প্রতিবছর প্রতিমাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ওই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। পালনীয় সেই সমস্ত দিবস গুলির মধ্যে একটি হল আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস (International Friendship Day)।
প্রতিবছর ৩০ জুলাই সারা বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস পালিত হয়ে থাকে। সমস্ত অশান্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে পরস্পরের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বার্তাই দিতে চায় এই দিন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে জনসমক্ষে স্পষ্ট করে তুলে ধরারও একটি প্রয়াস নিহিত আছে এই দিনটি উদযাপনের নেপথ্যে।
বন্ধুত্বের জন্য এই বিশেষ একটি দিন নির্বাচন করে নেওয়ার পিছনে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কিছু সক্রিয় ছিল বলে মনে হয়। বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা, ভয়াবহতা, মানুষের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করে একের থেকে অপরের দূরত্ব কেবল বাড়িয়ে দিয়েছিল৷ বন্ধুত্ব স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হতে বসেছিল বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে। সেই দুঃসময়কে অতিক্রম করবার জন্যই, বন্ধুত্বের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস উদযাপনের ভাবনা এসেছিল বলে মনে করেন অনেকে। আমাদের বিশ্বকে দারিদ্র্য, সহিংসতা, নানারকম বিভাজনের সম্মুখীন হতে হয়,,ফলে শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হয়। এইসব সঙ্কটের মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন মানব-সংহতি। বন্ধুত্বই সেই সংহতি গড়ে তোলার অন্যতম পন্থা। বন্ধুত্বের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালে বিশ্বজুড়ে একটি বৃহত্তর ভালোর জন্য সকলে একত্র হয়ে কাজ করবে। বন্ধুত্ব দিবস পালনের মাধ্যমে এই বিশেষ উদ্দেশ্যটিকেও তুলে ধরা হয়ে থাকে। মানুষ, দেশ এবং সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধনের একটি অভিপ্রায় কাজ করে এই উদযাপনের নেপথ্যে।
৩০ জুলাই দিনটিকে বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দান করা হলেও এর একটি পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। জয়েস হল নামক এক ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ১৯৩০ সাল নাগাদ একে অপরকে সেই কার্ড দিয়ে অভিবাদনের দ্বারা বন্ধুত্ব উদযাপনের একটি বিশেষ দিন তৈরির চেষ্টা করেন। অনেকে তখন অবশ্য এর পিছনে এক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকেই লক্ষ্য করেছিলেন। অবশ্য এর আগে ১৯১৯ সালে আগস্টের প্রথম রবিবার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কার্ড ও ফুল দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে বন্ধুত্ব উদযাপন করত। আরেকটি সূত্র অনুযায়ী ১৯৩৫ সালে আমেরিকান সরকার একজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। দিনটি ছিল আগস্ট মাসের প্রথম শনিবার। জানা যায় ঠিক তার পরদিন সেই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করে৷ সেই থেকে আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রবিবারকে বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু আরও পরে ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই প্যারাগুয়েতে নদীর ধারে অবস্থিত এক শহর পুয়ের্তো পিনাসকোতে ডক্টর রামন আর্টেমিও ব্রাচো এক নৈশভোজে তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড গঠন করেন এবং বন্ধুত্ব উদযাপনের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনের প্রস্তাব করেছিলেন। ৩০ জুলাই দিনটিকে তাঁরা বন্ধুত্ব দিবস উদযাপনের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং জাতিসংঘের কাছে সেই দিনটিকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব রাখেন তাঁরা৷ দীর্ঘদিন সেই প্রস্তাব কার্যকরী হয়নি। ১৯৯৮ সালে বন্ধুত্ব দিবসের সম্মানে জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আন্নানের স্ত্রী নানে আন্নান উইনি দ্য পুহ-কে জাতিসংঘে বিশ্ব বন্ধুত্বের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করে। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩০ জুলাইকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের রীতিনীতি অনুসারে এই দিবস পালনের জন্য সমস্ত রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়।
আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস ৩০ জুলাই হলেও বিভিন্ন দেশে আলাদা-আলাদা তারিখে এই দিনটি পালিত হয়ে থাকে। প্যারাগুয়ের মত কয়েকটি দেশে ৩০ জুলাই উদযাপিত হলেও ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং স্পেনে ২০ জুলাই পালন করা হয়। আবার ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়াতে ১৪ ফেব্রুয়ারি, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৬ এপ্রিল, ইউক্রেনে ৯ জুন, ইকুয়েডর ও ভেনিজুয়েলায় ১৪ জুলাই, বলিভিয়ায় ২৩ জুলাই, নেপালে ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস পালন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতে আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারই এই বিশেষ দিনটি ঘটা করে উদযাপিত হয়ে থাকে।
নানারকমভাবে বন্ধুত্বের এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয় গোটা বিশ্বে। বন্ধুরা একসঙ্গে সময় কাটানোর জন্য একত্রে মিলিত হয়ে আনন্দ করে। একে অপরকে কার্ড বা ফুল দিয়ে, অটুট বন্ধুত্বের প্রতীকস্বরূপ পরস্পরের হাতে ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বেঁধে দিয়ে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে তোলে। জাতিসংঘের সংগঠন বিবিধ ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে। সেইসব মঞ্চ থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে বন্ধুত্বের বন্ধনের পবিত্রতাকে তুলে ধরা হয় মানুষের সামনে। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব বজায় রাখার বার্তা দিতেও আয়োজিত হয় নানারকম অনুষ্ঠান। ইদানীং স্যোশাল মিডিয়াতে এই বিশেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষ তাঁদের চিন্তাভাবনা, লেখালেখি অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেন। কেউ কেউ সৃজনশীল পোস্টার তৈরি করেন তো কেউ বন্ধুত্বের ওপর ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করেন। এইভাবে দিনটিকে বিশেষরূপে গুরুত্ব-সহকারে সারা বিশ্বের মানুষ পালন করে থাকেন।