পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপূজা

পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপুজো

সমগ্র উত্তর কলকাতা জুড়েই একটা অতীতের গন্ধ ছড়িয়ে আছে যেন। অলিতে-গলিতে কত না ইতিহাস, কত না ফেলে আসা সময়ের স্মৃতি ভিড় করে আসে। সামন্ততন্ত্রের যুগে কলকাতা তখন বাবুয়ানির শহর, জমিদার ‘বাবু’দের বিলাসবহুল প্রাসাদ, বনেদি বাড়ি, মুরগি-বুলবুলির লড়াই, চড়কের মেলা, স্নানযাত্রা সব নিয়ে একটা ভিন্টেজ ফ্রেম তৈরি করে যেন! আর ছিল পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজো। তাঁর গন্ধ আজও কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। সাবেক বনেদিয়ানার পুজো দেখতে কলকাতার অগুণতি মানুষ ভিড় করে বহু জায়গায়, কখনো শোভাবাজার রাজবাড়ি, কখনো হাটখোলার দত্তবাড়ি কিংবা রানি রাসমণির জানবাজারের বাড়ির বিখ্যাত সব পুজোর পাশে পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপুজোরও কিন্তু একটা ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। রবীন্দ্র সরণি থেকে শুরু করে যদুলাল মল্লিক রোড পর্যন্ত বিস্তৃত এই পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপুজো বলতে মূলত রামলোচন ঘোষের বাড়ির পুজোকেই বোঝায়। তবে এই পাথুরিয়াঘাটাতেই বিখ্যাত যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির দুর্গাপুজোও বিশেষ ঐতিহ্যসম্পন্ন।

একদিকে টেগোর ক্যাসল আর অন্যদিকে যদুনাথ মল্লিকের বাড়ি আর তার মাঝে ছিল রামলোচন ঘোষের বাড়িটি। ছিল বললে ভুল হবে, এখনও সেই একইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রাসাদোপম বাড়ি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই বাড়ির ঠাকুরদালানেই দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছে পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ বংশ। আঠারো শতকের কথা। বর্ধমান থেকে শুধুমাত্র ব্যবসা করবেন বলে কলকাতায় আসেন রামরাম ঘোষ এবং পাথুরিয়াঘাটাতে একটি বাড়ি তৈরি করেন। সময়টা তখন ১৭৮৪ সাল। রামরাম ঘোষের পুত্র রামলোচন ঘোষ কর্মজীবনে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ব্যবসা করতেন। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন বাংলার বড়লাট হন, সে সময় রামলোচন দেওয়ান পদে উন্নীত হন। তিনিই প্রথম ঘোষ বংশে দুর্গাপুজো শুরু করেন ৪৬, পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের এই বাড়িতে। রামলোচন ঘোষের তিন পুত্র শিবনারায়ণ, দেবনারায়ণ এবং আনন্দনারায়ণের হাতে পরবর্তীকালে ব্যবসা ও জমিদারির দায় বর্তায়। মেজো ছেলে দেবনারায়ণের ছেলে অর্থাৎ রামলোচনের প্রপৌত্র খেলাতচন্দ্র ঘোষ এই মূল বাড়ি ছেড়ে পাশেই আরেকটি বাড়ি করে আলাদা থাকতে শুরু করেন। আর এর পাশাপাশি ১৮৪৬ সাল নাগাদ নিজের উদ্যোগে ভিন্নভাবে একটি দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন নিজের বাড়িতে। এখনও পাথুরিয়াঘাটায় গেলে পাঁচের পল্লির খেলাত ঘোষের বাড়ির দুর্গাপুজোর পাশাপাশি সাবেক ঘোষ বাড়ির পুজোটিও দেখা যায়। যদিও এখন পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ি বলতে খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়িটিকেই বোঝায়। রামকৃষ্ণদেব থেকে শুরু করে গান্ধীজি, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিদের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে আজও বিখ্যাত এই পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপুজো। শোনা যায় নাকি, রামলোচন ঘোষের সময় ওয়ারেন হেস্টিংস স্বয়ং স্ত্রীকে সঙ্গে করে পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়ির পুজো দেখতে এসেছিলেন। ঐতিহ্যবাহী এই পুজোয় দেবীর বোধন শুরু হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে। রূপোলি ডাকের সাজে সজ্জিত মহিষাসুরমর্দিনী দেবী প্রতিমা রূপোলি তবকে মোড়া সিংহাসনের উপরে অধিষ্ঠিত থাকেন এই বাড়িতে। পুজোর সময় সমস্ত রূপোর বাসনপত্র ব্যবহার করা হয়। তবে পাথুরিয়াঘাটার দেবীর বাহন সিংহ নয়, ঘোড়া। লুচি, মিষ্টি, মালপোয়া, নারকেল নাড়ু সহযোগে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয় এখানে। উল্লেখযোগ্যভাবে পশুবলি এখানে হতো না, তার বদলে চিনির মট বলি দেওয়া হয় এখানে। সেই মট আবার আগে থেকে অর্ডার দিয়ে সুদূর কাশী থেকে আনানো হতো বানিয়ে। অষ্টমীর দিনে এক হাজার একটি পদ্ম নিবেদন করে দেবী দুর্গার পুজো হয়ে থাকে আর সেইসঙ্গে প্রতিদিনই সধবা ও কুমারীরূপে দেবী এখানে পূজিতা হন। দেবী প্রতিমার মধ্যে দেখা যায় লক্ষ্মী কিংবা সরস্বতীর কোনো বাহন নেই, বরং দশমহাবিদ্যা অনুসারে তাঁরা এখানে কমলেকামিনী রূপে পূজিতা হন। সবথেকে লম্বা আশি ফুটের ঠাকুরদালানে প্রতিমা পুজোর পরে বাঁশের উপরে প্রতিমাকে তুলে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় বিসর্জনে। তারপর বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সাতবার তোপধ্বনিতে দেবীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয় এবং কেবলমাত্র এর পরেই দেবীর বিসর্জন ঘটে। আজও সেই রীতি প্রবহমান। দীর্ঘ একশো চৌষট্টি বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও সমান ঐতিহ্য নিয়ে চলে আসছে পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজো।

