ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েজ

ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েজ

ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েজ (Ignaz Philipp Semmelweis) ছিলেন একজন হাঙ্গেরীয় চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী যিনি অপারেশনের আগে আ্যন্টিসেপটিক (Antiseptic) ব্যবহারের মাধ্যমে হাত ধোয়ার কথা প্রথম বলেছিলেন। একাধারে চাইল্ডবেড ফিভার (Childbed fever) রোগটির কারণ নির্ণয়ও তিনি করেছিলেন।

১৮১৮ সালের ১ জুলাই হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের তাবানে ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েজের জন্ম হয়। তাঁর বাবা জোসেফ সেমেলওয়েজ ছিলেন এলাকার একজন সম্ভ্রান্ত মুদি। তাঁর মায়ের নাম তেরেজ মুলার। ইগনাজ ছিলেন মা বাবার দশ সন্তানের মধ্যে পঞ্চম।

সেমেলওয়েজ ১৮৩৭ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়বেন বলে ভর্তি হলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে শেষ অবধি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়বেন বলে মনস্থির করেন। ১৮৪৪ সালে তিনি এম.ডি (M.D) পাশ করেন। সেমেলওয়েজ ধাত্রীবিদ্যায় (obstetrics) বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভিয়েনা সাধারণ হাসপাতালে সেমেলওয়েজ এক চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে যুক্ত হন। এই হাসপাতালে দুটি প্রসব কেন্দ্র ছিল। প্রথম কেন্দ্রটিতে চাইল্ডবেড ফিভারে আক্রান্ত হয়ে আগত মহিলাদের ১০% মারা যেত, অন্যদিকে দ্বিতীয় কেন্দ্রটিতে মৃত্যুর এই হার ছিল মাত্র ৪%। পরিস্থিতি এমন হল যে প্রথম কেন্দ্রে প্রসব করার চেয়ে অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা খোলা রাস্তায় প্রসব করা নিরাপদ মনে করতেন। কারণ প্রথম কেন্দ্রে প্রসব করার অর্থই যেন ছিল অবধারিত মৃত্যু। সেমেলওয়েজের দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি ঘটনা যে রাস্তায় প্রসব করা মহিলাদের চাইল্ডবেড ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা প্রথম কেন্দ্রে প্রসব করতে আসা মহিলাদের তুলনায় অনেক নগণ্য। অথচ ফল হওয়ার কথা ছিল উল্টো। খোলা রাস্তায় প্রসব করা অনেক বেশি বিপজ্জনক হওয়ার কথা মা এবং সন্তানের জীবনের পক্ষে। সেমেলওয়েজের মনে হল প্রথম প্রসব কেন্দ্রটিতে কিছু তো একটা কারণ আছে যার ফলে এখানে মৃত্যু হার এত বেশি।

সেমেলওয়েজ দুটি প্রসব কেন্দ্রে ব্যবহৃত প্রসব পদ্ধতির তুলনা করে দেখলেন দুটি কেন্দ্রেই একই প্রসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অনেক ভেবে দুটি কেন্দ্রের মধ্যে একটি পার্থক্যই পেলেন তিনি প্রথম কেন্দ্রে প্রসব করানো ছাড়াও এখানে চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে আসা ছাত্রদের চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ দেওয়া হয় আর দ্বিতীয়টিতে প্রসব করানো ছাড়া ধাত্রীবিদ্যার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।

অনেক ভেবেও প্রথম কেন্দ্রের এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহারের কারণ খুঁজে পেলেননা সেমেলওয়েজ। একদিন তাঁর এক বন্ধু চিকিৎসক মৃত দেহের ময়না তদন্ত করবার সময় তাঁর এক ছাত্রের ছুরির খোঁচা লেগে মারা গেলে সেমেলওয়েজ বন্ধুর মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করে ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পান যে ব্যাকটেরিয়া তিনি চাইল্ডবেড ফিভারে মৃত্যু হওয়া মহিলাদের দেহেও খুঁজে পেয়েছিলেন। সেমেলওয়েজ বুঝতে পারেন মৃতদেহের পচনের সাথে চাইল্ডবেড ফিভারে মৃত্যুর একটা গভীর সম্পর্ক আছে।

