পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে অর্চনা গুহ মামলা এক ঘৃণ্য অধ্যায়। পুলিশি অত্যাচার ও নির্যাতনের কদর্য রূপ উন্মোচন করেছিল এই মামলা। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে থানায় তুলে নিয়ে এসে তার উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানো যায়, পুলিশি সন্ত্রাসের সেই চেহারাটা প্রকাশ পেয়েছিল সর্বসাধারণের সামনে। সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের আমলে তাঁর মদতপুষ্ট পুলিশ নকশাল দমনে উঠে পড়ে লেগেছিল। জনৈক নকশাল নেতার খোঁজ না পেয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের উপরই নির্যাতন চালায় পুলিশ। তারপর রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। সিদ্ধার্থশঙ্করের শাসন শেষ হয়ে ক্ষমতায় আসেন জ্যোতি বসু। তখন পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এই অর্চনা গুহ মামলা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল গোটা রাজ্যে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘকালীন মামলা হিসেবেও পরিচিত এই অর্চনা গুহ মামলা।
১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট কলকাতার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা হয় অর্চনা গুহ মামলা। মামলার অভিযুক্ত হিসেবে ছিলেন রঞ্জিত ওরফে রুণু গুহ নিয়োগী এবং সন্তোষ দে। অন্যদিকে এই মামলার মুখ্য অভিযোগকারিণী ছিলেন অর্চনা গুহ। মামলার বিচারপতি ছিলেন এম এন রায় এবং বেঞ্চে ছিলেন অপর বিচারক এস গুঁই। মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ৫ জুন তারিখে। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে চলেছিল এই মামলা। প্রাথমিকপর্বে অর্চনা গুহর হয়ে মামলা লড়েছিলেন অরুণপ্রকাশ চ্যাটার্জী। কিন্তু পরে সৌমেন গুহই তাঁর হয়ে আদালতের অনুমতিক্রমে সওয়াল করেন।
১৯৭৪ সালের ১৮ জুলাই এই ঘটনার সূত্রপাত হয়। পশ্চিমবঙ্গে তখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের শাসন চলছে। ইতিমধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে ইন্ধন জুগিয়ে সকলের চোখে মন্দভাজন হয়েছেন তিনি। তার উপর নকশালবাড়ি আন্দোলন দমনের জন্য লালবাজারের পুলিশদের উপর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি, নকশালদের ধরে ধরে খুঁজে হত্যা করতে হবে। সেই নির্দেশমাফিক পুলিশ নকশাল নেতা সৌমেন গুহকে হন্যে হয়েই খুঁজছিল এবং অনেক খোঁজার পরেও তাঁকে না পেয়ে পুলিশ গিয়ে পৌঁছায় দমদম অঞ্চলের জপুর রোডে তাঁর দিদির ভাড়াবাড়িতে। মাঝরাতে সেই বাড়ির দরজায় পুলিশের করাঘাত শুনে দরজা খুলে দেন সৌমেন গুহর দিদি অর্চনা গুহ। বাড়িতে সৌমেন ছিলেন না, তার বদলে উপস্থিত ছিলেন তাঁর দিদি অর্চনা, তাঁর স্ত্রী লতিকা গুহ এবং অপর এক আত্মীয়া গৌরী চ্যাটার্জী। অভিযুক্ত সৌমেনকে খোঁজার নাম করে কোনও রকম ওয়ারেন্ট ছাড়াই সমগ্র বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে জিনিসপত্র তছনছ করে পুলিশ। সিজার লিস্ট (Seizer List) তো তাদের কাছে ছিলই না, উপরন্তু একটি সাদা কাগজে উপস্থিত তিনজন মহিলাকে দিয়েই সই করিয়ে নেওয়া হয় এবং তাদের পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কাশীপুর থানায়। সেই সময় অর্চনা গুহ ছিলেন একটি জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং সৌমেন গুহর স্ত্রী লতিকা একটি কলেজে পড়াতেন। কাশীপুর থানা থেকে ভোর হওয়ার আগেই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজার থানায়। সেখানে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার রুণু গুহ নিয়োগীর অফিস ও টর্চার চেম্বারের সংলগ্ন স্পেশাল সেলে তাঁদের রাখা হয়। এদের কাউকেই পুলিশ পরদিন আদালতে পেশ করেনি, বরং স্পেশাল সেলেই আটক করে রেখেছিল। পরে মানস নামের এক পুলিশ একে একে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়, অর্চনা গুহর সমস্ত পরিচয়, কর্মজীবন সম্পর্কে তথ্য জানার পর একটি কাগজে লেখা কয়েকজনের নাম দেখিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় যে তিনি তাদের চেনেন কিনা। অর্চনা গুহ সকলকেই চিনতে অস্বীকার করেন। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ রুণু গুহ নিয়োগী অফিসে এলে তাঁরই নির্দেশে গৌরী চ্যাটার্জীকে প্রথমে টর্চার চেম্বারে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতের কনুই ও পায়ের হাঁটুর ভাঁজের মধ্যে লাঠি ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাঁকে মাথা নিচে ও পা উপরে করে রাখা হয়েছিল। এরপরে ঠিক একইভাবে অর্চনা গুহকেও ঝুলিয়ে রাখা হয়। কমল নামের এক পুলিশ গৌরী চ্যাটার্জীর পায়ে ক্রমান্বয়ে লাঠির বাড়ি মারতে থাকেন এবং অর্চনা গুহকে হুমকি দেন যে তিনি যদি সব তথ্য না জানান, তাহলে তাকেও একইভাবে নির্যাতন করা হবে। সেই পুলিশ তারপর রুণু গুহ নিয়োগীর নির্দেশে লতিকা গুহর গালে প্রচণ্ড জোরে চড় মারতে থাকেন। কনস্টেবল সন্তোষ দে অর্চনা গুহকেও একইভাবে বেঁধে ঝুলিয়ে দেন এবং লাঠি দিয়ে পায়ের তলায় মারতে থাকেন। একইসঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকাও দেওয়া হয় বেশ কয়েকবার। যন্ত্রণাকাতর অর্চনা এত নির্যাতনের কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে অর্চনাকে পুলিশ টানতে টানতে রুণু গুহ নিয়োগীর অফিসে নিয়ে যান এবং সেখানে উপস্থিত গৌরী, লতিকা, অর্চনা নিজেও সেসময় কার্যত পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন। ১৮ জুলাই রাত ৮টা নাগাদ স্পেশাল সেলের সেন্ট্রাল লক-আপে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের তিনজনকেই এবং সেখানেই রাত কাটান তাঁরা। ১৯ জুলাই শিয়ালদা আদালতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলেও কাউকেই বিচারকের সামনে পেশ করা হয়নি। আদালতে তাঁদের নামের বদলে ভুয়ো নাম দেওয়ার কারণে আদালতে কেউই তাঁদের জামিনের আবেদন করেননি। পুনরায় গৌরী চ্যাটার্জী, লতিকা গুহ এবং অর্চনা গুহকে নিয়ে যাওয়া হয় স্পেশাল সেলে। সেখানে তাঁদের উপর প্রবল অত্যাচার চলে। মেরে মেরে তাঁদের নিম্নাঙ্গ অকেজো করে দেওয়া হয়। অনেক বলেন পুলিশ স্পেশাল সেলের মধ্যেই অর্চনা গুহকে ধর্ষণও করেছিল। ১৯৭৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে ঐ বছরই ১৩ আগস্ট পর্যন্ত অর্চনা গুহ-র সঙ্গে লতিকা গুহ এবং গৌরী চ্যাটার্জীকে লক-আপে বন্দি রাখা হয়েছিল। এই সময় তাঁদের সঙ্গে কাউকেই দেখা করতে দেওয়া হয়নি। নির্মম অত্যাচার, কখনও কখনও কুৎসিত গালিগালাজ, জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকায় প্রত্যেকেই মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিলেন। লক-আপে থাকাকালীনই অর্চনা গুহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ১৩ আগস্ট তাঁদের তিনজনকেই একত্রে প্রেসিডেন্সি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে অর্চনা গুহকে পুলিশ চুলের মুঠি ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল একদিন, আবার সেদিনই চুলের মুঠি ধরে তাঁকে ঝুলিয়েও রাখা হয়। একটা সাদা কাগজে সই করতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। পরে সেই কাগজে পুলিশ নিজের মর্জি অনুযায়ী একটা সিজার লিস্ট বানিয়ে বে-আইনি জিনিস রাখার অপরাধে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর তৎপরতায় পাশ হওয়া ‘মেইন্টেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বা ‘মিসা’ (MISA)-র আওতায় ফেলা হয় তাঁদের। ফলে দীর্ঘ তিন বছর কারাবাস করতে বাধ্য হন অর্চনা গুহ ও অন্যান্যরা। