রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

ভারতের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় সাহসী ব্যক্তিত্ব রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় (Ramananda Chattopadhyay)। মূলত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই আপামর বাঙালির কাছে তিনি পরিচিত হয়েছেন, কিন্তু ‘প্রবাসী’ ছাড়াও ‘প্রদীপ’, ‘মডার্ন রিভিউ’ ইত্যাদি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি। ভারতের ইংরেজি-বলা মানুষদের উপর এত গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় যে লিগ অফ নেশনস তাঁকে ১৯২৬ সালে জেনেভার সাধারণ সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর এক গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁর সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বভারতীর অবৈতনিক অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ পদেও আসীন ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

১৮৬৫ সালের ২৯ মে বাঁকুড়ার পাঠকপাড়ায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম ছিল হরসুন্দরী দেবী। তাঁর পিতৃকুলের অনেকেই সংস্কৃত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁর ঠাকুরদাদা রামলোচন চট্টোপাধ্যায় বর্ধমানের একটি চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করতেন। শ্রীনাথ এবং হরসুন্দরীর তৃতীয় পুত্র ছিলেন রামানন্দ। তাঁর অন্য তিন ভাইয়ের নাম ছিল যথাক্রমে রামশঙ্কর, রামেশ্বর ও বারাণসী। ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন রামানন্দ এবং এই অভ্যাস পরবর্তী অনেক বছর পর্যন্ত চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৮৮৬ সালে কলেজের চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বাঁকুড়া ওঁদা গ্রামের হারাধন মিশ্রের কন্যা মনোরমার সঙ্গে রামানন্দের বিবাহ হয়। মনোরমার বয়স ছিল তখন মাত্র বারো বছর। পরে রামানন্দের উদ্যোগেই যত্ন নিয়ে বাড়িতেই তাঁকে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা শেখানো হয়।  

জ্যাঠামশাইয়ের এক চতুষ্পাঠীতেই বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয় রামানন্দের। পরে তিনি ভর্তি হন বাঁকুড়া জেলা স্কুলে। বাঁকুড়ার বাংলা মাধ্যম স্কুলের সেরা ছাত্র ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। মাত্র দশ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ করে বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি মাসিক চার টাকা বৃত্তি লাভ করেন। সেই স্কুলে গণিতের শিক্ষক কেদারনাথ কুলভীর কাছেই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথা শুনেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদা দেবীর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। এই কেদারনাথ কুলভীর প্রভাবেই কিশোর বয়স থেকেই ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। তাঁর বাড়ির কাছেই যে ব্রাহ্মমন্দির ছিল, সেখানে প্রায়ই উপাসনায় যোগ দিতেন রামানন্দ। সহকারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তথা বাঁকুড়া জেলা স্কুল কমিটির সভাপতি রমেশচন্দ্র দত্ত ইংরেজি পরীক্ষায় ভাল ফল করার জন্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে ‘এ ডিকশনারি অফ ইউনিভার্সাল বায়োগ্রাফি’ নামে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। ১৮৮২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন এবং মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পান। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং সেই সময় তাঁর বৃত্তির টাকা থেকেই কলেজের বেতন সহ থাকা-খাওয়া ও বইপত্র কেনার খরচ চালাতেন তিনি। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পরীক্ষা পাশ করেন তিনি। তবে এখানে তাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে লাতিন ভাষা শিখতে হয়েছিল। সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদার অধ্যাপকদের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। এফ এ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করে আবার মাসিক ২৫ টাকা বৃত্তি পান রামানন্দ। তারপর তৃতীয় বর্ষে পুনরায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি এবং সেই সময় চার্লস টনি, আচার্য জগদীশচন্দ্র প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। ১৮৮৭ সালে বি.এ পরীক্ষায় প্রস্তুতি ভাল না থাকায় কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষাই দেননি রামানন্দ। ঐ সময়েই কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ১৮৮৮ সালে পৈতে ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে সিটি কলেজ থেকে ১৮৮৮ সালেই বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইংরেজি সাম্মানিকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে রিপন বৃত্তি লাভ করেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের বদান্যতায় ঐ কলেজেই অবৈতনিক সহকারী অধ্যাপকের পদে যোগ দেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এই কলেজ থেকেই ১৮৯০ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রামানন্দ। এই পরীক্ষাতেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সুবর্ণপদক লাভ করেন তিনি। টানা দুই বছর এই কলেজে বিনা বেতনে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। পরে অর্থকরী সাহায্যের আবেদন জানালে কলেজ কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে মাসিক ১০০ টাকা বেতনের ব্যবস্থা হয় তাঁর। এই কলেজে অধ্যাপনার সময় একাধারে ‘ধর্মবন্ধু’ পত্রিকা সম্পাদনা, ‘দাসাশ্রম’ নামে একটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের কার্য পরিচালনা এবং এই প্রতিষ্ঠানেরই মুখপত্র ‘দাসী’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন তিনি। এই সময় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ১৮৯২ সালে ‘দাসাশ্রম’ প্রতিষ্ঠানের একটি ‘সেবালয়’ স্থাপিত হয় যার সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ। তাঁর উৎসাহে ও উদ্যোগেই তাঁর শিক্ষক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর প্রবন্ধ ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ প্রকাশিত হয় ‘দাসী’ পত্রিকায়। জনসেবামূলক নানাবিধ কাজে নিয়োজিত ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাংলা ব্রেইল বর্ণমালা তিনি নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন। দাসী পত্রিকাতেই ভারতে পাশ্চাত্যের অনুরূপে কীভাবে অন্ধদের শিক্ষা দেওয়া যায় সে বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি এবং পাশ্চাত্যের ব্রেইলের অনুকরণে রামানন্দ বাংলা ব্রেইল উদ্ভাবন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই ব্রেইল বর্ণমালার কার্যকরী প্রয়োগ ঘটেনি কারণ সেই সময় এদেশে অন্ধদের জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয়ের অভাব ছিল।

