মহাভারতের সম্পূর্ণ বিরাটপর্ব জুড়ে বর্ণিত আছে পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস এর কথা। পরপর দুবার পাশাখেলায় হেরে গিয়ে শর্ত অনুযায়ী পান্ডবদের মোট তেরো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হয়। এই সময়কালের শেষ বছরটি ছিল অজ্ঞাতবাস, অর্থাৎ এমনভাবে লুকিয়ে থাকা যাতে কেউ খোঁজ না পায়। যদি এই সময়ের মধ্যে কৌরবরা পান্ডবদের খবর পেয়ে যায়, তবে আবার বারো বছরের জন্য তাঁদের বনবাসে যেতে হবে।
কাম্যক বন, দ্বৈত বন ও পৃথিবীর বিভিন্ন তীর্থে ঘুরে ঘুরে পান্ডবরা বারো বছরের বনবাস জীবন কাটান। বনবাস শেষ হওয়ার পর তাঁরা সবাই মিলে ঠিক করেন যে আগামী এক বছর তাঁরা ছদ্মবেশ নিয়ে মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের আশ্রয়ে থাকবেন। যুধিষ্ঠির বনবাসে থাকার সময় লোমশ মুনির কাছে খুব ভালো করে পাশাখেলা শিখে নিয়েছিলেন। তিনি বললেন, “আমি কঙ্ক নাম নিয়ে বিরাটরাজার সভাসদ হব। বলব আমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্ৰিয় বন্ধু ছিলাম। আমি খুব ভালো পাশা খেলতে জানি।” এই কথা বলে যুধিষ্ঠির চার ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বল দেখি! তোমরা কে কী কাজ করতে পারবে?” তাঁর প্রশ্নের উত্তরে ভীম বললেন, “আমি খুব ভালো রান্না করতে পারি। তাই আমি রাঁধুনির কাজ নেব। আমার নাম হবে বল্লভ। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাঁধুনি বলে আমি নিজের পরিচয় দেব। রান্নার পাশাপাশি আমি অল্পস্বল্প পালোয়ানী করেও রাজাকে খুশি রাখব।”
অর্জুন স্বর্গে থাকার সময় গন্ধর্বদের কাছে মন দিয়ে নাচ, গান, বাজনা ইত্যাদি শিখেছিলেন। তাই তিনি বললেন, “আমি নারীবেশ ধরে রাজার অন্দরমহলে রাজকুমারীদের নাচ-গানের শিক্ষক হব। বলব আমি দ্রৌপদীর কাছে থাকতাম। এইভাবে সারাক্ষণ অন্দরমহলে থাকলে বাইরের লোকেরা আমার খবর পাবে না।” নকুল বললেন, “আমি ঘোড়ার ব্যাপারে সব বিষয় খুব ভালো করে জানি। আমি গ্রন্থিক নাম নিয়ে রাজার আস্তাবল সামলাবার কাজ নেব।” সবশেষে সহদেব বললেন, “নকুলের মতো আমি গরুর ভালো -মন্দের ব্যাপারে সবকিছু জানি। আমি তন্ত্রিপাল নাম নিয়ে রাজার গোহালে কাজ করব।” সবার কথা মন দিয়ে শুনে যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু দ্রৌপদী তো কোনদিন কোনো কষ্টের কাজ করেননি! তিনি কী করে এই এক বছর কাটাবেন?” দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, “মহারাজ! আমি বিরাটপত্নী সুদেষ্ণার কাছে সৈরিন্ধ্রী পরিচয়ে থাকব। আমি চুল বাঁধা, মালা গাঁথা, অনুলেপন তৈরি করা ইত্যাদি কাজ খুব ভালো জানি। আমার বিশ্বাস রাণী আমাকে কাজে রাখবেন। আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না মহারাজ। আমি নিরাপদেই থাকব।”
এরপর পান্ডবরা তাঁদের সমস্ত লোকজন ও চাকরদের দ্বারকায় পাঠিয়ে দিলেন এবং পুরোহিত ধৌম্য ও বাকি ব্রাহ্মণদের পাঞ্চালনগরে দ্রুপদের কাছে গিয়ে থাকতে বললেন। সবার কাছে বিদায় নিয়ে তাঁরা লুকিয়ে খুব সাবধানে মৎস্যদেশের দিকে যাত্রা করলেন। একে একে দশার্ণ, পাঞ্চাল, শূরসেন প্রভৃতি দেশ পেরিয়ে তাঁরা বিরাটনগরে এসে পৌঁছালেন। তখন তাঁদের মনে ভাবনা হল, যদি তাঁরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নগরে ঢোকেন, তবে লোকে তাঁদের চিনে ফেলবে। সুতরাং, আগে অস্ত্রগুলিকে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে।
নগরে ঢোকার মুখেই এক শ্মশানের পাশে পাহাড়ের উপরে প্রকান্ড একটি শমী গাছ ছিল। অর্জুনের পরামর্শে নকুল সেই গাছে উঠে সব অস্ত্রগুলিকে ভালো করে গাছের ডালে বাঁধলেন। যাতে গন্ধে এবং ভূতের ভয়ে কেউ সেই গাছের ধারে-কাছে না আসে তাই শ্মশান থেকে একটি মৃতদেহ এনে সেই গাছে ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর তাঁরা তাঁদের প্রত্যেকের আর একটি করে নাম রাখলেন। যুধিষ্ঠিরের নাম হল ‘জয়’, ভীমের নাম ‘জয়ন্ত, অর্জুনের নাম ‘বিজয়’, নকুলের নাম ‘জয়ৎসেন’ ও সহদেবের নাম হল ‘জয়দ্বল’। এগুলি হল তাঁদের গোপন নাম। শুধু পাঁচ পান্ডব এবং দ্রৌপদী ছাড়া আর কেউ এসব নাম জানবে না। তাই বিপদে পড়ে এর মধ্যে কোনো একটি নাম ধরে ডাকলেও কেউ কিছু বুঝতে পারবে না।
নগরে প্রবেশের আগে যুধিষ্ঠির এবং তাঁর চার ভাই মিলে আগামী দিনে সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভগবতী দুর্গার স্তব করতে লাগলেন। তাঁদের আকুল প্রার্থনায় ভগবতী সন্তুষ্ট হয়ে পান্ডবদের সামনে আবির্ভূতা হলেন এবং বললেন, “হে পান্ডবগণ! তোমাদের স্তবে আমি খুশি হয়েছি। তাই আমি তোমাদের বর দিচ্ছি যে তোমরা সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাবে এবং অজ্ঞাতবাসের সময় কৌরবেরা তোমাদের কোন খবর জানতে পারবে না।” এই বলে দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপর পান্ডবরা নগরে ঢুকে এক এক করে রাজার কাছে গিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা মত নিজেদের পরিচয় দিলেন ও যার যার কাজে নিযুক্ত হলেন। দিন কাটতে লাগল। কৌরব সারা পৃথিবী খুঁজেও পান্ডবদের কোন খবর পেল না। চার মাস পরে ‘ব্রহ্ম-মহোৎসব’-এ জীমূত নামের এক পালোয়ানকে হারিয়ে ভীম রাজার কাছ থেকে প্রচুর পুরস্কার পেলেন।
কিন্তু বিরাটরাজার সেনাপতি ও রাণী সুদেষ্ণার ভাই কীচক সৈরিন্ধ্রীবেশী দ্রৌপদীর সৌন্দর্য্য দেখে পাগলের মত হয়ে উঠলেন। তিনি বারবার দ্রৌপদীকে কুপ্রস্তাব দিতে থাকলেন। প্রথমদিকে দ্রৌপদী চুপচাপ সহ্য করতেন। ফলে কীচকের সাহস বেড়েই যেতে লাগল। তিনি রাণী সুদেষ্ণার সামনেই দ্রৌপদীকে নিজের ঘরে আসার জন্য জোর করতে লাগলেন। দ্রৌপদী গালি দিয়ে, মিনতি করে কিছুতেই তাঁর হাত থেকে রেহাই পেলেন না। একদিন রাজসভায় সবার সামনে কীচক দ্রৌপদীর হাত ধরে টানাটানি শুরু করলেন ও মাটিতে ফেলে তাঁকে লাথি মারলেন। রাজা বিরাট কীচককে খুব ভয় পেতেন, তাই তিনি