মহাভারতের বিরাটপর্বে একত্রিশতম অধ্যায় থেকে সাতষট্টিতম অধ্যায় জুড়ে বৃহন্নলাবেশী অর্জুনের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণনা আছে। পাশাখেলায় হেরে গিয়ে দ্রৌপদীকে নিয়ে পান্ডবদের বারো বছরের জন্য বনবাস এবং এক বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে যেতে হয়। এই এক বছর তাঁরা মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের আশ্রয়ে রাজপুরীতে কাটান। যুধিষ্ঠির ‘কঙ্ক’ নাম নিয়ে রাজার সভাসদ হন। ভীমের নাম হয় ‘বল্লভ’ এবং তিনি রাঁধুনির কাজ নেন। অর্জুন ‘বৃহন্নলা’ নাম নিয়ে নারীবেশে রাজকুমারীদের নাচ-গান শেখাতে থাকেন। নকুল ‘গ্রন্থিক’ নাম নিয়ে আস্তাবলে কাজ নেন এবং সহদেব ‘তন্ত্রিপাল’ নাম নিয়ে গোশালা দেখভালের কাজে যোগ দেন। দ্রৌপদী ‘সৈরিন্ধ্রী’ নাম নিয়ে রাণী সুদেষ্ণার দাসী হয়ে থাকেন।
সৈরিন্ধ্রীবেশী দ্রৌপদীর সৌন্দর্য্য দেখে মোহিত হয়ে যান বিরাটরাজার সেনাপতি ও রাণী সুদেষ্ণার ভাই কীচক। দ্রৌপদীকে কুপ্রস্তাব দিতে থাকেন তিনি, শ্লীলতাহানিরও চেষ্টা করেন। নিজের সাধ্যমত প্রতিবাদ করেও কোন ফল হচ্ছে না দেখে দ্রৌপদী ভীমের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। দ্রৌপদীর অপমানের কথা শুনে রেগে গিয়ে ভীম রাতের অন্ধকারে রাজপুরীর নাচঘরে কৌশলে ডেকে পাঠিয়ে কীচককে বধ করেন। এই ঘটনার জন্য দ্রৌপদীকে দায়ী করে তাঁকে পুড়িয়ে মারতে গেলে ভীম কীচকের বাকি একশো পাঁচ ভাইকেও হত্যা করেন।
প্রবল শক্তিমান কীচকের মৃত্যুর খবর পেয়ে উল্লসিত ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা কৌরবদের সাহায্যে মৎস্যদেশ আক্রমণ করে বসেন। তাঁকে আটকাতে রাজা বিরাট তখনই সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন। অর্জুন ছাড়া বাকি চার পান্ডবও তাঁর সঙ্গে যান। অন্দরমহলে থাকায় অর্জুন যেতে পারেননি।
এদিকে এই সুযোগে কৌরবদের সঙ্গে নিয়ে রাজা দুর্যোধন বিরাটরাজার গোয়ালাদের আক্রমণ করেন ও তাদের মেরে-ধরে ষাট হাজার গরু চুরি করেন। গোয়ালারা ছুটে এসে রাজবাড়িতে সেই খবর দেয়। কিন্তু রাজবাড়িতে আর কোন যোদ্ধা তখন ছিলেন না। শুধু ছিলেন রাজপুত্র উত্তর, আর অন্দরমহলে ছিলেন রাজকন্যা উত্তরা ও তাঁর সখীরা এবং নৃত্যশিক্ষক বৃহন্নলা। এই খবর পেয়ে রাজপুত্র উত্তর মেয়েদের কাছে বাহাদুরি দেখাবার জন্য বলতে লাগলেন, “কী করি! আমার একজন ভালো সারথি নেই। যদি সারথি থাকত, তবে আমি এখনই গিয়ে কৌরবদের তাড়িয়ে দিয়ে গরু নিয়ে আসতাম। রাজপুরী ফাঁকা পেয়ে ভীতু কৌরবরা এই কাজ করছে। আমি থাকলে ওরা কিছুতেই গরু নিয়ে যেতে পারত না।” উত্তরের এই কথা শুনে অর্জুন চুপিচুপি দ্রৌপদীকে কিছু বললেন। তারপর দ্রৌপদী এসে উত্তরকে বললেন, “রাজপুত্র! বৃহন্নলা কিন্তু খুব ভালো যুদ্ধ জানেন আর রথ চালাতেও ভালো পারেন। উনি স্বয়ং অর্জুনের শিষ্য ছিলেন। উনি আপনার সারথি হলে আপনি নিশ্চয়ই যুদ্ধে জিততে পারবেন।” এই কথা শুনে উত্তর বললেন, “কিন্তু আমি নিজে কী করে বৃহন্নলাকে আমার সারথি হতে বলব?” উত্তরের কথা শুনে দ্রৌপদী রাজকুমারী উত্তরাকে বললেন বৃহন্নলাকে রাজি করানোর কথা। উত্তরার কথা বৃহন্নলাবেশী অর্জুন ফেলতে পারলেন না। তিনি উত্তরের সারথি হতে রাজি হলেন। সাজপোশাক পরে দুজনে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। যাওয়ার আগে উত্তরা অর্জুনের কাছে আবদার করলেন, “ভীষ্ম, দ্রোণ এঁদের পোশাকগুলি নিয়ে আসবেন কিন্তু! আমরা পুতুল সাজাব।” অর্জুন সম্মতি দিয়ে উত্তরকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রথ চালালেন। আস্তে আস্তে রথ এসে পৌঁছাল সেই শ্মশানের কাছে শমী গাছের তলায়, যেখানে পান্ডবদের অস্ত্রশস্ত্র লুকানো ছিল।
এতক্ষণ উত্তরের খুবই উৎসাহ ছিল, কিন্তু দূর থেকে কৌরবদের বিশাল সেনাবাহিনী দেখে ছেলেমানুষ উত্তর খুব ভয় পেয়ে গেলেন। কিছুতেই তিনি আর যুদ্ধ করতে রাজি হলেন না। অনেক বোঝানোর পর শেষে অর্জুন বললেন, “বেশ, তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে না। তুমি আমার সারথি হও। আমি যুদ্ধ করে গরু ছাড়িয়ে আনব।” তারপর অর্জুন উত্তরকে বললেন শমী গাছে উঠে অস্ত্রগুলিকে নামিয়ে আনতে। উত্তর গাছে বাঁধা ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র দেখে খুব অবাক হলেন। তখন অর্জুন বলললেন, “এই সব অস্ত্র পান্ডবদের, আর তাঁরা সবাই এই সময়ে রাজপুরীতেই আছেন।” এই বলে একে একে অর্জুন সকলের পরিচয় দিলেন। কিন্তু একথা উত্তরের বিশ্বাস হল না। তিনি বললেন, “আপনি যদি সত্যিই অর্জুন হন, তবে অর্জুনের দশটি নাম ও তাঁদের অর্থ আমাকে বলুন।” অর্জুন তখন তাঁর দশটি নাম যথা, অর্জুন, ধনঞ্জয়, বিজয়, শ্বেতবাহন, ফাল্গুনী, কিরীটি, সব্যসাচী, বীভৎসু, বিষ্ণু ও কৃষ্ণ এবং তাদের অর্থ বললেন। তখন উত্তরের বিশ্বাস হল এবং তিনি অর্জুনের কাছে নিজের ভীরুতার জন্য ক্ষমা চাইলেন। অর্জুন তাঁকে আশ্বস্ত করে গান্ডীবে টঙ্কার দিলেন এবং পাঞ্চজন্য শঙ্খে ফুঁ দিলেন।
এদিকে গান্ডীব এবং পাঞ্চজন্যের পরিচিত নাদ শুনে কৌরবরা অর্জুনকে চিনতে পারলেন। দুর্যোধনের খুব আনন্দ হল, অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার আগেই অর্জুনের খবর পাওয়া গেছে, সুতরাং আবার পান্ডবদের বনবাসে যেতে হবে। কিন্তু ভীষ্ম খুব ভালো করে হিসাব করে দেখলেন পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে পাঁচ মাস ছয় দিন সময় অতিরিক্ত হয়েছে। সুতরাং আর পান্ডবদের কোন ভয় নেই। তবে এখন অর্জুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব! তারপর ভীষ্মের পরামর্শে সৈন্যদলকে চার ভাগ করে একভাগের সঙ্গে দুর্যোধন হস্তিনার দিকে চললেন। আর এক ভাগ গরুগুলিকে দেখার জন্য রইল। বাকি দুইভাগের সঙ্গে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতিরা অর্জুনকে আটকাবার জন্য তৈরি হলেন। হঠাৎ অর্জুনের দুটি তীর এসে দ্রোণের পায়ের কাছে পড়ল আর দুটি তীর তাঁর কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। এইভাবে অর্জুন দূর থেকেই দ্রোণকে প্রণাম জানালেন এবং তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। একথা বুঝতে পেরে গুরু দ্রোণ খুব খুশি হলেন।
