লালন ফকিরের সময় থেকে যে বাউল সাধনা ও বাউল গানের ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেই ধারারই এক অন্যতম স্মরণীয় পথিক পূর্ণদাস বাউল (Purnadas Baul)। বাউল গানের সহজ সাধনার মধ্যে দিয়ে গভীর জীবনবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। বাউল গানের অতি সাধারণ মেঠো সুরকে ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে দেশে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন পূর্ণদাস বাউল। তাঁর খ্যাতি ও গুণের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার তাঁকে দিয়েছে ‘বাউল সম্রাট’ উপাধি।
১৯৩৩ সালের ১৮ মার্চ বীরভূমের রামপুরহাটের কাছে একচাকা গ্রামে পূর্ণদাস বাউলের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম শ্রী পূর্ণচন্দ্র দাস। তাঁর বাবা নবনীদাস ক্ষ্যাপা বাউল ছিলেন একজন খ্যাতিমান বাউল শিল্পী, মরমি কবি এবং যোগীপুরুষ। তাঁর মায়ের নাম ব্রজবালা দাস। নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে ছিলেন নবনীদাস বাউল এবং বলা হয় রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হওয়ার পাশাপাশি নবনীদাস ছিলেন তাঁর প্রেরণাও। খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে বহু জায়গায় বাউল গান গাইতে যেতেন পূর্ণদাস বাউল। তাঁর বাবা নবনীদাস কখনোই এক জায়গায় বেশিদিন থাকতেন না, ফলে বাবার সূত্রেই বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল পূর্ণদাস বাউলের। বাংলার মাঠে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে যে বাউলরা লোকসঙ্গীত গায়, আধ্যাত্মিক গান গেয়ে বেড়ায় তাদের উত্তরাধিকার বহন করেছেন পূর্ণদাস বাউল। সেই সময় বাংলায় বহু স্থানে বৈষ্ণবী আখড়া ছিল যেখানে সমাবেশ হলে পূর্ণদাস যেতেন গান শুনতে, তাঁর বাবা গান গাইতেন ঐ সব আখড়াতেও। বাংলার বুকে নেমে আসা দুর্ভিক্ষে তাঁদের পরিবার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে। তখন তাঁর মাত্র ছয় বছর বয়স। শুধুমাত্র অন্নসংস্থানের তাগিদেই তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয় পথে, বাউল গান গেয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য। সেই শুরু হল গানকে পেশা হিসেবে এগিয়ে চলা।
মাত্র সাত বছর বয়সে ট্রেনে, প্ল্যাটফর্মে গান গেয়ে গেয়ে পূর্ণদাস বাউলের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল বলা যায়। ঠিক এইসমইয়েই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে সীতারাম ওঙ্কারনাথের যিনি তাঁকে বাউল গান গাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। নয় বছর বয়সে ভারতের জয়পুরে বাউল গান পরিবেশন করেন পূর্ণদাস বাউল, দর্শক-শ্রোতাদের মন জয় করে নেন ঐ সময়েই এবং উল্লেখ্য সেই অনুষ্ঠানেই গান গেয়ে প্রথম স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। আরেকটু বড় হয়ে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় বহু সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। রঙমহল থিয়েটার এবং বঙ্গসংস্কৃতি মেলায় তিনি বাউল গান পরিবেশন করেন। এমনকি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও গান গেয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে বাবার সঙ্গে একত্রে সারা কলকাতা জুড়ে তাঁর বাউল-সঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলতে থাকে।
ইতিমধ্যে ক্যাসেট বেরোয় তাঁর গানের, সেটিও খুব কম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬০ সালের শেষদিকে পূর্ণদাস বাউল প্রথম পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায় সানফ্রান্সিসকোয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য। বব ডিলানের প্রাক্তন ম্যানেজার অ্যালবার্ট গ্রসম্যানের আহ্বানেই তাঁর বিদেশযাত্রা। গ্রসম্যান তাঁকে নিয়ে যান উডস্টক শহরের বিয়ার্সভিল এলাকায়। ঠিক এর পরেই ঘটলো অভূতপূর্ব সেই ইতিহাস। ১৯৬৮ সালে বিশ্ববরেণ্য শিল্পী বব ডিলানের সঙ্গে এক মঞ্চে বাউল গান উপস্থাপন করেন পূর্ণদাস বাউল। তাঁর মার্কিন সফরের সেরা স্মৃতি এটা। পূর্ণদাস এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে বব ডিলান তাঁর স্ত্রীয়ের বানানো খিচুড়িও খেয়েছিলেন। সেই খিচুড়িতে আলুর বদলে ছিল আপেল কারণ আমেরিকার ঐ অঞ্চলে প্রচুর আপেল পাওয়া যেত। এমনকি শিল্পী হিসেবে মানসিকতার সাদৃশ্যের জন্য বব ডিলান নিজেকে ‘বাউল অফ আমেরিকা’ বলে পরিচয় দিতেন। মার্কিন মুলুকে এভাবেই তাঁর গান, বাংলার বাউল গানকে তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন আপামর মানুষের মনে। বলা হয়, তাঁর উঁচু স্কেলের কণ্ঠস্বর, আত্মভোলা ভঙ্গি এবং নাচের জাদুতে পাগল হয়েছিল সঙ্গীতপ্রিয় আমেরিকাবাসী।
