মহাভারতের আদিপর্বের ৬৭তম অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই, দ্বাপর যুগের শেষভাগে অধর্ম এবং অনাচারে পৃথিবী পরিপূর্ণ হয়েছিল। মা ধরিত্রী এই বিপুল পাপের ভার সহ্য করতে না পেরে তাঁর ভার লাঘব করার আর্জি নিয়ে দেবতাদের শরণাপন্ন হন। তখন সকল দেবতা ও দানবেরা মিলে পৃথিবীতে ধর্মের পুনঃসংস্থাপন করার জন্য বিভিন্ন রাজা ও রাজপুত্র রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেন। এই সকল অবতার গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন সোমদেবের ছেলে বর্চ্চা। সোমদেব তাঁর এই ছেলেটিকে খুব ভালোবাসতেন। তাই দেবতারা যখন সোমদেবকে অনুরোধ করলেন বর্চ্চাকে প্রদান করার জন্য, তখন সোমদেব বললেন, “বর্চ্চা ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে মাত্র ষোলো বছর পৃথিবীতে থাকবেন। তাঁর ষোলো বছর বয়স হওয়ার কিছুদিন আগেই কুরুক্ষেত্রের মহাসংগ্রাম আরম্ভ হবে। সেই যুদ্ধের তেরোতম দিনে একা চক্রব্যূহে প্রবেশ করে বর্চ্চা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করবেন এবং দিন শেষ হওয়ার আগেই নিরস্ত্র অবস্থায় প্রাণত্যাগ করে পুনরায় আমার নিকট ফিরে আসবেন। পরবর্তীকালে মানবরূপী বর্চ্চার পুত্রই কুরুবংশ রক্ষা করবে। এই শর্তে যদি আপনারা রাজি হন তবেই আমি আমার পুত্র বর্চ্চাকে প্রদান করব”। দেবতারা এই শর্তে রাজি হলেন। যথা সময়ে ইন্দ্রের অংশে জন্ম নেওয়া পান্ডুর পুত্র অর্জুনের ঔরসে বাসুদেবের ভগিনী সুভদ্রার গর্ভে নতুন জন্ম হল সোমদেবের ছেলে বর্চ্চার। তাঁর নামকরণ হল ‘অভিমন্যু’।
বাবা অর্জুনের কাছ থেকে অভিমন্যু ধনুর্বিদ্যা ও সকল প্রকার শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। ক্রমে ক্রমে তিনি অর্জুনের সমকক্ষ বীর হয়ে উঠলেন। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার পর মৎস্যদেশের রাজা বিরাট রাজকন্যা উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে দিতে চাইলে উত্তরা অর্জুনের কন্যাসমা হওয়াতে অর্জুন এই বিয়ে করতে অস্বীকার করেন। তাঁর কথা অনুযায়ীই পুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে বিয়ে হয় বিরাটকন্যা উত্তরার।
অভিমন্যুকে আবার আমরা দেখতে পাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাঙ্গণে। বাবার মতোই তিনি বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর যুদ্ধ দেখে সকলেই তাঁকে অর্জুনের বিক্রমের সঙ্গে তুলনা করতে থাকেন। যুদ্ধের তেরোতম দিনে দুর্যোধনের কাছে অত্যন্ত অপমানিত হয়ে কৌরবদের সেনাপতি দ্রোণাচার্য তৈরি করলেন ভয়ঙ্কর ‘চক্রব্যূহ’। প্রতিজ্ঞা করলেন পান্ডবপক্ষের একজন মহারথীকে তিনি বধ করেই ছাড়বেন। এদিকে এই ব্যূহে প্রবেশ করার উপায় জানতেন শুধু চারজন — কৃষ্ণ, অর্জুন, কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন এবং অভিমন্যু। সেদিন কৌশল করে অর্জুনকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখল একদল কৌরবসৈন্য। অর্জুন ব্যস্ত থাকায় যুধিষ্ঠির অনুরোধ করলেন অভিমন্যু যেন ব্যূহে প্রবেশ করার পথ বানিয়ে দেন, যাতে বাকি সৈন্যরা সেই পথে ঢুকতে পারে। কিন্তু বাবার কাছে অভিমন্যু শুধু প্রবেশের সঙ্কেত শিখেছিলেন, ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় তাঁর জানা ছিল না। তবুও সাহস করে অভিমন্যু একাই চক্রব্যূহে প্রবেশ করলেন। বাকি পান্ডবসৈন্যদের আটকে দিলেন সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ। সেই চক্রব্যূহে একাকী প্রবেশ করে অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন অভিমন্যু। কিন্তু কর্ণ, দুঃশাসন, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, কৃতবর্মা, শকুনি প্রভৃতি যোদ্ধারা একসঙ্গে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। একে একে অভিমন্যুর রথ, সারথি, রথের ঘোড়া, ধনুক সবই তাঁদের অস্ত্রে কাটা গেল। তখন অভিমন্যু ঢাল ও তলোয়ার হাতে দুঃশাসনের পুত্র দ্রুমসেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। কিছুক্ষণ প্রবল যুদ্ধের পর দ্রুমসেন অভিমন্যুর মাথায় গদাঘাত করেন। সেই আঘাতেই মৃত্যু হল অভিমন্যুর। দেবতারা নিজেদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। নির্দিষ্ট সময়েই সোমদেবের পুত্র বর্চ্চা মানবরূপ পরিত্যাগ করে স্বর্গে তাঁর বাবার কাছে ফিরে গেলেন।
অভিমন্যুর মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন পান্ডবরা। অর্জুন রাগে-দুঃখে পাগল-প্রায় হয়ে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেন, “কাল আমি জয়দ্রথকে বধ করব। যদি সেই পাপী জীবিত থাকাকালীন সূর্যাস্ত হয়, তবে আমি আগুনে প্রবেশ করব।” কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উত্তরার গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন অভিমন্যুর পুত্র। কুরুবংশ ‘পরীক্ষিণ’ অর্থাৎ শেষ হওয়ার পর তাঁর জন্ম হয়েছে বলে মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর নামকরণ করলেন ‘পরীক্ষিৎ’। পরীক্ষিতকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসিয়ে দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে মহাপ্রস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন পান্ডবরা।
তথ্যসূত্র
- ‘মহাভারত’, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ, আদিপর্ব, আদিপর্ব, অধ্যায়- ৬৭, পৃষ্ঠা-৯৪
- ‘উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র’,উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ‘ছেলেদের মহাভারত’, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ, দ্রোণপর্ব, পৃষ্ঠা ২৮৪-২৮৬
আপনার মতামত জানান