আর কে লক্ষ্মণ

আর কে লক্ষ্মণ

ভারতের এক বিখ্যাত কার্টুনিস্ট আর কে লক্ষ্মণ (R. K. Laxman)। ‘কমন ম্যান’ নামের কার্টুন সিরিজের জন্য তিনি সমাদৃত হয়েছেন আপামর ভারতবাসীর কাছে। তাছাড়া ‘টাইমস অফ ইণ্ডিয়া’ সংবাদপত্রের পাতায় ‘ইউ সেইড ইট’ (You Said It) নামের দৈনিক একটি কার্টুন স্ট্রিপের জন্যও তিনি সুপরিচিত। আংশিক সময়ের কার্টুনিস্ট হিসেবে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় আর. কে. লক্ষ্মণ তাঁর দাদা বিখ্যাত ভারতীয় সাহিত্যিক আর. কে. নারায়ণের লেখা ছোটগল্পের অলংকরণও করেছিলেন। মুম্বাইয়ের ‘ফ্রি প্রেস জার্নাল’-এ স্থায়ী কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কার্টুন আঁকার পাশাপাশি ভারতের বাইরে ভ্রমণের সময় তিনি বহু ডুডল এবং স্কেচ করতেন। আঁকতে ভালোবাসতেন কাকের ছবিও। বলা যায় আর কে লক্ষ্মণই একমাত্র ভারতীয় কার্টুনিস্ট যার কার্টুনের প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ভারতের নানাবিধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফুটে উঠতো তাঁর কার্টুনে, লঘুচপল ভঙ্গিতে তীব্র বিদ্রুপের কশাঘাত ধরা থাকতো তাঁর সেইসব অনবদ্য কার্টুনগুলিতে।

১৯২১ সালের ২৪ অক্টোবর মাইসোরের একটি তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে আর কে লক্ষ্মণের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম রশিপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ। তাঁর বাবা ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধানশিক্ষক। ছয় ভাই আর দুই বোনের মধ্যে লক্ষ্মণ ছিলেন বয়সে সবথেকে ছোটো। তাঁর দাদা আর কে লক্ষ্মণ ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় কথাসাহিত্যিক। ছোটোবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল ‘দোদ্দু’। পরে তাঁকে ‘দিল্লির পাইড পাইপার’ নামেও অভিহিত করা হয়। শৈশবকাল থেকেই দেয়ালে, ঘরের মেঝেতে কিংবা দরজায় ছবি আঁকতেন তিনি, কখনো বা হিজিবিজি আঁকিবুকিও কাটতেন আর তাই থেকেই কখনো কখনো একটা পূর্ণ ছবি হয়ে উঠতো। প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করার আগেই বাড়িতে ‘দ্য স্ট্র্যাণ্ড’, ‘দ্য পাঞ্চ’, ‘বাইস্ট্যাণ্ডার’, ‘ওয়াইড ওয়ার্ল্ড’, ‘টিট বিটস’ ইত্যাদি বিখ্যাত সব বিদেশি পত্র-পত্রিকার অলংকরণ, ছবি, প্রচ্ছদ দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই ছবিগুলি তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ কার্টুনিস্ট ডেভিড লো’র কাজের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। মজার বিষয় হল, দ্য হিন্দু পত্রিকায় পরবর্তীকালের এক সাক্ষাৎকারে লক্ষ্মণ জানিয়েছেন যে বহুদিন পর্যন্ত তিনি ডেভিড লোর স্বাক্ষর দেখে তাঁর পদবি লো’র (Low) বদলে কাউ (Cow) ভাবতেন। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন যে, ছোটোবেলা থেকেই তাঁর ঘরের জানালার বাইরে যে সকল জিনিস দেখা যেত, গাছের ডালপালা, শুকনো কাঠ, পাতা, গিরিগিটি সবই তিনি ছবি আঁকতেন। চোখের সামনে দেখতেন বাড়ির চাকর জ্বালানির কাঠ কাটছে, কাকেরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসে আছে আবার উড়ে যাচ্ছে, আর এই সব দৃশ্য আস্ত একটা ছবির মতোই তাঁর মাথায় গেঁথে যেত, পরে তা ছবি হয়ে রূপ পেত কাগজে। স্থানীয় ‘রাফ অ্যাণ্ড টাফ অ্যাণ্ড জলি’ নামের একটি ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তাঁর দাদা আর কে নারায়ণ তাঁর শৈশবের কিছু কাহিনী নিয়ে দুটি গল্পও লিখেছিলেন ‘দোদ্দু দ্য মানি মেকার’ এবং ‘দ্য রিগাল ক্রিকেট টিম’ নামে। কৈশোরেই তাঁর বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মারা গেলে, শোকাকুল হয়ে পড়েন লক্ষ্মণ। কিন্তু বাড়ির প্রবীণেরা সংসারের দায়ভার সামাল দেওয়ায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তাঁর কোনো অসুবিধেই হয়নি। পরবর্তীকালে স্বনামধন্য ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী কুমারী কমলাকে বিবাহ করেন আর কে লক্ষ্মণ। কিন্তু কয়েক বছর পরেই তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে এবং লক্ষ্মণ কমলার ভাইঝিকে বিবাহ করেন।  

