ঈশ্বরচন্দ্র-গুপ্ত

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তিনি ‘গুপ্ত কবি’ নামে সাহিত্য জগতে পরিচিত। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার শুরু তাঁর হাত ধরেই। ভূদেব চৌধুরী তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন, “উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক, ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ‘ প্রভাকর’ ঈশ্বরগুপ্ত সেযুগের বাংলাকাব্যের একমাত্র কবি ছিলেন।”


১৮১২ সালের ৬ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ায় জন্ম হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের৷ তাঁর বাবার নাম হরিনারায়ণ গুপ্ত, মায়ের নাম শ্রীমতি দেবী। ঈশ্বরচন্দ্রের চার ভাই এক বোন ছিল। বাল্যকালে ঈশ্বরচন্দ্র অত্যন্ত দুরন্ত ও সাহসী প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক৷ দশ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র মা’কে হারান। এরপর তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে ঈশ্বরচন্দ্র সৎ মাকে মেনে নিতে না পেরে জোড়াসাঁকোয় তাঁর মামারবাড়িতে আশ্রয় নেন। মামারবাড়ির বৈষয়িক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাঁকে দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হতে হয়েছিল৷ শৈশবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি, তবে অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা,সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর বৈবাহিক জীবন সুখকর হয়নি৷ 

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সাংবাদিক হিসেবে সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রথম শ্রেনীর দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের গৌরব তাঁর প্রাপ্য৷ সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে ২৮ জানুয়ারি তিনি ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। সূচনা লগ্নে ‘সংবাদ প্রভাকর’ ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পরবর্তী সময়ে সপ্তাহে তিনবার প্রকাশ হত। ১৮৩৯ সালের ৪ জুন থেকে এটি রোজ প্রকাশিত হতে থাকে৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’ ছিল বাংলা তথা ভারতীয় ভাষার প্রথম দৈনিক সংবাদ পত্র। এই পত্রিকাতে প্রাচীন কবিওয়ালাদের গান ও জীবনী সংগ্রহ করে তিনি ছাপতেন।

কেবল সাংবাদিকতা নয় কবি হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আমাদের বিশেষ পরিচিত৷ তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন যদিও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে সমকালের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তিনি৷ সমাজচেতনা, যুক্তিবাদী মনোভাব,  ইতিহাস চেতনা, তাঁর কাব্যে বিশেষভাবে লক্ষনীয়৷ বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে ঈশ্বর গুপ্ত লেখেন, “মিছে কেন কুল নিয়ে কর আঁটাআঁটি / এ যপন কুল নয় সরামাত্র আঁটি।” ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের কাছ থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন। যেমন- ” গুরু গুরু গুরু গুরু সকলেই কয়। / গুরু রব গুরু বটে, ফলে গুরু নয়।। শিষ্যের সম্পদ ছলে যে করে গ্রহণ। / গুরু বলে কিসে তারে, করিব বরণ।।” জীবনটাকেই তিনি ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। সমাজকেও সেই দৃষ্টিতেই যে দেখেছিলেন সেটা তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট করে গিয়েছেন।

স্বদেশ ও সমাজের প্রতি ঈশ্বর চন্দ্রের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি যেমন অনায়াসে ‘পাঁঠা’, ‘আনারস’, ‘তোপসে মাছ’ ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে কবিতা লেখেন; আবার তাঁর কবিতায় উঠে আসে সমসাময়িক রাজনৈতিক,সামাজিক ঘটনাবলির চিত্ররূপ। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কাব্যজগতে বহু বিচিত্র পথ পরিক্রমা করলেও তাঁর কবিতা লেখার মূল উৎস ছিল কবিগান। কবিগানের সস্তা চটকদারি ভাব ও তার চাপান-উতোর স্বভাব তাঁর বেশ কিছু কবিতায় লক্ষ করা যায়। তাঁর কবিতার মূল ছন্দ ছিল পয়ার, তাই তো মাইকেলের অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে লিখেছেন – “কবিতা-কমলা-কলা পাকা বড় কাঁদি। / ইচ্ছা হয় যত পাই পেট পুরে খাই।। “এমনকি তিনি নারী শিক্ষার বিরোধিতা করে তিনি লেখেন, ” আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো ব্রতকর্ম কর্তো সবে। / একা বেথুন এসে শেষ করেছে আর কি তাদের তেমন পাবে।। / যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। / তখন এ.বি. শিখে বিবি সেজে বিলিতী বোল কবেই কবে।।” একই সঙ্গে তিনি বিধবা বিবাহকেও সমর্থন জানাতে পারেননি। তাই তিনি লিখেছেন – ” সকলেই এইরূপ বলাবলি করে। / ছুঁড়ীর কল্যাণে যেন বুড়ী নাহি তরে।।”

তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এ দেশ রঙ্গে ভরা, তাই তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রঙ্গ- ব্যঙ্গ করেছেন।  তাঁর রচিত প্রবাদ প্রবচনগুলি অত্যন্ত মনোরম এবং তা তাঁর কবিত্ব শক্তির নমুনা দেয়। যেমন, “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশে তবু রঙ্গে ভরা ” কিংবা “কসাই অনেক ভালো গোঁসাইর চেয়ে” বা “ধর্মতলা ধর্মহীন গোহত্যার ধাম” ইত্যাদি। কোন কোন সমালোচক তাঁর কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগ তুলেছেন  তবুও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হাত ধরে কবিতা যে তার মধ্যযুগীয় শিকল থেকে মুক্তি পেয়েছিল এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।

২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯ সালে একাধারে কবি এবং সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু হয়৷ 

6 comments

আপনার মতামত জানান