পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল, কেন হয়েছিল, জেনে নেওয়া যাক।
পাঁচ পাঁচটি পুত্র পেয়ে রাজা পাণ্ডুর পুত্রলাভের বাসনা তো সম্পন্ন হল, কিন্তু মনের কোথাও তার অপূর্ণ কামনা রয়েই গেল। সেটা স্বাভাবিকও বটে। দুটি সুন্দরী রমণী তার স্ত্রী, অথচ নিজে তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে পারল না সে, ডাকতে হল দেবতাদের। কি আর করা যাবে! সেই কিমিন্দম মুনির অভিশাপ। সঙ্গমে উদ্যত হলেই মৃত্যু হবে তার। তাই সে তার কামনাকে মনেই অবদমিত করে চলল। কিন্তু একদিন বসন্ত এল। আক্ষরিক অর্থেই বসন্ত এল বনে, শতশৃঙ্গ পর্বতের বনে। কত ফুলের শোভা চারিদিকে। পলাশের শোভায় তো যেন আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানে, সেই আগুনের একটু একটু পাণ্ডুর মনেও সঞ্চারিত হচ্ছিল। কতশত মনোরম ফুলের গন্ধে তার মনে উন্মাদনা জাগছিল আস্তে আস্তে। কোকিল আর পাখিদের ডাকে মন রোমাঞ্চিত হচ্ছিল। এই অবস্থায় পাণ্ডু হাঁটছিল তার রূপবতী স্ত্রী মাদ্রীর সাথে। মাদ্রী সেদিন সেজেছিলও এমনভাবে যে পাণ্ডুর কামনা তাকে দেখে বেড়ে যাচ্ছিল। বারবার পাণ্ডু মাদ্রীর দিকে তাকাচ্ছিল, তার শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখছিল তার সুন্দরী স্ত্রীকে, –
“সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসসম “
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরেই চলে এসেছিল দুজনে। নির্জন স্থানে নিজের কামনাকে আর সামলাতে পারল না পাণ্ডু। হঠাৎ করে মাদ্রীকে আঁকড়ে ধরল সে। মাদ্রী এতক্ষণ তার সাথে সাথেই হাঁটছিল, তার চোখে চোখ রেখে অনুভব করছিল পাণ্ডুর মন। কিন্তু হঠাৎ পাণ্ডুর এই আচরণে সে বাধা দিল। কিন্তু বহুদিনের সুপ্ত কামনারা আজ বাধা পেয়েছে, সে কি আর বাধ মানে, পাণ্ডুও বাধ মানল না। কামনা এমনই আবেগ, যেখানে মানুষ কোনও যুক্তি মানে না, কোনও ভয় পায় না। তার পাণ্ডুও নিজের মৃত্যুভয়কে কাটিয়ে কামনার কাছে ধরা দিল নিজেকে। আর মাদ্রীর সাথে সঙ্গমরত অবস্থাতেই সে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। মাদ্রী বুঝল সব শেষ হয়ে গেছে। তার ভয়ার্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। এই কিছুক্ষণ আগেও যে স্বামী তার সাথে হাঁটছিল, এক মুহূর্তে সে আর নেই! হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মাদ্রী। মনে মনে নিজেকে দোষ দিল অসংখ্যবার।
তার চিৎকার কুন্তীর কানে গেল। সে ছুটে আসতে থাকল সেদিকে, পেছনে পাণ্ডুর পাঁচপুত্র। জঙ্গলের তাদের পায়ের আওয়াজে মাদ্রী বুঝতে পারল তারা এদিকে এগিয়ে আসছে। নিজেদের বসনের দিকে চেয়ে দেখল সে। এমন অবস্থায় যদি তার ছেলেরা তাকে দেখে, সেটা অত্যন্ত লজ্জার। সে চেঁচিয়ে উঠল, “দিদি! তুমি একাই এসো! ওদের ওখানেই রেখে এসো!”
কুন্তী বুঝল ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে। তার মন কেঁপে উঠল আশঙ্কায়। ছেলেরা যতদূরে এসেছিল, সেখানেই তাদের অপেক্ষা করতে বলে কুন্তী এগিয়ে গেল। এগিয়ে এসে দেখল সব শেষ, শেষ হয়ে গেছে পাণ্ডু। মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছে সে। আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তীব্র তিরস্কার করতে থাকল মাদ্রীকে, “আমি সবসময় ওকে আগলে আগলে চলতাম, আর আজ তুই সব শেষ করে দিলি?”
মাদ্রী মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলল। আর কুন্তী বলেই চলল, “মুনির অভিশাপ মনে ছিল না তোর? জানতিস না ওর কি হবে? এক মুহূর্তের কামনার জন্য সব শেষ করে দিলি?”
অনেকক্ষণ তার ওপর চেঁচানোর পর কুন্তী শান্ত হল। মাদ্রীকে বলল, ” আমিও স্বামীর সাথেই মরব। ”
“না দিদি! সব দোষ আমার। আমি মরব ওর সাথে”, কেঁদে উঠল মাদ্রী।
“না। স্বামীর প্রথম স্ত্রী হওয়ার জন্য এ অধিকার আমারই “, কুন্তী দৃঢ়ভাবে বলল, “তুমি উঠে পড় মৃতদেহ ছেড়ে। ওদিকে ছেলেদের কাছে যাও।”
এবার মুখ তুলে চাইল মাদ্রী, “কিন্তু দিদি! আমি যে তোমার ছেলেদের নিজের ছেলের মত যত্ন করতে পারব না।”
ঐ একটা কথাতেই পিছিয়ে এল কুন্তী। মাদ্রী বলল, “কিন্তু তুমি আমার ছেলেদের নিজের মতই মানুষ করবে। তাই তুমি বেঁচে থাকো। আমায় মরতে দাও।”
কুন্তী আর বাধা দেয়নি তারপর। মাদ্রী বরণ করল স্বেচ্ছামৃত্যু।
তথ্যসূত্র
- "মহাভারত সারানুবাদ", দেবালয় লাইব্রেরী(প্রকাশক সৌরভ দে, তৃতীয় প্রকাশ) - রাজশেখর বসু, আদিপর্ব (২০। যুধিষ্ঠিরাদির জন্ম - পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যু) পৃষ্ঠাঃ ৪৭
- "মহাভারতের অষ্টাদশী", আনন্দ পাবলিশার্স, চতুর্থ মুদ্রণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, অধ্যায়ঃ মাদ্রী, পৃষ্ঠাঃ ৩৬২-৩৬৯
One comment