মাইসোরের মহারাজা গভর্নমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করার পরে ‘স্যার জে. জে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাপ্লায়েড আর্ট’ নামক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করেন আর কে লক্ষ্মণ। ছবি আঁকার দিকেই মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানের ডিন তাঁকে জানান যে সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য উপযুক্ত যোগ্যতার ছাপ তাঁর আঁকায় নেই। ফলে লক্ষ্মণের ভর্তির আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তাই মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষকদের কার্টুন আঁকতেন লক্ষ্মণ এবং একবার তাঁর আঁকা একটি পিপুল পাতার ছবি দেখে এক শিক্ষক অত্যন্ত প্রশংসা করেন, তার পাশাপাশি ছবি আঁকায় তাঁর সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন। এই কথা শুনেই নিজেকে একজন শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আর কে লক্ষ্মণ। ইতিমধ্যে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ছবি আঁকা, কার্টুন করার কাজ তিনি চালিয়ে যান ‘স্বরাজ্য’ পত্রিকার জন্য। পরে ভারতীয় পুরাণের চরিত্র ‘নারদ’কে কেন্দ্র করে নির্মিত একটি অ্যানিমেশন ছবিতেও কার্টুন আঁকেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রাথমিকপর্বে ‘রোহন’ নামের একটি সংবাদপত্র এবং ‘স্বরাজ্য’, ‘ব্লিৎজ’ ইত্যাদি পত্রিকায় কার্টুনিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আর কে লক্ষ্মণ। মাইসোরের মহারাজা কলেজে পড়াকালীন ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় তাঁর দাদা আর কে নারায়ণের ছোটগল্পের অলংকরণ করতে শুরু করেন তিনি। ‘স্বতন্ত্র’ নামের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে রাজনৈতিক নানা বিষয়ের উপর বিদ্রুপাত্মক কার্টুন আঁকতে শুরু করেন তিনি। কন্নড় ভাষার হাস্যরসাত্মক পত্রিকা ‘কোরাভাঞ্জি’তেও একইভাবে রাজনৈতিক কার্টুজ আঁকা শুরু করেন লক্ষ্মণ। ১৯৪২ সালে ড. এম শিবরাম এই মাসিক পত্রিকাটি চালু করেন যেখানে প্রহসন জাতীয় এবং হাস্যরসাত্মক লেখাপত্র আর কার্টুন প্রকাশিত হত। শিবরাম নিজেও একজন বিখ্যাত হাস্যরসাত্মক লেখক ছিলেন যিনি বহুলাংশে লক্ষ্মণকে প্রভাবিত করেছেন। মাদ্রাজের ‘জেমিনি স্টুডিও’তে একটি গ্রীষ্মকালীন চাকরিতে যোগ দেন আর কে লক্ষ্মণ। কিন্তু প্রথম পূর্ণ সময়ের একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে লক্ষ্মণ কাজ করতে শুরু করেন মুম্বাইয়ের ‘দ্য ফ্রি প্রেস জার্নাল’-এ। এখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বাল থ্যাকারে। ১৯৫১ সালে ‘দ্য টাইমস অফ ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় যোগ দেন তিনি এবং পরবর্তী ৫০ বছর এই সংস্থাতেই কাজ করেছেন তিনি।

