সববাংলায়

সরস্বতী পূজা

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাঙালিদের এইসমস্ত নানাবিধ পূজার মধ্যে একটি হল সরস্বতী পূজা। এই পূজা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।

মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা পালিত হয়। এই তিথি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয় এই দিন থেকেই শীতের অবসান এবং বসন্তের আগমন হয়। সরস্বতী পূজার পরের দিনই শীতল ষষ্ঠী ব্রত পালন করা হয়।

সরস্বতী বিদ্য়া, জ্ঞান, সঙ্গীত ও শিল্পের দেবী। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বসন্ত পঞ্চমী তিথিতেই ব্রহ্মার মুখ থেকে সরস্বতীর সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মা একসময় ধ্যানে বসে তাঁর সকল ভালো গুণকে একত্রিত করে তাকে এক নারীর রূপ দেন। তারপর নিজের মুখ থেকে দেবী সরস্বতীর সৃষ্টি করেন। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। একটি মতে দেবী হলেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পত্নী। আবার মার্কেন্ডেয় পুরাণে উল্লেখ আছে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক ভয়ঙ্কর দুই অসুরকে বধ করার জন্য যে দেবী রূপের কল্পনা করা হয়েছিল সেটি হল মহাসরস্বতী। এই অসুরদ্বয়কে বধ করতে দেবী অষ্টভূজার রূপ ধারণ করেছিলেন। দেবীর আটটি হাতে আটটি অস্ত্র ছিল। শুম্ভ নিশুম্ভ কে বধের শেষে দেবী এই অসুর দ্বয়ের মধ্যে জ্ঞানের আলো প্রদান করেছিলেন। অন্য একটি মতে সরস্বতীকে শিবের মেয়ে বলা হয়েছে। বাঙালিরাও সরস্বতীকে শিবের মেয়ে হিসাবেই পূজা করে থাকে। আবার অন্য একটি প্রচলিত মতে সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার মেয়ে। আবার পুরাণের কোথাও কোথাও সরস্বতী বিষ্ণুপত্নী। ঋকবেদে সরস্বতী নামে এক নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋকবেদের যুগে গঙ্গা ও যমুনা নদীর সেইভাবে গুরুত্ব ছিল না। সেইসময় সরস্বতী নদীই ছিল প্রধান নদী। সরস্বতী নদী ছিল এক প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি। এই নদীর তীরেই দেবতারা নানারকম যজ্ঞ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন।

আরও পড়ুন:  রানি রাসমণির পুজো

শুধু হিন্দু ধর্মেই নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। বৌদ্ধ ধর্মে সরস্বতীকে মঞ্জুশ্রী নামে আরাধনা করা হয়। তবে গবেষকদের মতে মঞ্জুশ্রী দেবী নন, বিদ্যার দেবতা।

উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সরস্বতী চতুর্ভূজা। পশ্চিমবাংলা তথা পূর্বভারতে তিনি দ্বিভূজা। এখানে দেবীর বাহন হলো রাজহাঁস। রাজহাঁস কেন দেবীর বাহন এই নিয়ে বলা হয় যে জল ও দুধের মিশ্রণ থেকে হাঁস কেবল দুধ টুকু গ্রহণ করে থাকে। ঠিক তেমনই জ্ঞানের আলো যিনি পেয়েছেন, তিনি সংসারের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় দুই বস্তুর মধ্যে বিচার বিবেচনার দ্বারা প্রয়োজনকেই গ্রহণ করতে সক্ষম। আবার হাঁস জলে বিচরণ করলেও যেমন তার দেহে জল লেগে থাকে না, তেমনই জ্ঞানের আলো যিনি পেয়েছেন, তিনি প্রতিটি জীবের মধ্যে থেকেও জীবদেহের কোনও কিছুতে তাঁর আসক্তি থাকেনা। দেবীর গায়ের রঙ সাদা। এর কারণ হিসাবে বলা হয় সাদা হল নির্মলতার প্রতীক।

প্রাচীন যুগ থেকেই দেবী সরস্বতীর পূজা প্রচলিত। সেকালের পাঠশালাগুলিতে প্রতিমাসে শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবীর বন্দনা করা হত। একটি চৌকির উপর তালপাতার দোয়াত ও কলম রেখে দেবীর বন্দনা করা হত। বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। পঞ্চমীর সকাল থেকেই দেবীর আরাধনা শুরু হয়ে যায়। দেবীর পূজায় বাসন্তী ও হলুদ রঙের গাঁদা ফুল ব্যবহার করা হয়। সকাল সকাল ছাত্রছাত্রীরা অঞ্জলি দেয়। লোকাচার অনুসারে দেবীকে অঞ্জলি দেবার আগে ছাত্রছাত্রীদের কুল খাওয়া বারণ। পুজোর দিন পড়াশোনা করা বা খাতায়, সিলেটে কোনপ্রকার লেখাও নিষেধ। ওইদিন ছাত্রছাত্রীরা তাদের বইখাতা দেবীর কাছে জমা দেয়। এইদিন দেবীর সামনে শিশুদের হাতে খড়ি প্রথা পালিত হয়। দেবীর সামনে হাতেখড়ির মাধ্যমেই শিশুর পাঠ্য জীবন শুরু করা হয়।

আরও পড়ুন:  সতীপীঠ মিথিলা

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাঁকজমকের সাথে সরস্বতী পূজা পালন করা হয়। ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে এই পূজায় অংশগ্রহণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই পুজোগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আয়োজন করে ছাত্র ছাত্রীরাই। ছাত্রছাত্রীরা শাড়ি পাঞ্জাবি পড়ে সেজে গুজে সকাল থেকেই চলে আসে। পুজোর জোগাড় থেকে শুরু করে অঞ্জলি দেওয়া অবধি তারা এই পুজোতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অনেকেই আড়ালে সরস্বতী পূজাকে বাঙালির ভ্যালেন্টাইন দিবস বলে থাকে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পূজার পর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করানো হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পাড়াতেও ধূমধাম করে এই পূজা হয়ে থাকে। অনেকে বাড়িতেও সরস্বতী পূজা করে থাকে।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন

জয় মঙ্গলবার ব্রত নিয়ে দেখুন এই ভিডিওতে



ছবিতে ক্লিক করুন