দ্বিতীয়বার পাশাখেলা এবং পাণ্ডবদের বনবাস

দ্বিতীয় পাশাখেলা ও পান্ডবদের বনবাস

মহাভারতের সভাপর্বের ৪৬তম অধ্যায় থেকে শেষ অধ্যায় অর্থাৎ ৭৯তম অধ্যায় জুড়ে বর্ণিত আছে মহারাজ যুধিষ্ঠির ও শকুনির মধ্যে পাশাখেলা এবং তার ফলস্বরূপ পান্ডবদের তেরো বছরের জন্য রাজ্য ছেড়ে বনে যাওয়ার কথা। রাজসূয় যজ্ঞের পর পান্ডবদের অতুল ধনসম্পত্তি ও প্রতিপত্তি দেখে দুর্যোধন ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। তখন মামা শকুনি তাঁকে পরামর্শ দেন পাশাখেলার মাধ্যমে পান্ডবদের সকল সম্পত্তি নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়ার জন্য। এই প্রস্তাব দুর্যোধনের খুবই পছন্দ হয় এবং তাঁরই কথামত বিদুর ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে পান্ডবদের পাশাখেলার নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন।

নির্দিষ্ট দিনে পাশাখেলা আরম্ভ হয়। ধূর্ত শকুনি ফাঁকি দিয়ে ক্রমাগত যুধিষ্ঠিরকে হারিয়ে দিতে থাকেন। বারবার হেরে যেতে থাকলেও যুধিষ্ঠিরের জেদ চেপে যায়। তিনি আস্তে আস্তে সকল সম্পত্তি এবং ভাইদের সঙ্গে নিজেকেও পণ রাখেন এবং হেরে যান। তখন দুর্যোধনের প্ররোচনায় তিনি দেবী দ্রৌপদীকে পণ রাখলে শকুনি পাশা ফেলে তাঁকেও জিতে নেন।

তখন দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন দ্রৌপদীকে চুল ধরে টানতে টানতে প্রকাশ্য রাজসভায় এনে তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। দ্রৌপদী কাঁদতে কাঁদতে সভায় উপস্থিত ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি গুরুজনের কাছে বিচার চাইলেও দুর্যোধনের ভয়ে সকলে চুপ করে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আর কোনো উপায় না দেখে দ্রৌপদী কৃষ্ণকে স্মরণ করেন। কৃষ্ণের দয়ায় দ্রৌপদীর লজ্জা রক্ষিত হয়।

এই সমস্ত আশ্চর্য ব্যাপার দেখে কৌরবেরা সকলেই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন। প্রাণের ভয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে বর চাইতে বললে তিনি দুই বরে অস্ত্রশস্ত্র সহ স্বামীদের মুক্তি চেয়ে নেন। ধৃতরাষ্ট্র তখন সকল হৃত সম্পত্তি নিয়ে পান্ডবদের সসম্মানে পান্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু এই মীমাংসা করার ব্যাপার দুর্যোধন, শকুনি ও অন্যান্য কৌরবদের মনে ধরল না। তাঁদের এতো কষ্ট বিফলে গেলো দেখে তাঁরা আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধৃতরাষ্ট্রের মত ফিরিয়ে দিলেন। ঠিক হল, আবার খেলা হবে। এবার যে হারবে, সে হরিণের ছাল পরে তেরো বছরের জন্য বনবাসে যাবে। এই তেরো বছরের শেষের বছর হবে অজ্ঞাতবাস, অর্থাৎ এমনভাবে লুকিয়ে থাকা যেন কেউ সন্ধান না পায়। সন্ধান পেলেই আবার বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে। বনবাসের পর অবশ্য আবার এসে রাজ্য পাওয়ার কথা রইল। কিন্তু দুর্যোধন ঠিক করে রাখলেন যে, একবার পান্ডবদের তাড়াতে পারলে আর রাজ্যে ঢুকতে দেবেন না। এই সূত্রেই শুরু হয় দ্বিতীয় পাশাখেলা ও পান্ডবদের বনবাস।