১৮৯৫ সালে এলাহাবাদ কায়স্থ পাঠশালার অধ্যক্ষ হিসেবে মাসিক আড়াইশো টাকা বেতনে যোগ দেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এলাহাবাদ কলেজের খোল-নলচে বদলাতে রামানন্দের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তাঁর অধ্যাপনায় কলেজের ছাত্ররা ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্দীপ্ত হতে থাকে। কলকাতায় থাকাকালীন যে প্রবল অর্থকষ্ট ভোগ করছিলেন তিনি, তা এখানে এসে দূর হয়। তাঁর সুদক্ষ অধ্যাপনার কারণে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যপদও অর্জন করেন তিনি। লক্ষ্ণৌয়ের ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘এডভোকেট’-এ নিজের সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে সচেষ্ট হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এলাহাবাদে থাকার সময়েই ১৮৯৭ সালে ‘প্রদীপ’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি। এরপরে ১৯০১ সালে মাসিক সচিত্র সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে ‘প্রবাসী’ পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন রামানন্দ। বাংলায় প্রথম কোনও পত্রিকা তিনটি রঙ সম্বলিত আকারে প্রকাশিত হল। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের লেখা ছাপা হত এই পত্রিকায়। সেই সময়েই প্রায় ৭৫০০ কপি ‘প্রবাসী’ পত্রিকা বিলি হত সমগ্র বাংলা জুড়ে। এই পত্রিকার হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক দৃঢ় ও নিবিড় সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে রামানন্দের। ১৯০৭ সালে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেন ‘মডার্ন রিভিউ’ নামে একটি ইংরেজি মাসিক পত্রিকা। কোনওরকম রাজনৈতিক সংস্পর্শ থেকে দূরে ছিল এই পত্রিকাটি। যদিও জওহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মত মানুষেরা এখানে নিয়মিত লিখতেন। ১৯১০ সালে ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদে এবং পরে ১৯২২ সালে সমাজের সভাপতির পদে উন্নীত হন রামানন্দ। এই সময়পর্বে একের পর এক সাফল্য এবং নানাবিধ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তিনি। ১৯২৪ সালে তিনি বিশ্বভারতীর অবৈতনিক অধ্যাপক পদে যোগ দেন আর ঠিক তাঁর দু বছর পরেই লিগ অফ নেশনস-এর আমন্ত্রণে ইউরোপ সফরে রওনা দেন। ‘বিশাল ভারত’ নামে একটি হিন্দি ভাষার পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এলাহাবাদে যে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল ১৯২৩ এবং ১৯৩১ সালে, রামানন্দ ছিলেন সেই দুই সম্মেলনের সভাপতি।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাবশত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদনা করে ‘দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর’ বইটি। বহু চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে উভয়ের মধ্যে। কোনও কোনও চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর লেখা ইংরেজির ভুল শুধরে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন রামানন্দকে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ এও স্বীকার করেছেন যে রামানন্দের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লিখতে হবে সেই তাড়াতেই তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করার প্রসঙ্গেও বিশ্বকবিকে পরামর্শ দিয়েছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

তাঁর লেখা ও অনুবাদ করা বইয়ের মধ্য রয়েছে ‘আরব্যোপন্যাস’, রাজা রবি বর্মার জীবনী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং এগুলি ছাড়াও কৃত্তিবাসী রামায়ণ, সচিত্র মহাভারত, ‘টুওয়ার্ডস হোমরুল : রামমোহন রায় অ্যান্ড মডার্ন ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি বইপত্রও সম্পাদনা করেছেন।

১৯৪৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।    

One comment

আপনার মতামত জানান