগলেন। এরপর তাঁরা দুজন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হলেও পরে গ্রেপ্তারের সময় পিস্তল পাওয়া যাওয়ার অপরাধে ভগতকে ফাঁসি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এই সময় সাহারানপুর পুলিশ ভগতের দলের বোমা বানানোর ঘাঁটি আবিষ্কার করে। তাঁদের দলের অনেকেই ধরা পড়েন। ভগতসহ রাজগুরু, সুখদেব এবং আরও ২১ জনকে বোমার দ্বারা ব্রিটিশ পুলিশ হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়। ভগতের বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়। নতুন অভিযোগের শুনানি পর্যন্ত তাঁর ফাঁসির আদেশ স্থগিত রাখা হয়। জেলখানায় ভগত দেখেন ইউরোপীয় কারাবন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হলেও ভারতীয় বন্দীদের সাথে অসম ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরোপীয় বন্দীরা অনেক সুযোগ সুবিধা পেলেও ভারতীয়রা বঞ্চিত হচ্ছে। ভগত এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। এরপর তিনি এবং তাঁর সহ বন্দীরা আমরণ অনশন শুরু করেন। এর ফলে তিনি সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের বিপুল সমর্থন পান। এইসময় জহরলাল নেহেরু ভগত এবং তাঁর সহবন্দীদের সাথে জেলখানায় দেখা করতে আসেন। মহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁদের সমর্থন করেন। সরকার এই অনশন ভেঙে দিতে চাইলেও অসমর্থ হয়। এই কারণেই সরকার তাঁদের শুনানির দ্রুত ব্যবস্থা করে। এই শুনানি লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (Lahore Conspiracy Case) নামে বিখ্যাত।
তাঁদের বিরুদ্ধে আরও নানান মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। কংগ্রেস পার্টি এবং বাবার পরামর্শে ভগত অনশন থেকে বিরত হন। এরপর ভগতের জন্য আদালত বিশেষ বিচারের ব্যবস্থা করে। ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগত সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। অবশেষে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসির পর এই তিন শহিদের মৃত দেহ জেলের পেছনের দেওয়াল ভেঙ্গে তৎকালীন লাহোরের (বর্তমান পঞ্জাবের) ফিরজপুর জেলার হুসেনিওয়ালা গ্রামে তাঁদের দাহ করা হয় এবং শতদ্রু নদীর জলে তাঁদের ভস্ম ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে এই হুসেনিওয়ালা গ্রামে এই তিন বীর শহিদের স্মৃতিতে ২০১৬ সাল থেকে অমর জ্যোতি স্থাপন করা হয়। ভগত সিংয়ের স্মৃতিসৌধটি ভারতের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি নিবেদিত।
6 comments