আর্থার সি ক্লার্ক

আর্থার সি ক্লার্ক

আর্থার. সি. ক্লার্ক (Arthur. C. Clarke) বিশ্বসাহিত্যে জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিকার হিসেবে । যদিও আপামর মানুষ তাঁকে চেনে ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ (2001 : A Space Odessey) চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার হিসেবে। প্রায় শতাধিক বইয়ের লেখক আর্থার ক্লার্কের আধুনিক প্রযুক্তি ও ভবিষ্যতের নানা আবিষ্কার বিষয়ে রসসিদ্ধ রচনা আজও পাঠক-পাঠিকাদের খুবই প্রিয়। মহাকাশ বিজ্ঞান এবং মহাজাগতিক নানা আবিষ্কারের দিকনির্দেশ তাঁর লেখার প্রতি মানুষকে কৌতূহলী করেছে।

১৯১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যাণ্ডের সমারসেটের উপকূলীয় মাইনহেড শহরে আর্থার. সি. ক্লার্কের জন্ম হয়। এক কৃষক পরিবারে চার সন্তানের মধ্যে সবথেকে বড়ো ছিলেন আর্থার। তাঁর পুরো নাম আর্থার চার্লস ক্লার্ক। ছোটবেলা থেকেই খামারবাড়িতে থেকে ঘরে তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের তারা দেখা, জীবাশ্ম সংগ্রহ করা এবং আমেরিকা থেকে প্রকাশিত কল্পবিজ্ঞানের পত্র-পত্রিকাগুলি গোগ্রাসে পড়তে ভালোবাসতেন। ‘অ্যামেজিং স্টোরিস’ পত্রিকার নানা সংখ্যা, ওলাফ স্টেপল্ডনের ‘লাস্ট অ্যান্ড ফার্স্ট মেন’ বইটি এবং ডেভিড লেসারের ‘কঙ্কোয়েস্ট অফ স্পেস’ (Conquest of Space) বইটি আর্থারকে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী করে তোলে। ‘ডাইনোসর সিগারেট কার্ড’ দেখেই তাঁর মধ্যে ছোটো থেকে জীবাশ্ম সংগ্রহের নেশা জাগে।

আর্থার ক্লার্কের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হয় টণ্টনের হুইশ গ্রামার স্কুলে (Huish Grammar School)। তারপর তিনি টণ্টনের কাছে মিডল স্কুল থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর বাবার মৃত্যু হলে সংসারের অর্থকষ্ট দূর করতে তাঁর পক্ষে আর বেশিদূর পড়াশোনা করা হয়নি। ১৯৩৬ সালে কাজের সন্ধানে তিনি ঘর ছাড়েন। যদিও এর আগে ১৯৩৪ সালে তিনি ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটরি সোসাইটি (BIS)-তে যোগ দেন যেখানে রকেট উৎক্ষেপণ এবং মহাকাশ অভিযান সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা হত। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত একজন সরকারি নিরীক্ষক (Auditor) হিসেবে তিনি কাজ করেন। তারপর ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত আর্থার ক্লার্ক ‘রয়্যাল এয়ার ফোর্স’-এ রাডার প্রশিক্ষক এবং প্রযুক্তিবিদের চাকরি করেন। ফলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।

