আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ভাষা, এর শব্দ ও সাহিত্য ভান্ডার অপরিসীম। যেকোনো উৎকৃষ্ট ভাষার একটি প্রধান সম্পদ হলো প্রবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে proverb। বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকেই অনেক প্রবাদ লোকমুখে বা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই রকমই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল “কুম্ভকর্ণের ঘুম”। এই প্রবাদের অর্থ, যে ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত ঘুমান। সহজে ঘুম ভাঙানো যায় না সেই ব্যক্তির ঘুম কুম্ভকর্ণের ঘুম নামে পরিচিত। কুম্ভকর্ণ ছিলেন রাবণের ভাই। রামায়ণের যুদ্ধেও কুম্ভকর্ণের উল্লেখ আছে। এই প্রবাদটির সাথে রামায়ণের যোগ রয়েছে অর্থাৎ প্রবাদটির উৎপত্তি রামায়ণের সময়কালেই।
কুম্ভকর্ণ ছিলেন রাক্ষসরাজ সুমালীর কন্যা কৈকসীর সন্তান। কৈকসী ছিলেন চার সন্তানের জননী। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, শুপর্ণখা ও বিভীষণ। কুম্ভকর্ণ ছিলেন আকার ও আয়তনে বিশাল বড়, সাথে তাঁর ক্ষুধার পরিমাণও ছিল বিশাল মাপের। জন্মের পরেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য কুম্ভকর্ণ রাজ্যের প্রায় সহস্র প্রজাদের ভক্ষণ করেছিলেন। কুম্ভকর্ণ স্বর্গেরও অনেক দেবতাসহ অপ্সরাদেরও ভক্ষণ করেন। দেবরাজ ইন্দ্র কুম্ভকর্ণের নানা কান্ডে অস্থির হয়ে একবার তাকে ব্রজের আঘাত করেছিলেন। কুম্ভকর্ণ ছিলেন মহাবলশালী ও দৈত্যআকৃতির। কিছু সময় পর মহাবলশালী কুম্ভকর্ণ অমরত্ব লাভ করার জন্য গোকর্ণ আশ্রমে গিয়ে ব্রহ্মাদেবের তপস্যা শুরু করেন। কুম্ভকর্ণের তপস্যায় স্বর্গের দেবতারা ভয় পেয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। তারা জানান কুম্ভকর্ণ এর মধ্যেই স্বর্গ মর্ত্য সহ ঋষিকূলকেও ভক্ষণ করেছে, তার উপর অমরত্বের বর প্রাপ্ত হলে কুম্ভকর্ণ ত্রিভুবন গ্রাস করবে। এইদিকে কুম্ভকর্ণের তপস্যায় পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ভস্ম হবার উপক্রম হয়। ব্রহ্মা পড়েন মহাসঙ্কটে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর ব্রহ্মা সরস্বতীদেবীকে কুম্ভকর্ণের কণ্ঠে স্থান নিয়ে কুম্ভকর্ণের কথা পরিবর্তন করে ব্রহ্মার সুবিধামত কথা বলবার অনুরোধ করেন। দেবী সরস্বতীও ব্রহ্মার কথামতো তাই করলেন। এর ফলে কুম্ভকর্ণ অনন্ত জীবনের পরিবর্তে অনন্ত নিদ্রা প্রার্থনা করে বসেন। ব্রহ্মাও খুশি হয়ে কুম্ভকর্ণকে তাই বর প্রদান করলেন। ব্রহ্মা বর প্রদান করে চলে যাবার পর কুম্ভকর্ণের চৈতন্য হলো তিনি ব্রহ্মার কাছে কি বর চেয়েছেন এবং এতে যে দেবতাদের ফন্দি ছিল সেটা কুম্ভকর্ণ বুঝতে পারেন। তিনি আবারও ব্রহ্মার তপস্যা করলেন ও আবার সরস্বতী কুম্ভকর্ণের কণ্ঠে ভর করাতে তিনি বলে বসলেন আমি যেন একটানা ছয়মাস নিদ্রাসুখ ভোগ করে একটি দিন মন ভরে ভোজন করতে পারি। ব্রহ্মা খুশি হয়ে তাই বর প্রদান করলেন। সাথে এটাও বললেন ছয় মাসের আগে তোমার নিদ্রা ভঙ্গ হলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত হবে।
রামের সাথে রাবণের যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় সেনাপতি শূন্য হয়ে রাবণ কুম্ভকর্ণকে যুদ্ধে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরজন্য বিশাল সৈন্য দিয়ে বাজনা বাজিয়ে রাবণ কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন। ছয় মাসের আগেই ঘুম ভাঙাতে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কুম্ভকর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো যুদ্ধ করেছিলেন। অবশেষে রামের নিক্ষিপ্ত বাণে কুম্ভকর্ণ প্রাণ হারান।
বলাবাহুল্য কুম্ভকর্ণ ছিলেন মহাবীর। কিন্তু ছয় মাস ঘুমিয়ে থাকার কারণে তাঁর মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি অনেকটাই ক্ষয় হয়েছিল এবং তাঁর বীরত্ব সবসময় কাজে লাগানোও যেত না।
উদাহরণ – সরকারি দপ্তরের কাজের গতি দেখে মনে হয় যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম – ছমাসে একদিন কাজ এগোয়!
তথ্যসূত্র
- প্রবাদের উৎস সন্ধান - সমর পাল, শোভা প্রকাশ / ঢাকা ; ৪৭-৪৮ পৃঃ