বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্শাল আর্টিস্ট এবং একইসঙ্গে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রাভিনেতা হলেন ব্রুস লি (Bruce Lee)। হলিউড চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় মার্শাল আর্ট প্রদর্শন করে সাড়া জাগানো জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিলেন ব্রুস লি। একজন এশীয় হয়েও পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন তিনি, ‘পপ’ সংস্কৃতির একজন তারকা হয়ে উঠেছিলেন একাধারে মার্শাল আর্ট শিল্পী-প্রশিক্ষক এবং দার্শনিক ব্রুস লি। মার্শাল আর্টের ধারায় তিনিই প্রথম এক মিশ্র মার্শাল আর্টের উদ্ভাবন করেন যার নাম তিনি দেন ‘জিত-কুন-দো’ (Jeet-Kune-Do)। শুধুই লড়াইয়ের কৌশল, গুপ্ত-রহস্য অর্জন নয়, তার পাশাপাশি মার্শাল আর্টের এক গভীর দার্শনিকতার দ্বার উন্মোচনে ব্রুস লি অতুলনীয়। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির ব্যবধান ঘুচিয়েছিলেন এই আশ্চর্য ক্ষমতাধর মার্শাল আর্টিস্ট
১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর সানফ্রান্সিসকোর চিনা পাড়ায় ব্রুস লি’র জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম লি-জুন-ফান (Lee Jun-Fan)। চিনা রাশিচক্র অনুযায়ী তিনি ড্রাগনের সময় এবং বছরে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁর মধ্যে একজন শক্তিশালী ও ভাগ্যবান মানুষের সম্ভাবনা দেখা যায়। তাঁর বাবার নাম লি হোই চুয়েন (Lee Hoi-Chuen) এবং মায়ের নাম গ্রেস হো (Grace Ho)। তাঁর বাবা সেকালের ক্যান্টোনিজ অপেরার একজন তারকা ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম হলেও ব্রুস লি পরে মাত্র তিনমাস বয়সে হংকং-এ তাঁর বাবা-মায়ের কাছে কুলুং শহরে চলে আসেন। সেই শহরেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। বাবার সঙ্গে যেতে যেতেই তিনি চলচ্চিত্র-দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হন এবং ঐ ছোটো বয়সেই শিশু অভিনেতা হিসেবে বহু ছবিতে অভিনয় করেন। শিশু বয়সে তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র হল ‘গোল্ডেন গেট গার্ল’। নয় বছর বয়সে ১৯৫০ সালে ব্রুস লি তাঁর বাবার সঙ্গে ‘দ্য কিড’ ছবিতে সহ-অভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং দেখা যায় যে আঠারো বছর বয়সে তিনি প্রায় ২০টি ছবিতে অভিনয় করে ফেলেন।
তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় কুলুং শহরের টাক্ সুন্ স্কুলে। তারপর ১২ বছর বয়সে ক্যাথলিক লা সালে কলেজে (La Salle College) তিনি উচ্চ-প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। তবে পড়াশোনায় ভালো ফল না করায় তাঁকে ১৯৫৬-তে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে ব্রাদার এডওয়ার্ড ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক যিনি সেই স্কুলের বক্সিং দলের কোচও ছিলেন। তিনি ১৮ বছর বয়সে সিয়াটেলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাড়ি দেন বলে জানা যায়। আর এই সময় থেকেই তিনি মার্শাল আর্ট শেখাতে শুরু করেন। জানা যায় যে, তাঁর বাবার আগ্রহে ইপ ম্যানের (Yip Man) প্রশিক্ষণে তিনি মার্শাল আর্ট শিখতে থাকেন। উইং চুন (Wing Chun) নামক বিশেষ মার্শাল আর্টে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৫৮ সালে ব্রুস লি হংকং-এর ‘স্কুল বক্সিং টুর্নামেন্ট’ জেতেন এবং গতবারের স্কুল চ্যাম্পিয়নকেও পিছনে ফেলে রেকর্ড করেন। তবে উচ্চশিক্ষার কারণেই যে শুধু ব্রুস আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলেন তা নয়, রাস্তাঘাটে প্রায়শই অন্যায় মারামারি করার জন্য পুলিশের সতর্কীকরণে তাঁর বাবা তাঁকে বড় বোন অ্যাগনেস লি’র কাছে সানফ্রান্সিসকোয় পাঠিয়ে দেন। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি রুবি চৌ-এর রেস্তোরাঁয় তিনি বেয়ারার কাজও করেছেন। এখানেই মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দিতে দিতে সিয়াটেলে ব্রুস লি তাঁর প্রথম মার্শাল আর্ট স্কুল স্থাপন করেন যার নাম দেন ‘লি জুন ফান গুং ফু ইনস্টিটিউট’ (Lee Jun Fan Gung Fu Institute)। ১৯৬০ সালে সিয়াটেলের এডিসন টেকনিক্যাল স্কুল থেকে ব্রুস লি ডিপ্লোমা সম্পূর্ণ করেন এবং ১৯৬১-তে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, মনস্তত্ত্ব এবং নাট্যকলার মতো বিষয় নিয়ে ভর্তি হন। এরপর শুরু হয় তাঁর মার্শাল আর্ট চর্চা ও প্রশিক্ষণ।
কলেজের পড়াশোনা মাঝপথেই ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৪ সালে জেমস ইয়েম লি’র সঙ্গে ব্রুস অকল্যাণ্ডে চলে আসেন যেখানে আমেরিকান মার্শাল আর্টিস্ট এড পার্কারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এড পার্কারের আমন্ত্রণে তিনি ঐ বছরই ‘লং বিচ ইন্টারন্যাশনাল ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ যোগ দিয়ে জয়লাভ করেন। ব্রুস সেখানে তাঁর বিখ্যাত ‘ওয়ান ইঞ্চ পাঞ্চ’ কিংবা ‘ নন-টেলিগ্রাফিক পাঞ্চ’ প্রয়োগ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন দর্শকদের। এরপর ধীরে ধীরে মার্শাল আর্টের জন্য তিনি টিভি সিরিজ এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেও শুরু করেন। ‘দ্য গ্রিন হর্নেট’ নামে একটি টিভি ধারাবাহিকে তিনি প্রথম একজন মার্শাল আর্টিস্ট হয়ে অভিনয় করেন এবং আমেরিকান ধারাবাহিকে এশীয় মার্শাল আর্টের প্রদর্শন করেন। ১৯৭১ সালে ‘দ্য বিগ বস’ ছবিতে তিনি প্রথম মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করে বক্স অফিসে বিরাট ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দেন প্রযোজককে এবং সেই থেকেই একজন তারকায় পরিণত হন ব্রুস লি। তারপর ১৯৭২ সালে একে একে ‘ফিস্ট অফ ফিউরি’ ( Fist of Fury), ‘ওয়ে অফ দ্য ড্রাগন’ (Way of the Dragon) ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করে এবং মার্শাল আর্ট প্রদর্শন করে ব্রুস লি প্রভূত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘ওয়ে অফ দ্য ড্রাগন’-এ তাঁর এবং অপর আরেক ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন জ্যাক নরিসের মার্শাল আর্ট প্রদর্শনের দৃশ্যটি বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্শাল আর্টের দৃশ্য হিসেবে আজও পরিচিত। ঐ বছরই ‘গেম অফ ডেথ’ নামে আরেকটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। ইতিমধ্যে ওয়ার্নার ব্রাদারসের আহ্বানে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ ছবিতে অভিনয় করেন ব্রুস লি যা ১৯৭৩ সালে মুক্তি পেলে বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম সর্বাধিক ব্যবসা করে, প্রায় সাড়ে তিনশো মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করে এই ছবিটি ব্রুস লি’কে এক কিংবদন্তীতে পরিণত করে। তাঁর নির্মিত হংকং এবং হলিউড-প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলি ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্টের চলচ্চিত্র ধারার অনেক উন্নতিসাধন করেছে এবং চলচ্চিত্রগুলিকে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছে। ১৯৭০ সাল নাগাদ তাঁর মাধ্যমেই চিনের মার্শাল আর্ট আমেরিকাসহ পশ্চিমের দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলিতে প্রচারিত চৈনিক জাতীয়তাবাদ এশীয় আমেরিকানদের মধ্যে চিনের এক অন্যতম ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছে। জানা যায় যে, ‘গেম অফ ডেথ’ ছবি তৈরির সময় অব্যবহৃত ভিডিও ক্লিপগুলি পরে ব্রুস লি’র জীবনকেন্দ্রিক একটি তথ্যচিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল যার নাম ‘ব্রুস লি : আ ওয়ারিয়র্স জার্নি’ (Bruce Lee : A Warrior’s journey)। মার্শাল আর্ট ছাড়াও ব্রুস লি দর্শনের চর্চাও করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের মূল ভিত্তিগুলি তাঁর জ্ঞাতার্থে ছিল। মার্শাল আর্টের উপর বই লেখার পাশাপাশি সংঘাতের দর্শন (fighting philosophy) সম্পর্কেও নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছেন। আজীবন নাস্তিক দর্শনে বিশ্বাসী ব্রুস লি কবিতাও লিখেছেন। তাঁর কবিতা আধুনিক সাহিত্যধারার নিরিখে ‘প্রতি-কবিতা’ (Anti-poetry)-র সমতুল্য।
বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ব্রুস লি, পেয়েছেন বহু সম্মান আর অসম্ভব জনপ্রিয়তা। ১৯৯৪ সালে হংকং-এ তিনি মরণোত্তর ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পান। ২০০৪-এ পান ‘স্টার অফ দ্য সেঞ্চুরি অ্যাওয়ার্ড’। শ্রেষ্ঠ মান্দারিন চলচ্চিত্রের জন্য ‘গোল্ডেন হর্স অ্যাওয়ার্ড’ পান ব্রুস লি ১৯৭২ সালে। তাঁর স্মৃতিতে ২০১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস-এ এবং ২০১৫ সালে হংকং-এ বিশাল মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। এত জনপ্রিয়তার পাশাপাশি প্রত্যাখ্যানও সঙ্গী হয়েছিল ব্রুস লি’র। তাঁর ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ এবং ‘ফিস্ট অফ ফিউরি’ ছবিদুটি আধ্যাত্মিক অবনমন এবং বাম-বিরোধী মনোভাবের কারণে মাও-সে-তুং নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। হলিউডের মার্শাল আর্টের চলচ্চিত্রে একসময় দাপিয়ে বেড়ানো ব্রুস লির মৃত্যু নিয়ে আজও রহস্য ঘনীভূত। কেউ বলেন হাশিস ও ক্যানাবিস নামক মাদক উচ্চ মাত্রায় সেবনের ফলে মস্তিষ্ক ফুলে গিয়েছিল ব্রুসের। ব্রুস লি-র মৃত্যুর কারণ নিয়ে সবথেকে জোরালো ব্যাখ্যা দেওয়া হয় মার্শাল আর্টের ‘দ্য আয়রন ফিস্ট’ নামের একটি আচার-অনুষ্ঠানকে। আয়রন ফিস্ট মার্শাল আর্টের এক পুরাতন কৌশল যার আঘাতে একজন ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পতিত হন। অনেকে একে ‘ডেথ টাচ্’ও বলে থাকেন। ব্রুসের মৃত্যুতে সারা বিশ্ব শোকগ্রস্ত হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৩২ বছর বয়সে সেরিব্রাল ইডিমায় মস্তিষ্ক ফুলে গিয়ে ব্রুস লি’র মৃত্যু হয়।
2 comments