ক্ষুদিরাম বসুর শেষ বিচার

নিজের দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় ক্ষুদিরাম বসুর শেষ বিচার খুব কম সময়ের মধ্যেই শেষ হয়। উকিলরা অনেক চেষ্টা করেও ক্ষুদিরামকে নিজের দোষ অস্বীকার করানোর জন্য রাজি করাতে পারেননি। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন, বোমা ছোঁড়ার দোষ প্রফুল্ল চাকীর উপর চাপিয়ে দিয়ে সাজা যদি কিছু কমানোর ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু লাভ হয়নি।

ক্ষুদিরামের ফাঁসির চাক্ষুস বর্ণনা

…”উকিল: তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?
ক্ষুদিরাম: হ্যাঁ, আমি একবার মেদিনীপুর দেখতে চাই, আমার দিদি আর তাঁর ছেলেপুলেদের।

উকিল: তোমার মনে কি কোন কষ্ট আছে ?
ক্ষুদিরাম: না, একেবারেই না।

উকিল: আত্মীয় স্বজনকে কোন কথা জানাতে চাও কি? অথবা কেউ তোমায় সাহায্য করুন এমন ইচ্ছা হয় কি?
ক্ষুদিরাম: না, আমার কোন ইচ্ছাই তাঁদের জানাবার নেই। তাঁরা যদি ইচ্ছা করেন আসতে পারেন।

উকিল: জেলে তোমার সাথে কি রকম ব্যবহার করা হয়?
ক্ষুদিরাম: মোটামুটি ভালোই।

উকিল: তোমার কি ভয় করছে?
ক্ষুদিরাম: (স্মিতহাস্যে) ভয় করবে কেন?

উকিল: তুমি কি জানো আমরা রংপুর থেকে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি? কিন্তু তুমি তো আমাদের আসার আগেই দোষ স্বীকার করেছো।
ক্ষুদিরাম: (স্মিতহাস্যে) কেন করবো না?” …

ধরা পড়ার পর বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায় নিজের ওপর নিয়ে নেন ক্ষুদিরাম। অন্য কোন সহযোগীর নাম বা কোন গোপন তথ্য শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেননি। মজফফরপুর আদালতে ক্ষুদিরামের বিচার কাজ শুরু হলো ০৮ জুন ১৯০৮। কিন্তু সারা পশ্চিম বাংলা থেকে কোন আইনজীবী মামলায় আসামী পক্ষের হয়ে  আদালতে দাঁড়াতে সাহস পাননি। তখন পূর্ব বঙ্গ থেকে রংপুর বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলা পরিচালনায় এগিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে বিচারকের অনুরোধে কালিদাস বসু নামে স্থানীয় এক আইনজীবী এগিয়ে আসেন আসামী পক্ষে। ৬ দিন চললো বিচার অনুষ্ঠান। বিচারের শুরুতেই ক্ষুদিরাম স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। কিন্তু বিচারক কর্নডফ এই স্বীকারোক্তিকে এড়িয়ে আদালতের প্রচলিত নিয়মেই বিচার করা হবে মর্মে ঘোষণা দিলেন। রংপুর থেকে যাওয়া তিন আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী দুই দিন সরকারী সাক্ষীদের জেরা করলেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম তখন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নিজেকে দেশমাতৃকার হাতে সমর্পণ করেছিলেন। আইনজীবীদের তিনি সহযোগিতা করেননি। উকিলদের সাথে তাঁর উপরোক্ত সংলাপই প্রমাণ করে যে তিনি নিজের প্রাণ রক্ষায় ছিলেন খুবই নিঃস্পৃহ।

মামলার উকিলরা সওয়াল জবাবকালে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই ঘটনার সময় ক্ষুদিরামের গায়ে একটা ভারী কুর্তা, কোর্ট, দুইটি পিস্তল এবং বেশ কিছু কার্তুজ ছিল তাই ঐ পরিমাণ ওজন নিয়ে তাঁর পক্ষে এতো ক্ষিপ্রতার সাথে বোমা ছুঁড়ে মারা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া দীনেশ (প্রফুল্ল চাকীর ডাক নাম) ক্ষুদিরামের থেকে বলিষ্ঠ গড়নের এবং বোমা বানানো জানতো সে। তাই বোমাটি প্রফুল্ল চাকীর পক্ষেই ছোঁড়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রফুল্লের আত্মহত্যাও এই দিকেই ইঙ্গিত করে। কেননা সে জানতো সে দোষী। আর দোষী বলেই ধরা পড়লে সাথে সাথে আত্মহত্যা করে সে। সুতরাং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে ক্ষুদিরামের পক্ষে সন্দেহের অবকাশ (Benefit of doubt) থেকেই যায়। কিন্তু সব কিছু বৃথা যায়। বৃথা যায় রংপুর থেকে মামলায় লড়তে যাওয়া আইনজীবীদের তৎপরতা। ঘটনার তিন মাস তের দিন পর ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করলেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী বীর ক্ষুদিরাম বসু।

তথ্যসূত্র


  1. Sarfarosh: A naadi Exposition of the lives of Indian Revolutionaries by K.Guru Rajesh.
  2. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে জানুয়ারি ২০১৫ সাল।
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Khudiram_Bose

One comment

আপনার মতামত জানান