তিনি আরও বুঝতে পারেন প্রথম কেন্দ্রে শবদেহ পরীক্ষার পরেই হাত না ধুয়ে চিকিৎসকরা প্রসব করাতে যান। কিন্তু দ্বিতীয় কেন্দ্রে কোন শবদেহ পরীক্ষা কেন্দ্র না থাকায় কেবল ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শীরাই প্রসব করান। ফলে চিকিৎসকদের থেকেই সংক্রমণ ছড়ায় প্রসূতি মায়েদের শরীরে। সেমেলওয়েজ প্রস্তাব করেন এখন থেকে প্রসব করানোর আগে চুন মেশানো ক্লোরিন জলে ভাল করে হাত ধুয়ে তবেই চিকিৎসকরা প্রসব করাতে যাবেন। যে সব যন্ত্রপাতি প্রসব করানোর কাজে ব্যবহার হয়, সে সবও ধুতে হবে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রসব করাতেই প্রথম কেন্দ্রে মৃত্যু হার ৯০% শতাংশ কমে গেল এবং একটা সময় এল যখন এই সংখ্যা শূন্যে এসে দাঁড়ালো। সেমেলওয়েজ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বলতে ও লিখতে শুরু করলেন যে এই অবিশ্বাস্য ভোলবদলের মূলে রয়েছে পরিচ্ছন্নতা। হাত ও যন্ত্রপাতি চুন মেশানো ক্লোরিন জলে ভাল করে ধোওয়া। কিন্তু সেমেলওয়েজ যেটার ব্যাখ্যা দিতে পারলেন চাইল্ড বেড ফিভারের পেছনে দায়ী আসলে কে? তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যায় তখনও জীবাণু সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না। ফলে সেমেলওয়েজ এর কারণ বলতে পারলেন না। কিন্তু তিনি নানা রকম পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে লাগলেন যে হাত ধোওয়ার ফলে সত্যিই প্রসূতি মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।

কিন্তু তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার অন্যান্য ডাক্তারেরা সহজে মেনে নিলেননা। তার কারণও ছিল অবশ্য। তৎকালীন চিকিৎসকরা মনে করতেন প্রধানত পাঁচটি কারণে প্রসূতি মহিলাদের চাইল্ডবেড ফিভারে মৃত্যু হয় – ১. গর্ভবতী থাকাকালীন অত্যন্ত আঁটোসাঁটো পোশাক পরা ২.দুষ্ট আত্মার প্রভাব ৩. প্রসব ঘরের দুর্গন্ধময় বাতাস ৪. পুরুষ ডাক্তারদের উপস্থিতি যা প্রসূতি মায়েদের সম্মানহানি করে এবং ফলস্বরূপ শরীরে কোন পরিবর্তন ঘটায় ৫. ঠাণ্ডা লেগে কিংবা অনিয়মিত খাবার অভ্যেসের কারণে। এই যেখানে ধারণা সেখানে সেমেলওয়েজের তত্ত্ব চিকিৎসকদেরই কাঠগড়ায় তোলে। তাদের অপরিচ্ছনতাই প্রসূতি মৃত্যুর কারণ এটা চিকিৎসকরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে তারা তাঁর প্রবল বিরোধীতা শুরু করে দেয়।তাঁর সহকর্মীসহ অনেক ডাক্তার তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতে থাকে। সেমেলওয়েজ পাগল হয়ে গেছেন প্রচার হতে থাকে। এমনকি, তাঁর স্ত্রী-ও ভাবতে শুরু করলেন তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন।এভাবে ক্রমশই তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ আসা শুরু হলে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে আর এই কারণেই পরবর্তী সময়ে ‘সেমেলওয়েজ রিফ্লেক্স’ নামে একটি আচরণগত তত্ত্বের সূচনা হয় যেখানে মানুষের এমন এক একগুঁয়ে জেদি আচরণ বোঝায় যখন সে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরোধী কোন মত শুনতে বা মানতে চায়না।

সেমেলওয়েজ ক্রমশ মানসিকভাবে অসুস্হ হয়ে পড়েন। তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।সেমেলওয়েইজ সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেখানকার রক্ষীরা তাঁকে প্রবল অত্যাচার করে। এর চোদ্দ দিন পর ক্ষতস্থানে বিষক্রিয়ার ফলে ১৮৬৫ সালের ১৩ আগস্ট মাত্র ৪৭ বছর বয়সে
ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েজের মৃত্যু হয়।

সেমেলওয়েজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেতে আরও কুড়ি বছর লাগে। প্রতিষ্ঠা পেল লুই পাস্তুরের হাত ধরে। তিনি তাঁর জীবাণু তত্ত্বে সেমেলওয়েজের হাত ধোওয়ার তত্ত্বকে জীবাণুনাশক অত্যন্ত কার্যকরী একটি প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নিলেন। ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েজ আজ বিপুলভাবে সমাদৃত ও স্বীকৃত সারা বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানে। তাঁকেই ‘অ্যান্টিসেপটিক নীতি’র অগ্রদূত মানা হয়ে থাকে। তাঁর নামে বুদাপেস্টে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। তাঁর বাড়ি আজ মিউজিয়ামে পরিণত। একটি ছোট গ্রহের নামকরণ হয় তাঁর নামে। তাঁর জীবন নিয়ে সাতটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। অজস্র নাটক উপন্যাসের চরিত্র তাঁর আদলেই সৃষ্টি হয়েছে।

তথ্যসূত্র


  1. https://en.wikipedia.org/
  2. সুপারফ্রিকোনোমিক্স : স্টিফেন জে ডাবনার, স্টিভেন লেভিটঃ পৃষ্ঠা ১৩৮
  3. https://www.anandabazar.com/

One comment

আপনার মতামত জানান