১৯৪৫ সালে তিনি ‘ওয়্যারলেস ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার জন্য একটি নিবন্ধ লেখেন আর্থার ক্লার্ক ‘এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল রিলেস’ (Extra-terrestrial Relays) নামে যেখানে তিনি এমন এক যোগাযোগের উপগ্রহ ব্যবস্থাপনার কথা কল্পনা করেছিলেন যা সারা বিশ্বে টেলিভিশন এবং রেডিওকে সংকেত রিলে করতো। এটি আসলে ছিল একপ্রকার ‘জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট’ ব্যবস্থা। তখনও এই ব্যবস্থা চালু না থাকলেও, দুই বছর বাদে একই ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। ফলে তাঁর ভবিষ্যৎ কল্পনা বাস্তুবায়িত হল। ১৯৪৬ সাল থেকে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের কল্পবিজ্ঞান-পত্রিকাগুলিকে তিনি ছোটগল্প বিক্রি করা শুরু করেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ এবং পরে ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটরি সোসাইটির চেয়ারম্যান হন ক্লার্ক। পড়াশোনা করার আবার এক সুবর্ণ সুযোগ পেলেন এবারে আর্থার। ১৯৪৮ সালে লণ্ডনের কিংস কলেজ থেকে বৃত্তি নিয়ে গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ইতিমধ্যে ক্লার্কের মধ্যে লেখকসত্তা এবং বৈজ্ঞানিকসত্তার মিশেল ঘটতে শুরু করেছে, কখনো বা দ্বন্দ্বও তৈরি হচ্ছে। যদিও লেখক হিসেবেই তাঁর কর্মজীবন শোভিত। এই সময়েই তিনি লিখে ফেলেন তাঁর প্রথমদিকের কল্পবিজ্ঞান কাহিনিগুলি যার মধ্যে ১৯৫১ সালে মানুষের চন্দ্রাভিযান সংক্রান্ত ‘প্রিল্যিউড টু স্পেস’ (Prelude to Space), একইবছরে ‘দ্য স্যাণ্ডস অফ মার্স’ (The Sands of Mars) এবং ১৯৫২-তে মহাকাশ-স্টেশনের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘আইল্যাণ্ডস ইন দ্য স্কাই’ (Islands in the Sky) উল্লেখ্য। এছাড়া প্রবন্ধ-নিবন্ধের মধ্যে সেসময় ১৯৫০-এ লেখা ‘ইন্টারপ্ল্যানেটরি ফ্লাইট’, ১৯৫১-তে ‘এক্সপ্লোরেশন অফ স্পেস’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ১৯৫৩ সালে ক্লার্ক লেখেন ‘চাইল্ডহুডস এন্ড’ যেখানে তিনি এলিয়েন তথা ভিনগ্রহের জীবের কথা প্রথম বলেন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি দুটি ছোটগল্প লেখেন যা কল্পবিজ্ঞানের জগতে ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। প্রথমটি ‘দ্য নাইন বিলিয়ন নেমস অফ গড’ যেটি ১৯৫৩ সালে প্রকাশ পায় এবং দ্বিতীয়টি ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য স্টার’।

ক্রমেই ক্লার্ক তাঁর লেখার মাধ্যমে ঔপন্যাসিক এবং বৈপ্লবিক চিন্তক হিসেবে সম্মানিত হতে থাকেন। তিনি প্রায়ই আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মহাকাশযানের নকশা তৈরিতে সহায়তা করতেন এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংক্রান্ত বিষয়ে উপগ্রহের উন্নয়নসাধনে সহায়তা করতে থাকেন। মহাকাশ, নক্ষত্র, ভিনগ্রহে অবতরণ ইত্যাদি বিষয়ে কৌতূহলের পাশাপাশি একসময় ক্লার্ক সমুদ্রগহ্বরে অভিযানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সেইজন্য ১৯৫৬-তে শ্রীলঙ্কায় চলে আসেন। এখানে তিনি স্কিন ডাইভিং আর ফটোগ্রাফির মাধ্যমে দ্বিতীয়বার তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এই শ্রীলঙ্কায় থাকাকালীন সময়েই তিনি আরো নতুন নতুন বইয়ের পরিকল্পনা করে ফেলেন, তৈরি হয়ে যায় সমুদ্র-অভিযানের প্রেক্ষাপটে আরো নানা প্লট। এইসময় ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘কোস্ট অফ কোরাল’। ১৯৬২ সাল নাগাদ তিনি ‘প্রোফাইলস অফ দ্য ফিউচার’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি আগামী ২১০০ সাল পর্যন্ত কি কি আবিষ্কার হতে পারে তার একটা ভবিষ্যৎবাণী করেছেন।

