ভারতীয় গণিতচর্চার জগতে বীজগণিতে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন গণিতবিদ রামন পরিমালা (Raman Parimala)। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে গণিতচর্চার জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তি কেবল পুরুষরাই ছিলেন, একমাত্র বিংশ শতাব্দীতে এসে এই রীতি বা ধারা ভেঙে দিয়ে একজন মহিলা গণিতবিদ হিসেবে ভারতের গণিতচর্চার জগতে স্বীকৃতি পান তিনি। মুম্বাইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এ অধ্যাপনা করেছেন রামন। ২০১৯ সাল থেকে ‘ইনফোসিস’ পুরস্কারের জন্য ম্যাথমেটিকাল সায়েন্স জুরি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি। ১৯৮৭ সালে শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে ভূষিত হন রামন পরিমালা।
১৯৪৮ সালের ২১ নভেম্বর তামিলনাড়ুর নাগাপাত্তিনাম জেলার মায়িলাদুত্থুরাই শহরে এক শিক্ষিত প্রগতিশীল পরিবারে রামন পরিমালার জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় একজন ইংরেজির অধ্যাপক এবং তাঁর মা সমগ্র পরিবারের কাছে একটা অবলম্বন ছিলেন। তাঁর বাবা রামনকে সবসময় নিজের ইচ্ছা, স্বপ্ন পূরণের দিকে উৎসাহী করে তুলতেন।
মাদ্রাজের শারদা বিদ্যালয় গার্লস হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন রামন পরিমালা । খুব ছোট বয়স থেকেই গণিতের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। ফলে সেই সময় থেকেই তিনি গণিত বিষয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। হাই স্কুলে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে এই ইচ্ছার কথা তিনি তাঁর বাবাকে জানান। যে সময় মহিলারা শিক্ষকতা বা চিকিৎসা বিভাগ ছাড়া অন্য স্তরে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতেই পারতেন না, সামাজিক চাপের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের এগিয়ে আসাটা দুষ্কর ছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রামন পরিমালার বাবা সম্পূর্ণরূপে রামনকে আগ্রহ জুগিয়েছিলেন এবং পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপরে স্টেলা মেরিস কলেজে ভর্তি হন রামন বিএস.সি ডিগ্রি লাভ করার জন্য। এই কলেজে এসেই প্রভূত শিক্ষালাভ করেন রামন, তাঁর জ্ঞানের সমস্ত জানালা খুলে যায় এই প্রতিষ্ঠানে এসে। ১৯৭০ সালে স্টেলা মেরিস কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ঐ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করার কথা ভাবলেন রামন পরিমালা। তাঁর অন্যান্য অগ্রণী সহপাঠীরাও একইভাবে সেই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানেরই অন্য এক অধ্যাপিকা মিস থাঙ্গামান্নি এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করেন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে রামনকে যাতে না নেওয়া হয় সে ব্যাপারে আবেদন করেন। তিনি আসলে চেয়েছিলেন বাঁধাধরা চাকরির পরিবর্তে রামন তাঁর প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আরও বড় কিছু করুক। ফলে মাদ্রাজে থাকার ইচ্ছায় মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রামানুজন ইনস্টিটিউটে গবেষণাকর্মে যুক্ত হন রামন পরিমালা। এক বছর সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মুম্বাইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এ অধ্যাপক শ্রীধরনের গবেষণাগারে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে রামন পরিমালা পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল – ‘প্রোজেক্টিভ মডিউলস ওভার পলিনমিয়াল রিংস ওভার ডিসিশন রিংস’ (Projective Modules Over Polynomial Rings Decision Rings)। গবেষণা শেষ করার পরেই টাটা রিসার্চ সেন্টারে অধ্যাপনা করার সুযোগ পান রামন। কিন্তু ঐ সময়েই তাঁর বিবাহ নির্ধারিত হওয়ায়, সেন্টার থেকে ছুটি নেন রামন। তাঁর স্বামীর সঙ্গে তাঞ্জানিয়ায় দার-এস-সালামে চলে আসেন রামন পরিমালা। এখানে ‘বোর্ড অফ ইন্টারন্যাল ট্রেড’-এর চিফ ইন্টারনাল অডিটর পদে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। রামনের