মার্টিন স্করসিস

মার্টিন স্করসিস

মার্টিন স্করসিস (Martin Scorsese) সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক। একেবারে স্বতন্ত্র এবং অন্য ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তিনি একজন বহুচর্চিত পরিচালক। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মায়। ১৯৬৮ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘হুজ দ্যাট নকিং অ্যাট মাই ডোর?’ এর মাধ্যমে স্করসিসের চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে হাতেখড়ি ঘটে । কিন্তু তার আগেই স্করসিসের আরেকটি ছবি ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ মুক্তি পায় যা তাঁকে কাহিনী বুননের অভিনব পদ্ধতির জন্য প্রভূত জনপ্রিয়তা এনে দেয়। নয়া হলিউড যুগের অন্যতম পথিকৃৎ তিনিই। তাঁর চলচ্চিত্রে বারবারই উঠে আসে ইতালীয়-আমেরিকান পরিচয়ের দ্বন্দ্ব, পাপ এবং প্রায়শ্চিত্তের ক্যাথলিক ধারণা, পুরুষতান্ত্রিক গর্ববোধ কিংবা নিহিলিজম। শুধুই চলচ্চিত্র পরিচালনা নয়, চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার ও চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য ১৯৯০ সালে মার্টিন স্করসিস তৈরি করেন ‘দ্য ফিল্ম ফাউণ্ডেশন’ নামে একটি অবাণিজ্যিক সংস্থা। তাঁর পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে শাটার আইল্যাণ্ড (২০১০), উলফ অফ ওয়াল স্ট্রিট (২০১৩), গডফেলাস (১৯৯০), ক্যাসিনো (১৯৯৫), রেজিং বুল (১৯৮০), মিন স্ট্রিটস (১৯৭৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি পেয়েছেন অ্যাকাডেমি পুরস্কার, কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি’অর পুরস্কার, সিলভার লায়ন এবং গ্র্যামি পুরস্কার।

১৯৪২ সালের ১৭ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক সিটির কুইন্সবরোতে মার্টিন স্করসিসের জন্ম হয়। তাঁর স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই তাঁর পরিবার ম্যানহাটনের লিটল ইটালিতে চলে আসে। মার্টিন স্করসিসের বাবা চার্লস স্করসিস এবং মা ক্যাথারিন স্করসিস উভয়েই নিউ ইয়র্কের গার্মেন্ট ডিস্ট্রিক্টে কাজ করতেন। চার্লস একজন ক্লথ প্রেসার ছিলেন এবং ক্যাথারিন সেলাইয়ের কাজ করতেন। তাঁদের উভয়েই ইতালীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। মার্টিনের আসল পারিবারিক পদবী ছিল ‘স্কোজেস, কিন্তু উচ্চারণে অনেকক্ষেত্রে ভুল হওয়ায় তা পরবর্তীকালে বদলে ‘স্করসিস’-এ পরিণত হয়। ছোটো থেকেই একরকম ক্যাথলিক পরিবেশে বড়ো হয়ে উঠেছেন মার্টিন। বালক বয়সে অ্যাজমার কারণে তিনি তাঁর অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খেলাধুলো করতে পারতেন না। ঐ বয়সেই তাঁর মধ্যে চলচ্চিত্রের উপর বিশেষ অনুরাগ তৈরি হয়। ব্রঙ্কস থেকে তিনি বহুবার কিশোর বয়সে পোয়েল অ্যাণ্ড প্রেসারবার্গের ‘দ্য টেলস অফ হফম্যান’ (১৯৫১) ছবির একটিমাত্র কপিই ভাড়া করে দেখতে পছন্দ করতেন। কিশোর বয়সে ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র ‘ল্যাণ্ড অফ দ্য ফ্যারাওস’ এবং ‘এল সিড’ দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৭-৪৮ সালে পোয়েল অ্যাণ্ড প্রেসারবার্গের ‘ব্ল্যাক নার্সিসাস’ কিংবা ‘দ্য রেড শ্যুস’ চলচ্চিত্রটিও মার্টিন স্করসিসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এবং তথ্যচিত্রে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ফরাসী নিউ-ওয়েভ ছবিগুলির কাছে তাঁর যথেষ্ট ঋণ রয়েছে। সত্যজিৎ রায়, ইঙ্গমার বার্গম্যান, আন্তোনিওনি, ফেদেরিকো ফেলিনি প্রমুখরাও পরিচালক ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে তাঁকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিলেন। মার্টিন স্করসিসের প্রথম স্ত্রীর নাম লারাইনে মারি ব্রেনান এবং তাঁদের এক কন্যার নাম ক্যাথরিন। পরে ১৯৭৬ সালে জুলিয়া ক্যামেরনকে বিবাহ করেন তিনি এবং তাঁদের কন্যার নাম ডমেনিকা ক্যামেরন স্করসিস। আরো পরে কয়েক বছরের ব্যবধানে ইসাবেলা রোজেলিনি, বারবারা দে ফিনা এবং সবশেষে হেলেন মরিসকে বিবাহ করেন স্করসিস। মরিস আর স্করসিসের কন্যার নাম ফ্রান্সেস্কা।

