নলেন গুড়

নলেন গুড় তৈরি করা হয় কিভাবে

বাঙালির কাছে শীতের আগমন মানেই নলেন গুড় বা খেজুর গুড়৷ নলেন গুড় বা তার থেকে তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি শীতকালের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। এর স্বাদ, গন্ধ এমন যে জিভে জল চলে আসে৷ আমরা জানি খেজুর গুড়কেই নলেন গুড় বলে অর্থাৎ খেজুর গাছের রস থেকে তৈরি হয় এই গুড় কিন্তু নলেন গুড় তৈরি করা হয় কিভাবে তা অনেকেই জানি না। এখানে জেনে নেব সেই পদ্ধতি।

তবে নলেন গুড় তৈরি করার পদ্ধতির আগে বলতে হবে শিউলিদের কথা – যাঁরা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন তাঁদের বলে শিউলি, কথ্য ভাষায় এদের ‘গাছি’-ও বলা হয়ে থাকে। আপনার আমার পাতে নলেন গুড় পৌঁছে দিতে শিউলিদের ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত খাটতে হয়৷

নলেন গুড় তৈরি করার বেশ কয়েকটি ধাপ আছে৷ এর প্রথম ধাপ হল ‘গাছ কাটা’৷ হেমন্তের হিমেল হাওয়া যখন হাল্কা শীতের প্রভাব ফেলতে শুরু করে, সেই সময় থেকেই এই কাজ শুরু করতে হয় শিউলিদের৷ প্রথমে খেজুর গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করতে হয়৷ কেটে ফেলতে হয় অধিকাংশ পাতা৷ এই কাজকে গ্রাম্য ভাষায় বলে ‘গাছ কাটা’৷

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

‘গাছ কাটা’র পর খেজুর গাছের একেবারে উপরের দিকে পাতার ঠিক নিচের কান্ড কেটে পরিষ্কার করতে হয়৷ ওই অংশ চেঁছে পরিষ্কার করার পর খেজুর গাছের কান্ডের ওই অংশ কিছুটা নরম হয়ে যায়৷ তখন কান্ডের নরম অংশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটা কাঠি বা নল৷ এই নল (বা কাঠি) বেয়ে টুপটুপ করে বেরিয়ে আসে খেজুর রস৷ এই নল যে কোনও কাঠিতে হয় না৷ সাধারণত বাঁশের কঞ্চির একটা অংশ কেটে নিয়ে সেটাকে লম্বালম্বি মাঝখান থেকে চিরে ফেলতে হয়৷ ফলে মাঝখানে একটা সরু পথ তৈরি হয়৷ সেই পথ দিয়েই রস বেরিয়ে আসে।

গাছ কেটে রস বেরনোর পথ তৈরি করার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়৷ শীতের শুরু থেকে গাছে রস আসতে শুরু করে৷ তখন শুরু হয় নলেন গুড় তৈরির দ্বিতীয় ধাপ৷ সূর্য ডোবার আগে মাটির কলসি গাছে এমন ভাবে ঝুলিয়ে দিতে হয় যাতে কলসির মুখটা কাঠির নিচে থাকে৷ সারারাত ধরে কলসিতে জমা হতে থাকে রস। পরদিন ভোরবেলা, সূর্যের আলো ফোটার আগে গাছ থেকে কলসি নামিয়ে নিতে হয়৷ কুয়াশাময় শীতের ভোরে যা খুব কঠিন কাজ। এই কলসিগুলি প্রতিদিন চুন দিয়ে ধুয়ে ভাল কর শুকিয়ে নেওয়া প্রয়োজন আর গাছের কাটা অংশও জল দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। এই পদ্ধতির কোন একটির ভুল হলেই খেজুর রস ‘গেঁজে’ যেতে পারে যা আসলে তাড়িরই এক রূপ।

এরপর নলেন গুড় তৈরির তৃতীয় তথা শেষ ধাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ৷ ভাল গুণমানের নলেন গুড় তৈরি করতে তৃতীয় ধাপে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার প্রয়োজন৷ মাটির উনুনে কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করে রস ফোটাতে হয়৷ রস ফোটার সময় তার মধ্যে বিশেষ ধরনের হাতা দিয়ে সারাক্ষণ নাড়তে হয়৷ মূলত নারকেলের মালার অর্ধেক অংশে লম্বা কাঠ লাগিয়ে এই হাতা তৈরি করা হয়৷ কয়েক ঘণ্টা ধরে রস ফোটাতে হয়৷ যত সময় এগোয়, ততই নলেন গুড়ের গন্ধ পাওয়া যায়৷ গন্ধ যত বাড়বে, বুঝতে হবে গুড়ের মান ততই ভাল হচ্ছে৷ তবে অনেকে গুড়ের রং হালকা করার জন্য সোডিয়াম হাইড্রোজেন সালফাইট (হাইড্রোজ) ব্যবহার করে থাকেন যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

গুড়ের গুণমান রসের উপর নির্ভর করে৷ টানা তিনদিন রস সংগ্রহের পর বন্ধ করে দিতে হয়৷ একে বলে গাছের জিরেন৷ কারণ, প্রতিদিনই গাছে হাঁড়ি ঝোলানোর সময় কান্ডের কিছুটা অংশ চাঁছতে হয়৷ গাছকে জিরেন দিলে ওই তিন দিন, তা চাঁছতে হয় না৷ এর পর চতুর্থদিন বা জিরেনের পর প্রথমদিন যে রস সংগ্রহ করা হয়, তার স্বাদ অন্য রসের তুলনায় একেবারেই আলাদা৷ এই রস জিরেন-কাটের রস নামে পরিচিত৷ জিরেন-কাটের রস থেকে জিরেন-কাটের গুড় তৈরি হয়৷ এই গুড়ের স্বাদ সব থেকে ভাল৷

ব্যবসায়িক স্বার্থে মিশছে ভেজাল, বা জিরেন কাটের নলেন গুড়ের হয়ে উঠছে অপ্রতুল তবুও নলেন গুড় বা খেজুর গুড়ের স্বাদ নেওয়ার জন্যে বাঙালি শীতকালের অপেক্ষায় থাকে। খেজুর গুড়ের পাটালি তৈরি করে অনেক সময় সারা বছরের জন্যে মজুদ করার ব্যবস্থা করলেও মজুদ করে রাখা পাটালি থেকে তৈরি মিষ্টির স্বাদ বা গন্ধ কোনটাই টাটকা গুড়ের মত হয় না। তাই শীতের কটা দিন নলেন গুড় ও তার থেকে তৈরি নানান মিষ্টি উপভোগ করে নেওয়াই ভাল।

3 comments

  1. বাহ বাহ। বেশ ভালো লাগল পড়ে। ছোটবেলায় নিজের বাড়িতে দেখেছি পুরো পদ্ধতিটা। একরকম স্মৃতিচারণা হল। ধন্যবাদ।

আপনার মতামত জানান