স্বামী তাঁর কেরিয়ারের ব্যাপারে গৃহীত সব ধরনের সিদ্ধান্তেই সম্মতি জানাতেন। কিন্তু তিনি যখন বুঝতে পারছিলেন তাঞ্জানিয়ায় রামনের জন্য উপযুক্ত কোন কেরিয়ার গড়ার সম্ভাবনা নেই, তিনি নিজের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে রামনের সঙ্গে যেতে সম্মত হন। এরপরে রামন পরিমালা পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করার জন্য সুইজারল্যাণ্ডের জুরিখে অবস্থিত লুসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে শুরু করেন। এই সময় তাঁর স্বামীও তাঁর সঙ্গে আসেন। গণিতচর্চার জগতে এই সময়টাই রামনের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রামন পুনরায় টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ ফিরে আসেন গবেষণার জন্য এবং তার পাশাপাশি অধ্যাপক হিসেবেও নিযুক্ত হন তিনি। বহু বছর গবেষণার পরে ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার জর্জিয়ায় অবস্থিত এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এর পিছনে পেশাগত এবং ব্যক্তিগত দুই ধরনের কারণই ছিল। একদিকে তিনি চেয়েছিলেন নিউ ইয়র্কে পাঠরত তাঁর ছেলে শ্রীধরের সঙ্গে দেখা করার সুবিধে এবং দ্বিতীয়ত একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ। শিক্ষকতা করতে বরাবরই ভালোবাসতেন রামন এবং তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের মনে গণিতের বিষয়ে আগ্রহ সঞ্চার করতে পারতেন তিনি খুব সহজেই। বীজগণিতের জগতে সংখ্যাতত্ত্ব, বীজগাণিতিক জ্যামিতি, টোপোলজি ইত্যাদি সহযোগে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। রামনই প্রথম আবিষ্কার করেন একটি অ্যাফাইন সমতলের উপর একটি নন-ট্রিভিয়াল দ্বিঘাত স্পেসের ধারণার দৃষ্টান্ত। বীজগণিতের জগতে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য বহু সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন রামন পরিমালা। ২০১০ সালে হায়দ্রাবাদে আয়োজিত বিজ্ঞান কংগ্রেসে ‘অ্যারিথমেটিক অফ লিনিয়ার অ্যালজেব্রিক গ্রুপস ওভার টু ডায়মেনশানাল ফিল্ডস’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু প্রবন্ধ হল – ‘ফেলিওর অফ এ কোয়াড্রেটিক অ্যানালগ অফ সেরি’স কনজেকচার’, ‘হার্মিটিয়ান অ্যানালগ অফ এ থিওরেম অফ স্প্রিঙ্গার’, ‘ক্লাসিকাল গ্রুপস অ্যাণ্ড দ্য হেজ প্রিন্সিপাল’। ১৯৯৮ সালে বিখ্যাত ‘অ্যানালস অফ ম্যাথমেটিক্স’ বইতেই রামন শেষোক্ত প্রবন্ধটি লিখেছিলেন।
১৯৯৪ সালে জুরিখে আয়োজিত আন্তর্জাতিক গণিতবিদ সভায় আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন রামন পরিমালা। সেই সভায় তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘স্টাডি অফ কোয়াড্রেটিক ফর্মস – সাম কানেকশনস উইথ জিওমেট্রি’। ১৯৮৭ সালে তিনি শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে ভূষিত হন। তাছাড়া নতুন দিল্লির ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’, ব্যাঙ্গালোরের ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ এবং এলাহাবাদের ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’-এর সদস্য ছিলেন তিনি। ২০২০ সালে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস উপলক্ষে ভারতের তৎকালীন নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ভারতের সমস্ত ইনস্টিটিউটে অন্যান্য আরো দশজন মহিলা বিজ্ঞানীর পাশাপাশি রামন পরিমালার নামানুসারেও কিছু পদ তৈরির কথা ঘোষণা করেন। ২০০৩ সালে শ্রীনিবাস রামানুজন জন্মবার্ষিকী পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০৫ সালে গণিতচর্চায় স্বীকৃতি হিসেবে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ২০১২ সালে আমেরিকান ম্যাথমেটিকাল সোসাইটির সদস্যপদ গ্রহণ করেন রামন পরিমালা। ২০১৯ সাল থেকে ‘ইনফোসিস’ পুরস্কারের জন্য ম্যাথমেটিকাল সায়েন্স জুরি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি।
বর্তমানে গণিতের জগতে নানাবিধ নতুন নতুন দিক উন্মোচনের জন্য নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন রামন পরিমালা।