আবার পথের মাঝখান থেকে পান্ডবদের ডেকে আনা হল। দ্বিতীয়বারের জন্য ঠিক করা শর্তে খেলা শুরু হল। এবারেও পান্ডবরা হেরে গেলেন। সুতরাং, পণ অনুযায়ী পান্ডবদের তেরো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হল।
তাঁরা নিজেদের বহুমূল্য রাজবেশ ত্যাগ করে হরিণের ছাল পরে বনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। যাওয়ার সময় কৌরবরা সকলে মিলে পান্ডবদের বিদ্রুপ করতে লাগল। পান্ডবদের চলার ভঙ্গিমাকে কুৎসিত ভাবে অনুকরণ করতে লাগলেন দুর্যোধন। ভীম তখন রেগে গিয়ে দুর্যোধনকে বললেন যে, তাঁদের এই সকল বিদ্রুপে পান্ডবদের কোনো ক্ষতি হবে না। তিনি সকলের সম্মুখে প্রতিজ্ঞা করলেন, যুদ্ধের সময় গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরু ভঙ্গ করবেন এবং দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করবেন। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি কর্ণকে বধ করবেন। হিমালয়ও যদি নড়ে যায়, সূর্যও যদি নিভে যায়, তবুও অর্জুনের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হবে না। সহদেবও শকুনিকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করলেন। দুঃশাসনের টানে দ্রৌপদীর চুলের বেণী খুলে গিয়েছিল। তিনিও প্রতিজ্ঞা করলেন, দুঃশাসনের রক্ত দিয়ে চুল না ধোয়া পর্যন্ত তিনি আর চুল বাঁধবেন না।

যুধিষ্ঠির মিষ্টি কথায় বিনয়ের সঙ্গে সকল গুরুজনদের কাছ থেকে বিদায় চাইলেন। লজ্জায় কেউ তাঁকে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে সকলেই তাঁর মঙ্গল কামনা করলেন। বিদুরের আদেশে কুন্তীকে তাঁর বাড়িতে রেখে এলেন যুধিষ্ঠির। কুন্তী তাঁর সকল পুত্রদের এবং পুত্রবধূ লাঞ্ছিতা দ্রৌপদীকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিলেন।
বনে যাওয়ার সময় অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভয়ে ভয়ে বিদুরকে জিজ্ঞাসা করলেন পান্ডবদের চলার ভঙ্গি কেমন সে ব্যাপারে। বিদুর উত্তর দিলেন, যুধিষ্ঠির কাপড় দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে এবং ভীম নিজের দুই হাত দেখতে দেখতে চলেছেন। অর্জুন যাওয়ার পথে বালি ছড়াতে ছড়াতে চলেছেন। নকুল সারা গায়ে ধুলো মেখে রাস্তায় হাঁটছেন এবং সহদেব মাথা নীচের দিকে নামিয়ে বনে যাচ্ছেন। সকলের পিছনে দেবী দ্রৌপদী আলুথালু বসনে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে চলেছেন। পুরোহিত ধৌম্য বেদপাঠ করতে করতে তাঁদের সঙ্গে চলেছেন।

পান্ডবদের সকলের আলাদা আলাদা হাঁটার ভঙ্গির কথা শুনে বিস্মিত ধৃতরাষ্ট্র এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন বিদুর বললেন, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সকল কৌরবদের খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু তবু তাঁরা ছল করে তাঁকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিল, এই রাগে যুধিষ্ঠির মুখ ঢেকেছেন। তাঁর ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে যেন কেউ দগ্ধ না হয়, সেই কারণে তিনি চোখ বন্ধ করেছেন। ভীম নিজের বাহুবলে গর্বিত হয়ে নিজের প্রতিজ্ঞা কৌরবদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের দুটি হাত দেখতে দেখতে চলেছেন। অর্জুন আজ যেভাবে রাস্তায় বালি ছড়াতে ছড়াতে চলেছেন, ঠিক সেই ভাবেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমাগত বাণ বর্ষণ করবেন। সুপুরুষ নকুল নিজের সৌন্দর্য্য গোপন করার উদ্দেশ্যে গায়ে ধুলো মেখেছেন। যাতে কেউ চিনতে না পারে, সেজন্য সহদেব মাথা নামিয়ে চলেছেন। সবার পিছনে রজঃস্বলা রক্তাক্ত বসনা দ্রৌপদী ভাবতে ভাবতে চলেছেন, আজ যাদের জন্য তাঁর এইরকম দশা, তেরো বছর পরে তাদের রজঃস্বলা স্ত্রীরাও একইভাবে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে যাবে।
এইসকল কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত ভীত হলেন এবং নিজের দুর্মতির কথা চিন্তা করতে লাগলেন।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘মহাভারত’, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ, বনপর্ব, অধ্যায় ৪৬-৭৯, পৃষ্ঠা ৩৫৮-৩৯৬
  2. ‘উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র’,উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ‘ছেলেদের মহাভারত’, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা ২১৭-২২৫

3 comments

আপনার মতামত জানান