এরপর ফ্রান্সে মিক জ্যাগারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর এবং তিনি নিস্ শহরে রোলিং স্টোন স্টুডিওতে কাজ করতে শুরু করেন। জ্যাগারের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি রেকর্ডে গান করেন পূর্ণদাস বাউল। আমেরিকায় বব ডিলানের পাশাপাশি বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গেও তাঁর সখ্যতা হয়েছিল। বহু দেশে ঘুরেছেন পূর্ণদাস বাউল। ১৯৯০ সালে ইরানে, ১৯৯২ সালে আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিন শহরে, ১৯৯৪ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে, জার্মানির বার্লিন শহরে এবং নরওয়েতেও বাউল সম্রাটের দল বাউল গান পরিবেশন করেন। পরে ২০০০ সালে রোমে ‘রোমাপোসিয়া পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যাল’-এ এবং উল্লেখ্য ২০০২ সালে আরেক প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মিশিগান শহরে, নিউ ইয়র্কে, ফ্লোরিডায় তিনি বাউল গান পরিবেশন করেন। ওয়াশিংটন ডি.সি, টেক্সাস, অস্ট্রেলিয়া, নিউ ইয়র্ক, লুক্সেমবার্গ, তুরস্ক, ইস্তাম্বুল, দক্ষিণ কোরিয়ার মত বিবিধ দেশে বাউল গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন পূর্ণদাস বাউল। ‘টেনেসি ফোক ফেস্টিভ্যালে’ও সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন তিনি। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, মাহালিয়া জ্যাকসন, জোন বেইজ, গর্ডন লাইটফুট প্রমুখ বহু শিল্পীদের সঙ্গে এক মঞ্চে গান গাওয়ার স্মৃতি রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় তাঁর বহু রেকর্ড মুক্তি পায় যেমন – ইলেক্ট্রা, নান্সাচ (১৯৭৫), ক্র্যামওয়ার্ল্ড (১৯৯৪), ওমাড ইত্যাদি।
দেশে-বিদেশে বাউল গান পরিবেশনের পাশাপাশি নানা প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেছেন পূর্ণদাস বাউল। আমেরিকার সান দিয়েগোতে তৈরি করেন ‘বাউল একাডেমি’। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর সবথেকে প্রিয় স্থান শান্তিনিকেতনে স্থাপন করেন ‘বাউল সমাজ’। শান্তিনেকতন এখনো বাউল সংস্কৃতির পীঠস্থান। বাউল সম্প্রদায়ের সাহায্যের জন্য সেখানে একটি আশ্রম গড়ে তোলেন তিনি। এমনকি এইডস আক্রান্ত রোগীদের সাহায্যের জন্য গান গেয়েছেন তিনি, গানের মাধ্যমে এইডস সম্পর্কে শান্তিনিকেতনের নিম্নবিত্ত পরিসরে সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়াসে সামিল ছিলেন পূর্ণদাস বাউল। তাছাড়া সংশোধনাগারে, অনাথ আশ্রমে ইত্যাদি বহু স্থানে গান গেয়েছেন তিনি। সমাজকল্যাণমূলক কাজেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। আর সমস্ত কাজেই তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী মঞ্জু দাস আর পুত্র দিব্যেন্দু দাস। ইংরাজি ভাষায় প্রথম বাউলদের দর্শন বিষয়ে তিনি একটি বই লেখেন সেলিনা থিলম্যানের সহায়তায়।
পূর্ণদাস বাউল প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ১৯৬৭ সালে ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবিতে। তারপর ১৯৮৩ সালে শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘আরোহন’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন পূর্ণদাস বাউল। ‘সং অফ দ্য ম্যাডম্যান’, ‘দ্য বাউলস অফ বেঙ্গল’ ইত্যাদি সিডিগুলি ইউরোপ, আমেরিকায় প্রভূত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান হল ‘গোলেমালে গোলেমালে পীরিত কোরো না’। এছাড়া তাঁর কণ্ঠে ‘নদী ভরা ঢেউ’, ‘তুই আমায় পাগল করলি রে’, ‘বেলা গেল ও ললিতে’, ‘যেমন বেণী তেমনি রবে’, ‘মেনকা মাথায় দিল ঘোমটা’, ‘যে জন প্রেমের ভাব বোঝে না’ ইত্যাদি গান চিরন্তন বাংলার মাটির সহজ সুরে মিশে আজও বাঙালির হৃদয় বিহ্বল করে তোলে। ২০১৩ সালে বব ডিলানের বিখ্যাত গান ‘মিস্টার ট্যাম্বারিন ম্যান’কে বাংলায় তর্জমা করে বব ডিলানকে শ্রদ্ধা জানান তিনি।
২০১৯ সালে কলকাতায় বব ডিলানের গানের খ্যাতি-পরম্পরা নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘ইফ নট ফর ইউ’তে পূর্ণদাস বাউল উপস্থিত ছিলেন। বাংলায় ‘বৃহৎ বাউল সঙ্গীত’ নামে প্রায় একশত বাউল গানের সংকলন তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কলকাতার রাজেন্দ্র লাইব্রেরী প্রকাশনা থেকে। সারাজীবনে বহু পুরস্কারে এবং বহু উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন বাউল সম্রাট পূর্ণদাস। ১৯৬৭ সালে ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫২ সালে বেনারস সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি ‘বাউল রত্ন’ উপাধি পান। ভারতের দশম রাষ্ট্রপতি শ্রী আর. কে নারায়ণনের থেকে ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। সবশেষে ২০১৩ সালে ভারত সরকারের থেকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার লাভ তাঁর সারাজীবনের কাজের চূড়ান্ত স্বীকৃতি। কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ৮৮ বছর বয়সে তিনি এখনো বাউল সাধনা আর বাউল সঙ্গীত চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।