১৯৬৪ সালের প্রারম্ভে ক্লার্ক ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি ছোটগল্প ‘দ্য সেন্টিনেল’ এর একটি চিত্রনাট্যরূপ দেবার ব্যাপারে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিকের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন। এই পর্বটিই আর্থার ক্লার্কের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা তাঁকে মৃত্যুর পরেও বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে। এই গল্প থেকেই ১৯৬৮ সালে তৈরি হয় কালজয়ী কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক ক্লাসিক ছবি ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ যা সারা বিশ্বে বিপুল সাড়া জাগায়। এরপর এই চিত্রনাট্য থেকে ক্লার্ক একটি উপন্যাস নির্মাণ করেন ঐ বছরই যার ক্রমান্বয়ে খণ্ড বেরোতে থাকে একে একে। প্রথমে ১৯৮২ সালে ‘২০১০ : ওডিসি টু’ আর তারপর ১৯৮৭-তে ‘২০৬১ : ওডিসি থ্রি’ এবং সবশেষে ১৯৯৭ সালে ‘৩০০১ : দ্য ফাইনাল ওডিসি’। এই ওডিসি ট্রিলজি’র জন্য কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যে আর্থার ক্লার্ক আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। কাকতালীয়ভাবে মহাকাশের মহাকাব্য রচনা করার পরেই বাস্তবিক মহাকাশযানের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এসেছিল ক্লার্কের জীবনে। ১৯৬৯ সালে ‘ওয়াল্টার ক্রনকাইট’-এ (Walter Chronkite) ‘অ্যাপোলো-১১’ চন্দ্রযানের চাঁদে অবতরণের ভাষ্যকার (commentator) হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে ‘ অ্যাপোলো-১৩’ এবং ‘ অ্যাপোলো-১৫’-এর অবতরণের ভাষ্যদানের সময়েও তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেকালে তাঁর সঙ্গে আমেরিকান লেখক আইজ্যাক আসিমভ এবং রবার্ট হিন্‌লিনকে একত্রে ‘বিগ থ্রি’ বলা হত।

আর্থার ক্লার্ক দুটি আত্মজীবনীমুলক বই লেখেন যার প্রথমটি ১৯৮৪তে প্রকাশিত ‘অ্যাসেন্ট টু অরবিট : এ সায়েন্টিফিক অটোবায়োগ্রাফি’ (Ascent to Orbit : A Scientific autobiography) আর দ্বিতীয়টি ‘অ্যাস্টাউন্ডিং ডেজ্‌ : এ সায়েন্স ফিকশনাল অটোবায়োগ্রাফি’ (Astounding Days : A Science Fictional Autobiography) যা কিনা ১৯৮৯ সালে প্রকাশ পায়। এই দুটি বইতেই তিনি ছোটোবেলাকার সেই কল্পবিজ্ঞান-পত্রিকাগুলি পড়ে কল্পবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হবার কথা স্বীকার করেছেন। ১৯৮১-তে ক্লার্ক টিভিতে একটি ধারাবাহিক সঞ্চালনা শুরু করেন যার নাম ‘আর্থার সি ক্লার্ক’স মিস্টিরিয়াস ওয়ার্ল্ড’। একইরকমভাবে ১৯৮৪-এ আরেকটি ধারাবাহিক ‘আর্থার সি ক্লার্ক’স ওয়ার্ল্ড অফ স্ট্রেঞ্জারস’ নামে সঞ্চালনা করেন।

সারা জীবনে যত পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন আর্থার ক্লার্ক তা গুনে শেষ করা যাবে না। ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ চলচ্চিত্রের জন্য ক্লার্ক এবং স্ট্যানলি কুব্রিক উভয়েই এই চলচ্চিত্রের জন্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পান। এর আগে যদিও ক্লার্ক তাঁর লেখা ‘দ্য স্টার’ গল্পটির জন্য ১৯৫৬ সালে ‘হুগো অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০০০ সালের ২৬ মে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর একটি নভেলা ‘এ মিটিং উইথ মেডুসা’র জন্য তিনি পেয়েছেন ‘নেবুলা অ্যাওয়ার্ড’ ১৯৭৩ সালে। এর আগে ১৯৬১ সালে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে তাঁকে কলিঙ্গ পুরস্কার দেওয়া হয়। আর্থার ক্লার্কের অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দ্য সিটি অ্যান্ড দ্য স্টারস’ (১৯৫৬), ‘রদেভুঁ উইথ রামা’ (১৯৭৩), ‘দ্য হ্যামার অফ গড’ (১৯৯৩), ‘দ্য ফাউন্টেন্স অফ প্যারাডাইস’ (১৯৭৯) ইত্যাদি। এছাড়াও লিখেছেন বহু ছোটগল্প, নিবন্ধ।  

২০০৮ সালের ১৯ মার্চ ৯০ বছর বয়সে শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে আর্থার সি ক্লার্কের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান