শ্রীশৈল মন্দিরটি বাংলাদেশের শ্রীহট্ট শহরের ৩ কিমি উত্তর-পূর্বে গোটাটিকারের কাছে দক্ষিণ সুরমার জৈনপুর গ্রামে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর গ্রীবা পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মহালক্ষ্মী এবং ভৈরব হলেন সম্বরানন্দ। এই সতীপীঠ মহালক্ষ্মী শক্তিপীঠ কিংবা গ্রীবা মহাপীঠ হিসেবেও পরিচিত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকম একটি পীঠ হলো সতীপীঠ শ্রীশৈল। বলা হয় সতীর গ্রীবা পড়ে জন্ম হয়েছে এই সতীপীঠ শ্রীশৈলের।
সতীপীঠ শ্রীশৈল প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে বহু জনশ্রুতি আছে। একবার দেবীপ্রসাদ দাশ নামের জনৈক ব্যক্তি এই অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের জন্য কয়েকজন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করেন। সময়টা দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতক। এই রাস্তার কাজ করতে করতেই একটি কালো রঙের শিলাখণ্ড বেরিয়ে আসে মাটির তোলা থেকে। কিছুতেই সেই শিলাখণ্ডকে সরাতে না পেরে শ্রমিকেরা দেবীপ্রসাদের নির্দেশে শাবল দিয়ে আঘাত করে তাকে দুখণ্ড করে দেয়। কথিত আছে ঠিক এর পরেই পাশের অরণ্য থেকে এক বালিকা বেরিয়ে এসে শ্রমিকটিকে চড় মেরে পুনরায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ঐদিন রাত্রেই দেবী মহালক্ষ্মীর স্বপ্নাদেশ পান দেবীপ্রসাদ দাশ এবং সেই মত ইটের গাঁথনি দিয়ে মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু পুনরায় দেবী মহালক্ষ্মী তাঁকে স্বপ্নাদেশে জানান যে তিনি বদ্ধ থাকতে চান না। ফলে সেই শিলাখণ্ডের চারপাশটুকু কেবল ইঁট দিয়ে ঘিরে দেন দেবীপ্রসাদ দাশ। সেই থেকে বহু বহু কাল ধরে এভাবেই এই সতীপীঠ শ্রীশৈল প্রাঙ্গণে দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভৈরব আবিষ্কারের এক জনশ্রুতিও। মহান সাধক ব্রহ্মানন্দ গিরি একদিন শ্রীহট্টে এসে সাধনার মাধ্যমে জানতে পারেন যে দেবীর শিলাখণ্ডের পশ্চিমদিকে এক টিলার মধ্যে রয়েছে মহাদেব। ব্রহ্মানন্দ গিরি ছিলেন আচার্য শঙ্করের দশনামী সম্প্রদায়ের এক মহান সাধক। ১২৮১ বঙ্গাব্দে তাঁর মৃত্যুর ফলে মহাদেবের অবস্থান আবিষ্কারের কাজ অধরাই থেকে যায়। কিন্তু ব্রহ্মানন্দের শিষ্য বিরজানাথ ন্যায়বাগীশ ১২৮৬ বঙ্গাব্দে এক স্বপ্নে দেখতে পান গুরু ব্রহ্মানন্দ দুজন শিষ্যের সঙ্গে সেই টিলায় উঠে মাটি খুঁড়ে শিবলিঙ্গটি খুঁজে পেয়েছেন। সেই রাত্রে বিরজানাথের দুই শিষ্য কৃষ্ণকুমার ভট্টাচার্য এবং কৈলাসচন্দ্র ভট্টাচার্য একই স্বপ্ন দেখেছিলেন। ফলে তাঁরা একত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সেই টিলায় উঠে সত্য সত্যই খুঁজে বের করেন গৌরীপট্টসহ একটি শিবলিঙ্গ। সেই থেকেই দেবীর পাশাপাশি ভৈরবও এখানে পূজিত হন। দেবীপ্রসাদ দাশের উত্তরসূরিরাই এখনও সতীপীঠ শ্রীশৈলের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন।
এই মন্দিরকে অনেকে দক্ষিণের কৈলাস কিংবা ব্রহ্মগিরি নামেও আখ্যা দেন।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ এবং ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সতীপীঠ শ্রীশৈলতে সতী পূজিতা হন মহালক্ষ্মী রূপে এবং ভৈরব এখানে পরিচিত সম্বরানন্দ নামে।
সতীপীঠ শ্রীশৈল মূলত নবরাত্রি উৎসব পালনের জন্য বিখ্যাত। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বহু মানুষ একত্রিত হন এই পুণ্যস্থানে।