ব্রঙ্কসের কার্ডিনাল হেজ হাই স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতক উত্তীর্ন হন মার্টিন স্করসিস। প্রাথমিকভাবে একজন ধর্মযাজক হতে চেয়েছিলেন তিনি এবং সেইজন্য একটি প্রস্তুতিমূলক সেমিনারেও অংশ নেন তিনি। কিন্তু এই কাজে ব্যর্থ হয়ে সিনেমার প্রতি আকর্ষণের কারণে ওয়াশিংটন স্কোয়ার কলেজে ভর্তি হন যা বর্তমানে ‘কলেজ অফ আর্টস অ্যাণ্ড সায়েন্স’ নামে পরিচিত। এই কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬৮ সালে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অফ দ্য আর্টস’ থেকে এম.এফ.এ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

স্কুল অফ দ্য আর্টস-এ পড়াকালীনই ১৯৬৩ সালে মার্টিন স্করসিস একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানান ‘হোয়াটস এ নাইস গার্ল লাইক ইউ ডুইং ইন এ প্লেস লাইক দিস?’ নামে এবং তার পরের বছর ১৯৬৪ সালে তিনি আরেকটি ছবি বানান ‘ইটস নট জাস্ট ইউ, মুরে!’ নামে। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামের উপর আমেরিকার হস্তক্ষেপের বিষয় নিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘দ্য বিগ শেভ’ ছবিটি। ১৯৬৮ সালে মার্টিন স্করসিস তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিটি নির্মাণ করেন যার নাম ‘হুজ দ্যাট নকিং অ্যাট মাই ডোর?’ এই ছবির কাজ করতে গিয়েই মার্টিনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে অভিনেতা হার্ভে কেটেল এবং চিত্র-সম্পাদক থেলমা শুনমেকারের যারা পরবর্তীকালে মার্টিনের ছবির সঙ্গে যুক্ত হন এবং এই তিনজনের জুটি একত্রে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে ‘মিন স্ট্রিট’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন তিনি যা বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। বলা যেতে পারে এই ছবিটিই তাঁর প্রথম প্রভূত জনপ্রিয় ছবি এবং এই ছবি থেকেই মার্টিন স্করসিসের নিজস্ব ঘরানার চেহারাটি স্পষ্ট হতে শুরু করে। অন্ধকার জগতের প্রেক্ষাপট, অসহনশীল চরিত্র, ধর্মের অনুষঙ্গ, মাফিয়ারাজ, অপ্রচলিত ক্যামেরার কৌশল এবং সাম্প্রতিক সময়ের আবহ সবই তাঁর ছবির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এই ছবিটি পরিচালনার ফলে রবার্ট ডি নিরোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। রবার্ট ডি নিরো স্করসিসের ছবিতে এরপর থেকে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করতে থাকেন। নিরোর অভিনয় এবং স্করসিসের পরিচালনা দুয়ে মিলে এক নতুন হলিউডের ইতিহাস তৈরি করে। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় স্করসিসের পরিচালিত বিখ্যাত ছবি ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবিটি পাম ডি’অর পুরস্কারে ভূষিত হয় এবং হলিউড চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় রবার্ট ডি নিরোকে একজন খ্যাতনামা অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর পরেই জন হিঙ্কলে নামে জনৈক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানকে হত্যার চেষ্টা করে। বলা হয় এই ছবির সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সংযোগ আছে এবং হিঙ্কলে নিজে স্বীকার করেন স্করসিসের ছবিটিতে জোডি ফস্টারের চরিত্রটি দেখেই তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। চারটি শ্রেণিতে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল এই ছবিটি। ১৯৮০ সালে সমস্যাগ্রস্ত বক্সার জেক লা মোট্টার জীবন অবলম্বনে রবার্ট ডি নিরোকে মুখ্য চরিত্রে রেখে মার্টিন স্করসিসের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘রেজিং বুল’ ছবিটি আর মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছবিটির হিংসাত্মক আবেদন বিষয়ে দর্শকদের মধ্যে আলোচনা হতে শুরু করে। ‘রেজিং বুল’ হলিউড চলচ্চিত্রের জগতে সবসময়ের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মার্টিন স্করসিস চলচ্চিত্র জগত থেকে সরে আসতে চাইছিলেন কিন্তু পরে তিনিই আবার তাঁর সবথেকে বেশি বাণিজ্যসফল ছবিটি বানান যার নাম ‘দ্য কালার অফ মানি’ (১৯৮৬)।

মাফিয়ারাজ বিষয়ে নব্বইয়ের দশকে স্করসিসের পরপর দুটি ছবি মুক্তি পায় – গডফেলাস (১৯৯০) এবং ক্যাসিনো (১৯৯৫)। দুটি ছবিই সমানভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। পূর্বতন গ্যাংস্টার হেনরি হিলের জীবন অবলম্বনে ‘গডফেলাস’ এবং সত্তরের দশকে আণ্ডারওয়ার্ল্ডে জুয়ার বাড়বাড়ন্ত বিষয়ে নির্মিত হয় ‘ক্যাসিনো’। এই ছবিদুটিতে ইতালীয়-আমেরিকানদের মাফিয়া ও অন্ধকার জগতের সঙ্গে জড়িত হিসেবে দেখানো হয়েছে যে কারণে পরে মজা করে স্করসিস বলেছিলেন যে ইতালীয়-আমেরিকানদের ভালো দেখিয়ে তিনি আরেকটি পৃথক ছবি বানাবেন। বিখ্যাত অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওকে মুখ্য ভূমিকায় রেখে স্করসিস বানান আরো চারটি চলচ্চিত্র – ‘শাটার আইল্যাণ্ড’ (২০১০), ‘দ্য ডিপার্টেড’ (২০০৬), ‘দ্য অ্যাভিয়েটর’ (২০০৪) এবং ‘উলফ অফ ওয়াল স্ট্রিট’ (২০১৩)। পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ছাড়াও তিনি কিছু সাংগীতিক তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য লাস্ট ওয়াল্টজ’ খুবই বিখ্যাত একটি কাজ। বব ডিলানকে এই তথ্যচিত্রে একটি বিশেষ ভূমিকায় দেখা যায়। এছাড়া তাঁর ‘দ্য ব্লুজ’ (২০০৩) তথ্যচিত্রটি দুটি গ্র্যামি পুরস্কার অর্জন করেছে। বব ডিলানকে নিয়েও তিনি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন যার নাম ‘নো ডিরেকশন হোম’ (২০০৫)।

২০১২ সালে ‘সাইট অ্যাণ্ড সাউণ্ড’ পত্রিকা মার্টিন স্করসিসের ছবিগুলির মধ্যে অন্যান্য সমসাময়িক পরিচালকদের মতানুসারে যে কয়েকটি জনপ্রিয় ছবির নাম উল্লেখ করে তার মধ্যে ছিল ‘২০০১ : আ স্পেস ওডিসি’, ‘পপোই ই দিয়ামান্ত’, ‘পাইসাঁ’, ‘দ্য রেড শ্যুস’, ‘দ্য সার্চার্স’, ‘ভার্টিগো’ ইত্যাদি।

শুধুই চলচ্চিত্র পরিচালনা নয়, চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার ও চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য ১৯৯০ সালে মার্টিন স্করসিস তৈরি করেন ‘দ্য ফিল্ম ফাউণ্ডেশন’ নামে একটি অবাণিজ্যিক সংস্থা। ২০০৭ সালে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড সিনেমা প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন তিনি যেখানে আন্তর্জাতিক স্তরে কম বিখ্যাত বা একেবারেই অপরিচিত ছবিগুলির পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে থাকেন মার্টিন।

মার্টিন স্করসিস তাঁর নির্মিত বহু ছবির জন্যেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন। তাঁর ‘গডফেলাস’ ছবিটি পরিচালনা আর চিত্রনাট্যের বিভাগে ‘বাফটা’ (BAFTA) পুরস্কার এনে দেয় স্করসিসকে। আবার ‘রেজিং বুল’ ছবিটির জন্য তিনি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পান এবং এই ছবিটি অ্যাকাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত হয়। পরিসংখ্যানের হিসেবে মার্টিন স্করসিস বিভিন্ন ছবির জন্য বিভিন্ন সময় মোট ২০টি অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ২৩টি বাফটা পুরস্কার এবং ১১টি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৯৫ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি ফরাসি সরকার মার্টিন স্করসিসকে সারা জীবনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘লিজিয়ন অফ অনার’ উপাধি দেয়। ২০০৬ সালে গ্র্যামি পুরস্কারের শিরোপা লাভ করেন তিনি।

চলচ্চিত্র পরিচালনা, পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের জন্য তিনি এখনও কাজ করে চলেছেন।

আপনার মতামত জানান