তবে পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপুজো বলতে কিন্তু ঠাকুরবাড়ির পুজোটিও বাদ পড়ে না। কাছেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও সর্বজনবিদিত। পাথুরিয়াঘাটাতেও ঠাকুর পরিবারের একটি বর্ধিতাংশের বাস ছিল। তা সেই পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল দর্পনারায়ণ ঠাকুরের আমলে। দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুর সেই দুর্গাপুজোকে বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলেন এবং সেই আড়ম্বরে আকৃষ্ট হয়ে দুর্গাপুজো দেখতে আসতেন চিৎপুরের নবাব, ডিউক অফ ওয়েলিংটন কিংবা জেনারেল ওয়েলেসলি। বাঈজি নাচ, বিস্তর পান-আহারের বিলাসে পুজোয় মত্ত থাকতেন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের গোপীমোহন ঠাকুর। ঠিক এর উল্টো ছবি দেখা যেতো পাথুরিয়াঘাটার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির পুজোয়। ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরের সুরমূর্ছনায় মন্দ্রিত হতো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল। চণ্ডীর গান হতো এই পুজোর সময়েই নবমী পর্যন্ত, শুরু হত প্রতিপদে। সেই সঙ্গে যাত্রা, থিয়েটার কি ছিল না! এই আড়ম্বর এখন আর না থাকলেও বনেদি ঐতিহ্য এখনও অটুট। অনেকেই পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপুজো বলতে রামলোচন ঘোষের পুজোকেই গুরুত্ব দেন, কিন্তু পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে পা রাখলেই পরপর খেলাতঘোষের পুজো, রামলোচন ঘোষের পুজো, গোপীমোহন ঠাকুরের পুজো কিংবা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পুজো দেখে নেওয়া যায়। এই চার বাড়ির পুজোই আসলে পাথুরিয়াঘাটার পুজো।

বিভিন্ন বনেদী বাড়ির পূজা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য ভিডিও আকারে দেখুন এখানে

আপনার মতামত জানান