তারপর শুরু হল বৃহন্নলাবেশী অর্জুনের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ । দুর্যোধনের পালাবার চেষ্টা দেখে অর্জুন তাঁকেই আক্রমণ করলেন। কর্ণ অর্জুনকে আটকাতে এলে দুজনের মধ্যে লড়াই বেঁধে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্ণ হেরে পালিয়ে গেলেন। দ্রোণ এবং অশ্বত্থামা এসে অর্জুনকে আক্রমণ করলে অর্জুন তাঁদেরও ভীষণ দুর্দশা করলেন। এইভাবে প্রায় সকলেই অর্জুনের কাছে হেরে যেতে লাগলেন। কর্ণ আবার যুদ্ধ করতে এসে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। দুর্যোধন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দেখে অর্জুন ব্যঙ্গ করায় তিনি রাগের ভরে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। তাঁর সঙ্গে ভীষ্ম, দ্রোণ সবাই এসে অর্জুনকে আক্রমণ করায় অর্জুন ‘সম্মোহন’ নামে এক আশ্চর্য অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন। সেই অস্ত্র ছুঁড়ে শঙ্খে ফুঁ দেওয়ামাত্রই সকলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। অর্জুন তখন উত্তরকে বললেন, “উত্তরার জন্য দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন এঁদের গায়ের চাদরগুলি নিয়ে এসো। তবে সাবধান, ভীষ্মের কাছে যেও না, তিনি হয়তো অজ্ঞান হননি, কারণ তিনি এই অস্ত্র থামাবার সঙ্কেত জানেন।” অর্জুনের কথাই ঠিক হল। উত্তর ফিরে আসা মাত্রই ভীষ্ম আবার উঠে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু অর্জুন দশটি তীর মেরে তাঁকে হারিয়ে দিলেন। ততক্ষণে সবারই জ্ঞান ফিরেছে। অর্জুনের কাছে হেরে যাওয়ার লজ্জায় দুর্যোধন, কর্ণ প্রভৃতিরা মাথা হেঁট করে ফিরে চললেন। তখন অর্জুন সব গরুগুলিকে ফিরিয়ে আনলেন এবং এক তীর মেরে দুর্যোধনের মুকুটটি দুইভাগ করে বিজয়শঙ্খ বাজাতে বাজাতে রাজপুরীর দিকে যাত্রা করলেন। শ্মশানের কাছে এসে সব অস্ত্রগুলি অর্জুন আবার শমী গাছে তুলে রাখলেন। নিজে আবার সারথির বেশ ধরে ঘোড়ার রাশ হাতে ধরে বসলেন। রাজকুমার উত্তরকে বলে দিলেন কেউ যেন এই সব কথা জানতে না পারে। উত্তর সম্মতি দিলেন এবং তাঁরা দুজনে রাজপুরীতে ফিরে গেলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুনের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ সম্পর্কে কেউই কিছু জানল না, সকলে জানল রাজকুমার উত্তরই কৌরবদের যুদ্ধে হারিয়ে গরুগুলিকে ছাড়িয়ে এনেছেন।
তথ্যসূত্র
- ‘মহাভারত’, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বিরাটপর্ব, অধ্যায় ৩১-৬৭, পৃষ্ঠা ৩৪-৭০
- ‘ছেলেদের মহাভারত’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, বিরাটপর্ব, পৃষ্ঠা ১০০–১০৯