তাঁর বিখ্যাত কার্টুনগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ্য ‘দ্য কমন ম্যান’। দূর্নীতি এবং আরো বহু অশোভন রাজনৈতিক অবস্থাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত এই কার্টুন চরিত্রটি। ১৯৫৪ সালে ‘এশিয়ান পেইন্টস’ কোম্পানির জন্য গাট্টু নামে একটি জনপ্রিয় ম্যাসকট তৈরি করেছিলেন। কার্টুন ছাড়াও লক্ষ্মণ বেশ কিছু উপন্যাসও লিখেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – হোটেল রিভিরা। ‘মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস ৫৫’ নামের একটি হিন্দি চলচ্চিত্র এবং ‘কামারাজ’ নামের একটি তামিল ছবিতেও তাঁর আঁকা কার্টুন ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর দাদার লেখা ‘মালগুডি ডেজ’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকের জন্যেও কার্টুন এঁকে দিয়েছেন তিনি। এছাড়া ডেভিড লো, টি এস এলিয়ট, বার্ট্রাণ্ড রাসেল, জে বি প্রিস্টলি এবং গ্রাহাম গ্রিনের মত বহু বিখ্যাত ব্যক্তির কার্টুন তথা ক্যারিকেচারও এঁকেছেন লক্ষ্মণ। আর. কে. লক্ষ্মণের আত্মজীবনীর নাম ‘দ্য টানেল অফ টাইম’। সম্পাদকীয় কার্টুনগুলিতে লক্ষ্মণ জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীর মত বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তুলে ধরতেন। ইন্দিরা গান্ধীর লম্বা নাকওয়ালা কার্টুন আঁকার জন্য তিনি আজও সমাদৃত। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হলে কার্টুনের মধ্য দিয়ে এক বিশ্বাসঘাতকতার বার্তা তুলে ধরেন লক্ষ্মণ। এছাড়া তাঁরই একটি কার্টুনে দেখা যায় স্বর্গে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী সংবাদপত্র পড়ে দেবতাদের কাছে জানতে চাইছেন তার দেশের কীরূপ অবস্থা। তাঁর পকেট কার্টুনগুলি পাঠককে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেত সাধারণ মানুষের ঘরে কিংবা আমলা তথা রাজনৈতিক ব্যক্তির ঘরের ভিতর। কার্টুন আঁকার পাশাপাশি ভারতের বাইরে ভ্রমণের সময় তিনি বহু ডুডল এবং স্কেচ করতেন। আঁকতে ভালোবাসতেন কাকের ছবিও। ‘ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কার্টুনিস্টস’-এর সহায়তায় ‘ইণ্ডিয়ান কার্টুন গ্যালারি’তে ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আর কে লক্ষ্মণের কার্টুনের প্রদর্শনী হয়। তিনিই ছিলেন একমাত্র ভারতীয় কার্টুনিস্ট যার আঁকা কার্টুন এভাবে দর্শকদের জন্য প্রদর্শিত হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। ২০১২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে লক্ষ্মণের অপ্রকাশিত কিছু ডুডল প্রদর্শিত হয়। তারপর থেকে নিয়মিত প্রতি বছর এই কার্টুনের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতে থাকে ২০২০ সাল পর্যন্ত।

সারা জীবনে তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বহু পুরস্কার পেয়েছেন আর কে লক্ষ্মণ। ১৯৭৩ সালে প্রথম ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। এরপরে ১৯৮৪ সালে সাংবাদিকতা, সৃষ্টিশীল শিল্পের জন্য রামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার পান তিনি। ১৯৮৩ সালে কর্ণাটক রাজ্যোৎসব পুরস্কারে ভূষিত হন লক্ষ্মণ। ২০০৪ সালে মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানীয় ডক্টরেট অর্জন করেন তিনি। ২০০৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি প্রদান করে। সিমবায়োসিস আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে একটি বিশেষ পদ তৈরি করেছে।

২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি ৯৩ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের পুনেতে আর কে লক্ষ্মণের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান