রামপ্রসাদ বিসমিল

রামপ্রসাদ বিসমিল

রামপ্রসাদ বিসমিল (Ramprasad Bismil) ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৫) অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী কার্যকলাপের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন স্বদেশপ্রেমী কবি। হিন্দি এবং উর্দুতে তাঁর বহু কবিতা রয়েছে। তিনি রাম, আগত, বিসমিল ইত্যাদি ছদ্মনামে বহু কবিতা লিখেছেন। 

১৮৯৭‌ সালের ১১ জুন ব্রিটিশ অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম রাজ্যের শাহজাহানপুর অঞ্চলে জন্ম হয় রামপ্রসাদ বিসমিলের। তিনি বাবার কাছ থেকে হিন্দি শিখেছিলেন এবং মৌলবীর কাছ থেকে উর্দু শিখেছিলেন। বাবার অমত সত্বেও তিনি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি শাহজাহানপুরের ‘আর্য সমাজ’- এ যোগদান করেন এবং নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করতেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ভাই পরমানন্দের ফাঁসির আদেশ পাঠ করেন।  এই ঘটনা তাঁর মধ্যে দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটায়। পরবর্তীকালে তিনি স্কুল ছেড়ে কয়েকজন বন্ধুর সাথে লখনৌ চলে আসেন। বিসমিল ‘মাতৃভেদী’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন  তৈরি করেছিলেন। স্বামী সোমদেব গেন্দা লাল দীক্ষিতের সাথে তাঁর পরিচয় করে দিয়েছিলেন যাতে তিনি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাহায্যে লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। দীক্ষিতের সঙ্গে কিছু পরাক্রমশালী ডাকাতের যোগাযোগ ছিল।  দীক্ষিত চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান গড়ে তুলতে। দীক্ষিত, বিসমিলসহ তরুণদের নিয়ে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেন যার নাম দেন ‘শিবাজী সমিতি’। এই দল উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় তরুণদের সংগঠিত করতে থাকে। ১৯১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি বিসমিল একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে, যার নাম ছিল ‘দেশবাসীয়োকে নাম সন্দেশ’। তাঁর রচিত কবিতা ‘মেনপুরী কি প্রতিজ্ঞা’- র সঙ্গে প্রচারপত্রটি বিতরণ করা হয়। দলের তহবিলে টাকা সংগ্রহের জন্য ১৯১৮ সালে তিনবার ডাকাতি করেন তাঁরা। এছাড়াও ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ বইপত্র তাঁরা বিক্রি করতে থাকে দিল্লি কংগ্রেসের হয়ে। পুলিশি তৎপরতার দরুন  বিক্রি না হওয়া বইগুলো নিয়ে বিসমিল পালিয়ে যান। দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার পথে পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে এবং দু তরফ থেকেই গুলি চলতে শুরু করে। এই অবস্থায় তিনি যমুনা নদীতে ঝাঁপ দেন এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ডুব সাঁতার কেটে পালিয়ে যান। পুলিশ অনুমান করে যে, তিনি  মারা গেছেন। দীক্ষিত এবং অন্যান্য সদস্যরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁদেরকে আগ্রা ফোর্টে  নিয়ে যাওয়া হয়। দীক্ষিত পরবর্তীকালে দিল্লিতে পালিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন। দীক্ষিতের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস ফাইল করা হয়। এই ঘটনাটি ‘মেনপুরী ষড়যন্ত্র’ (Mainpuri Conspiracy) নামে খ্যাত। এই মামলায় দীক্ষিত এবং বিসমিল পলাতক হিসেবে ঘোষিত হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯১৯ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত  বিসমিল উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন গ্রামে লুকিয়ে থাকেন এবং বিভিন্ন বই প্রকাশ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে ‘সুশীলমালা’ নামক সিরিজে তাঁর এই সমস্ত বই প্রকাশিত হয়।

১৯২০ সালে মেনপুরী ষড়যন্ত্র মামলার সমস্ত বন্দিরা মুক্তি পেলে তিনি শাহজাহানপুরে ফিরে আসেন। ১৯২১ সালে তিনি আমেদাবাদ কংগ্রেসে যোগদান করেন। এরপর তিনি শাহজাহানপুরে ফিরে এসে পূর্ণ স্বরাজ গঠনের উদ্দেশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চৌরিচৌরার ঘটনায় ক্ষুব্ধ জনতা চৌরিচৌরা পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে এবং ২২ জন পুলিশকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়। গান্ধীজী এই ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ করে অসহযোগ আন্দোলন তুলে নেওয়ার কথা  ঘোষণা করেন। বিসমিল ও তাঁর তরুণ অনুগামীরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। রামপ্রসাদ বিসমিল মনে করতেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভ সম্ভব। বিসমিল তরুণদের নিয়ে একটি নতুন দল গঠন করেন। নাম দেন ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (Hindustan Republican Association)। এই সময় বাংলা দেশের বাইরে বিহার, রাজস্থান, বোম্বাই এবং মাদ্রাজে বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যকলাপ হতে থাকে। বাংলার বাইরে বিপ্লবীদের যে সকল সংস্থা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশে গঠিত ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। সশস্ত্র বিপ্লবের দ্বারা ভারতে একটি স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’-এর লক্ষ্য। ১৯২৩ সালে ভগৎ সিং এই সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করেন। রামপ্রসাদ বিসমিলের নেতৃত্বে বিপ্লবী দল কাকোরির কাছে ট্রেনে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করে। দলের দশজন সদস্য এই অভিযানে সামিল হয়। উত্তরপ্রদেশের লখনৌ-এর কাছে কাকোরিতে সরকারি তহবিল সমেত ট্রেনে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে এই দশজন সদস্য। এই অভিযানে জার্মান পিস্তল ‘মাউজার আর সি ৯৬’ (Mouser RC 96) ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট সংঘটিত এই রেল ডাকাতিকে কেন্দ্র করে ‘কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ি, শচীন সান্যাল, মন্মথ গুপ্ত, প্রণবেশ ভট্টাচার্য, আসফাকউল্লা খান প্রমুখ। ১৮ মাস ধরে বিচারপর্ব চলেছিল। বিচারে এঁদের অধিকাংশের যাবজ্জীবন, দ্বীপান্তর অথবা সশ্রম কারাদন্ড হয়। রামপ্রসাদ বিসমিল ও অপর তিন সহযোগীর (আসফাকউল্লা খান, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ি, রোশন সিং) ফাঁসি হয়। ১৯২৭ সালে ১৯ ডিসেম্বর গোরক্ষপুর জেলে রামপ্রসাদ বিসমিল – এর ফাঁসি হয়। তাঁর দেহ রাপ্তী নদীর তীরে দাহ করা হয়। বর্তমানে এই জায়গাটি রাজঘাট নামে পরিচিত।

তাঁর মৃত্যুর পর স্বাধীন ভারতে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে শাহজাহানপুরে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপিত হয় এবং শাহজাহানপুর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ‘রামপ্রসাদ বিসমিল রেলওয় স্টেশন’ তৈরি হয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার  রামপ্রসাদ বিসমিলের নামে রামপুর জাগির গ্রামে একটি উদ্যান তৈরি করেছে সম্প্রতি।  মেনপুরী ষড়যন্ত্র মামলার সময় এই গ্রামেই বিসমিল আত্মগোপন করেছিলেন। এছাড়া তাঁর জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে ১৯৯৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে।

তিনি ‘ক্যাথেরিন’ (Catherine) বইটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন এবং বাংলা থেকে অনুবাদ করেছিলেন ‘বলশেভিকো কি কার্তুত’ (bolshevikon ki Kartoot)। তিনি একটি আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন, যা তাঁর মৃত্যুর পর গণেশ শংকর বিদ্যার্থীর ‘কাকোরি কি শহীদ’ বইটির অন্তর্গত হয়।

4 comments

আপনার মতামত জানান