ধর্মরাজ ও কুন্তীর মিলনে জন্ম যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয় । কিন্তু নিজের স্বামী বেঁচে থাকতেও কুন্তী ধর্মরাজের পুত্রপ্রার্থনা কেন করেছিলেন, সেটাই আলোচনা করব।
অভিশপ্ত পাণ্ডু তপস্যা করে দিন কাটাচ্ছেন। নাগশত পর্বত থেকে এলেন চৈত্ররথে, সেখান থেকে কালকূটে, সেখান থেকে গন্ধমাদন পর্বতে। তারপর তিনি এলেন হংসকূট পর্বতে এবং সেখান থেকে শতশৃঙ্গ পর্বতে। এখানে এসে তিনি অনুভব করলেন যজ্ঞ করে দেবঋণ, বেদপাঠ ও তপস্যা করে ঋষিঋণ, দয়াপ্রকাশ করে মনুষ্যঋণ তো পরিশোধ করেছেন তিনি, কিন্তু সন্তান উৎপাদন না করে পিতৃঋণ শোধ করতে পারছেন না। এই চিন্তা পাণ্ডুকে দুঃখী করে তুলল। একদিন কুন্তীকে ডেকে তিনি বললেন, তাঁর পুত্র চাই, তা নাহলে তাঁর রাজ্যের কি হবে? কিন্তু পাণ্ডু অভিশপ্ত থাকার দরুন নিজে সন্তানের জন্ম দিতে গেলে তো মৃত্যু হবে তাঁর, তাহলে উপায়? পাণ্ডু নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে কুন্তীকে বললেন তাঁর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে, কিন্তু কুন্তী রাজী হলেন না।
কুন্তী বললেন, “আমি শুধু তোমার স্ত্রী নই গো, আমি তো তোমায় ভালওবাসি। ভালবেসেই যে বরমাল্য দিয়েছিলাম তোমার গলায়। সেই তুমি ছাড়া অন্য পুরুষের কথা আমি ভাবতে পারব না।”
পান্ডু বললেন, “তুমি তো ধর্মমতেই এ কাজ করবে। শুধুমাত্র পুত্র লাভের জন্যই তো তুমি এটা করবে।”
পাণ্ডু নিয়োগপ্রথার অনেক গল্প শোনাল কুন্তীকে। প্রত্যুত্তরে কুন্তীও তাঁকে তাঁরই ঊর্ধ্বতন পুরুষ ব্যুষিতাশ্বের কথা শোনালেন। ব্যুষিতাশ্ব মারা যাবার পর তাঁর স্ত্রী ভদ্রা মৃতপতির সাথে সঙ্গমে গর্ভবতী হয়েছিলেন। এ কাহিনী বলে কুন্তী বললেন, “যদি মৃতদেহ থেকে সন্তানলাভ হতে পাড়ে, তাহলে তোমার যজ্ঞ তপস্যাও তো কিছু কম নয়, তোমার থেকে ঠিকই পুত্র পাব আমি। কিন্তু তোমায় ছেড়ে অন্য কারও সাথে? না না! এ আমি ভাবতে পারছি না।”
কিন্তু পাণ্ডু শুনলেন না, পুত্র পাবার বাসনায় বারবার অনুরোধ করতে থাকলেন তিনি কুন্তীকে। কুন্তীকে নিয়োগপ্রথায় রাজী করানোর জন্য পাণ্ডু এবার তাঁকে নিজের জন্মবৃত্তান্ত বললেন। অবশেষে কুন্তীর মন গলল।তিনি দুর্বাসার মন্ত্রের কথা বললেন পাণ্ডুকে। পাণ্ডু তো উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলেন প্রায়। কুন্তী তাঁর মন্ত্রের মাধ্যমে কিনা দেবতাকে ডাকতে পারে, আর পাণ্ডু ভাবছিলেন কোনও ব্রাহ্মণের কথা। পাণ্ডুর মন আবারও লাফিয়ে উঠল উত্তেজনায়। আর যেহেতু পুত্র পাবার ইচ্ছাটাও পাণ্ডুরই, তাই কুন্তী সবটাই ছেড়ে দিলেন পাণ্ডুর ওপর। কুন্তী বললেন, “তুমিই বলো! কাকে ডাকব! কবে ডাকব! তুমি যেটা বলবে, সেটাই হবে ।”
পাণ্ডু আর দেরী করলেন না, সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিলেন কাকে ডাকতে হবে। তাঁর ইচ্ছায়, তাঁর কথায় দুর্বাসার মন্ত্রের সাহায্যে কুন্তী ডেকে আনলেন ধর্মরাজকে। ধর্মরাজ এলেন, জিজ্ঞেস করলেন কুন্তীকে,”বলো কি চাই।”
” পুত্র চাই।” ছোট জবাব দিলেন কুন্তী। কুন্তীকে নিয়ে তিনি শতশৃঙ্গ পর্বতের বনের ভিতরে এলেন।
ধর্মরাজ ও কুন্তীর মিলনে জন্ম নিল যুধিষ্ঠির। এইজন্য যুধিষ্ঠিরকে ধর্মপুত্র বলা হয়।
তথ্যসূত্র
- "মহাভারত সারানুবাদ", দেবালয় লাইব্রেরী(প্রকাশক সৌরভ দে, তৃতীয় প্রকাশ) - রাজশেখর বসু, আদিপর্ব (২০। যুধিষ্ঠিরাদির জন্ম - পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যু) পৃষ্ঠাঃ ৪৬-৪৭
- "মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত", আনন্দ পাবলিশার্স, পঞ্চম মুদ্রণ - ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যায় ১৩ অভিশপ্ত পাণ্ডু, পৃষ্ঠাঃ ৭৩
- "কৃষ্ণা, কুন্তী ও কৌন্তেয়", আনন্দ পাবলিশার্স, নবম মুদ্রণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, অধ্যায়ঃ কুন্তী, পৃষ্ঠাঃ ৩৬-৩৯
7 comments