মহাভারতের বিরাটপর্বে তেরোতম অধ্যায়ে ভীম ও জীমূতের যুদ্ধ বর্ণিত আছে। পাশাখেলায় হেরে গিয়ে পান্ডবদের তেরো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হয়েছিল। এই বনবাস পর্বের শেষ এক বছর ছিল অজ্ঞাতবাস, অর্থাৎ এমনভাবে লুকিয়ে থাকা যাতে কেউ খুঁজে না পায়। খোঁজ পাওয়া গেলেই আবার বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে।
এই একবছর পান্ডবরা মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের আশ্রয়ে রাজপুরীতে বাস করেছিলেন। যুধিষ্ঠির কঙ্ক নাম নিয়ে বিরাট রাজার সভাসদ হয়েছিলেন। ভীম বল্লভ নামে রাঁধুনির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অর্জুন নারীবেশে বৃহন্নলা নাম নিয়ে রাজকুমারী উত্তরার নাচ-গানের শিক্ষক হয়েছিলেন। নকুল গ্রন্থিক নাম নিয়ে গোশালার রক্ষক হয়েছিলেন এবং সহদেব তন্ত্রিপাল নামে ঘোড়া দেখাশুনার কাজ নিয়েছিলেন। আর দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রী নাম নিয়ে মহারাণী সুদেষ্ণার দাসী হয়েছিলেন।
এইভাবে বিনা বাধায় চার মাস কেটে যাওয়ার পর বিরাটরাজ্যে সুবিখ্যাত ‘ব্রহ্ম-মহোৎসব’ আরম্ভ হল। এই উৎসবে চারিদিক থেকে অনেক মহাবীর মল্লযোদ্ধারা বিরাটনগরে এসে উপস্থিত হলেন। অনেক বছর থেকেই তারা রাজার সামনে নিজের নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে নিজেদের শৌর্যের পরিচয় দিয়েছেন। এই মল্লযোদ্ধাদের মধ্যে জীমূত নামে এক ক্ষমতাশালী পালোয়ান ছিল। সে এতটাই শক্তিমান ছিল যে অন্য সব মল্লযোদ্ধারা তাঁর কাছে হেরে যেত। জীমূতকে কেউ হারাতে পারছে না দেখে মহারাজ বিরাট রান্নাঘর থেকে বল্লভরূপী ভীমকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “বল্লভ! দেখ ওই ভিনদেশী পালোয়ান জীমূত অন্য সব যোদ্ধাদের হারিয়ে দিচ্ছে। এমনকী আমার রাজ্যের সুশিক্ষিত সব মল্লবীরও ওর কাছে হেরে যাচ্ছে। এমনটা বেশিক্ষণ চলতে থাকলে বিরাটনগরের ভীষণ অপমান হবে। আমি তাই চাই, তুমি যুদ্ধে নামো এবং জীমূতকে হারিয়ে দাও। আমি জানি তুমিই পারবে ওকে হারাতে।”
একথা শুনে প্রমাদ গুনলেন ভীম। রাজার আদেশ অবহেলা করলে রাজাকে অপমান করা হবে। আবার যুদ্ধে নামলে তাঁর শক্তি দেখে যদি কেউ ভীম বলে চিনে ফেলে তবে আরও মুশকিল! মৃদু প্রতিবাদ করলেন ভীম। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। তখন বাধ্য হয়ে রাজাকে প্রণাম করে মল্লযুদ্ধের ময়দানে নামলেন বল্লভবেশী ভীম। প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানালেন গর্বিত জীমূতকে।
দুই মহাবলবান মল্লযোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে রাগে উন্মত্ত হাতির মত লড়াই করতে লাগলেন। দুজনের চিৎকারে বাজ পড়া এবং পর্বত ভেঙে পড়ার মত আওয়াজ হতে লাগল। দুজনেই দুজনের দুর্বলতা খুঁজতে খুঁজতে কিল, চড়, লাথি, ঘুষি চালাতে লাগলেন। সব মল্লযোদ্ধাদের হারিয়ে জয়ী জীমূত অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারল বল্লভ কোন সাধারণ বীর নন! বেশ কিছুক্ষণ প্রবল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর আস্তে আস্তে জীমূত ক্লান্ত হয়ে পড়তে লাগল। তখন বল্লভ লোহার মুগুরের মত দুই হাত দিয়ে জীমূতকে চেপে ধরলেন এবং জীমূতকে শূন্যে তুলে ঘোরাতে শুরু করলেন। তাই দেখে বাকি সব রা এবং বিরাটনগরের বাসিন্দা ও যুদ্ধের দর্শকরা ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
একশো পাক ঘুরিয়ে পালোয়ান জীমূতকে অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে ছুঁড়ে ফেললেন বল্লভ। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীমূতের প্রাণ বেরিয়ে গেল। দর্শকরা বল্লভের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। রাজা বিরাটও ভীষণ খুশি হলেন। তিনি বল্লভবেশি ভীমের অনেক প্রশংসা করলেন এবং তাঁকে অনেক মূল্যবান উপহার দিলেন। ভীম ও জীমূতের যুদ্ধ শেষে এরপর সেখানে উপস্থিত বাকি সব মল্লযোদ্ধারাও একে একে বল্লভের কাছে হেরে গেল।
তথ্যসূত্র
- ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ, বিরাটপর্ব, অধ্যায় ১৩, পৃষ্ঠা ১৩–১৪
- ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত’, ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ‘মল্লশ্রেষ্ঠ ভীমসেন', পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৮
One comment