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত সৌমেন গুহও ধরা পড়েছিল পুলিশের হাতে। ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অর্চনা গুহ, লতিকা গুহ, গৌরী চ্যাটার্জী এবং সৌমেন গুহ সকলেই ছাড়া পান। ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রুণু গুহ নিয়োগী এবং তাঁর সহকর্মী চার পুলিশের বিরুদ্ধেই অর্চনা গুহ এই মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়ের করার পরেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার তত্ত্বাবধানে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় অর্চনা গুহকে। তার আগে যদিও বেশ কয়েকবার স্ট্রেচারে করেই আদালতে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি। অভিযুক্ত রুণু গুহ নিয়োগী, সন্তোষ দে এবং আরও দুজন পুলিশ-কর্মীর বিরুদ্ধে ভারতীয় সংবিধানের ১৬৬, ৩৪৮, ৩২৪, ৩৩০ এবং ৫০৯ ধারায় অপরাধের আরোপ আনা হয়। কিন্তু রুণু গুহ নিয়োগী বিভিন্ন আদালতে আবেদন করে এই অর্চনা গুহ মামলা স্থগিত রাখতে সচেষ্ট হয়। তাই দীর্ঘ ১৯ বছর পরে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হয় এই মামলার। রুণু গুহ নিয়োগীর তরফে বিপক্ষ যুক্তি ছিল –
ক) অর্চনা গুহর বয়ানে যে অত্যাচারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা কোনও মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
খ) সরকারি কৌঁসুলি হওয়ার পরেও অরুণপ্রকাশ চ্যাটার্জী কীভাবে অর্চনার পক্ষে মামলা লড়তে পারেন?
গ) রুণু গুহ নিয়োগী দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই নারী নির্যাতন মঞ্চ কীসের ভিত্তিতে তাঁকে অপরাধী প্রমাণিত করার জন্য জনমত গড়ে তুলছে?
ঘ) ১৯৮৮ সালে ক্রিমিন্যাল ল-এর সংশোধনীতে ২৪৫/৩-এর যে ধারা নতুন যুক্ত করা হয় তাতে বলা হয়েছিল, মামলা দায়ের করার চার বছরের মধ্যে সাক্ষ্য-প্রমাণ সমস্ত দাখিল না হলে সেই মামলা খারিজ হয়ে যাবে। রুণু গুহ নিয়োগী এই ধারাটিকেই ঢাল করে মামলা খারিজ করার চেষ্টা করতে থাকেন।
১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চ নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ডি এস রায় এই মামলা খারিজের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও ঐ বছরই ১৫ জুলাই কলকাতা উচ্চ আদালতের বিচারপতি অজিত রায় এই মামলা খারিজ করেন। পুনরায় সৌমেন গুহ এই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেন এবং ১৯৯০ সালে বিচারক এম এন রায় ও এস গুঁই পূর্বোক্ত রায়কে অস্বীকার করেন। অবশেষে মামলা ওঠে সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে ১৯৯৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে এরপর আর কোনও অভিযুক্তের আবেদন স্বীকার করা হবে না এবং অন্য কোনও আদালত এই মামলায় হস্তক্ষেপ করবে না। দ্রুত কলকাতা উচ্চ আদালতে বিচারের মধ্য দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু এরপর অমিয় চক্রবর্তী কিংবা অরুণপ্রকাশ চ্যাটার্জী কাউকেই ভরসা করতে না পারায় সৌমেন গুহ নিজেই অর্চনা গুহর হয়ে মামলা লড়ার আবেদন জানান। ১৯৯৬ সালের ৫ জুন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দিনে অভিযুক্ত রুণু গুহ নিয়োগী ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের ১৬৬, ৩৪৮, ৩২৮, ৩৩০ ও ৫০৯ ধারার সবকটি অপরাধই প্রমাণিত হয়। অথচ বিচারে রুণু গুহ নিয়োগীর মাত্র এক বছর কারাবাস হয়। অদ্ভুতভাবে বাম শাসনকালে তাঁর এত ঘৃণ্য নির্যাতনের কথা জানাজানি হওয়ার পরেও সরকারি মহলে পদোন্নতি হয়েছিল রুণু গুহ নিয়োগীর। পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন পুলিশি নির্যাতনের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিল এই অর্চনা গুহ মামলা।