কোন প্রতিবাদ করলেন না। আর সহ্য করতে না পেরে সেদিন রাত্রে দ্রৌপদী ভীমের কাছে গিয়ে সব কথা বললেন। ভীম কৌশল করে রাতের অন্ধকারে কীচককে রাজপুরীর নাচঘরে ডেকে পাঠিয়ে মল্লযুদ্ধ করে তাঁকে বধ করলেন। কীচক মারা যাওয়ার যাওয়ার পর তাঁর একশো পাঁচজন ভাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কীচকের দেহের সঙ্গে দ্রৌপদীকেও পুড়িয়ে মারবার জন্য বেঁধে শ্মশানে নিয়ে চলল। কিন্তু দ্রৌপদীর চিৎকার শুনে ভীম সেই জায়গায় এসে তাদের সকলকে গাছের আঘাতে হত্যা করলেন।
প্রবল শক্তিমান কীচকের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে উল্লসিত ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা কৌরবদের সাহায্যে মৎস্যদেশ আক্রমণ করলেন। মহারাজ বিরাট যুদ্ধযাত্রা করলে অর্জুন ছাড়া বাকি চার পান্ডবও তাঁকে সাহায্য করার জন্য যুদ্ধে যান। অর্জুন অন্তঃপুরে থাকার জন্য যেতে পারেন নি। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। এদিকে এইসময় কৌরবসৈন্যরা এসে বিরাটরাজের গোশালা আক্রমণ করে হাজার-হাজার গরুকে ধরে নিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে সারথি করে রাজপুত্র উত্তর কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যান। কিন্তু কৌরবদের বিশাল সৈন্যবাহিনী দেখে ছেলেমানুষ উত্তর ভয় পেয়ে গেলে অর্জুন উত্তরকে নিজের ও বাকি পান্ডবদের পরিচয় দেন। উত্তর একথা বিশ্বাস করতে না পেরে অর্জুনকে বলেন, “যদি আপনি সত্যিই অর্জুন হন তবে অর্জুনের দশটি নাম ও তাদের অর্থ আমাকে বলুন।” উত্তরের কথা শুনে অর্জুন তাঁর দশটি নাম যথা – অর্জুন, ধনঞ্জয়, বিজয়, শ্বেতবাহন, ফাল্গুনী, কিরীটি, বীভৎসু, সব্যসাচী, কৃষ্ণ ও বিষ্ণু এবং তাদের সব অর্থ উত্তরকে বললেন। তখন উত্তরের বিশ্বাস হল। তারপর কৌরবদের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ শুরু হয়। প্রবল যুদ্ধ হওয়ার পর কৌরবরা হেরে গিয়ে পালিয়ে যান ও গরুগুলি নিয়ে অর্জুন আবার বৃহন্নলার বেশ ধরে উত্তরকে নিয়ে রাজপুরীতে ফিরে আসেন।
এইভাবে একবছর ব্যাপী পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস সফলভাবেই শেষ হয়। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস এর শেষে তাঁদের আসল পরিচয় পেয়ে মহারাজ বিরাট অত্যন্ত খুশি হন ও রাজকন্যা উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু অর্জুন এই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তাঁর ছেলে অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। সবার অনুমতি নিয়ে অভিমন্যু ও উত্তরার বিয়ে হয়। সারা ভারত জানতে পারে পান্ডবদের কথা।
তথ্যসূত্র
- ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিং, বিরাটপর্ব, পৃষ্ঠা ৮১৪–৮৯১
- ‘ছেলেদের মহাভারত’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, বিরাটপর্ব, পৃষ্ঠা ৯৬-১১২
2 comments