অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক (Antonie van Leeuwenhoek) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি নিজের তৈরি মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে অণুজীবদের পর্যবেক্ষণ করেন। আশ্চর্যের বিষয় হল – পুঁথিগত শিক্ষা তাঁর প্রায় ছিল না বললেই চলে। অথচ তাঁর আবিষ্কার এবং পর্যবেক্ষণকে অনুসরণ করেই বিজ্ঞান জগতে প্রবেশ করে অণুজীব বিদ্যা বা মাইক্রোবায়োলজি (microbiology)।
১৬৩২ সালের ২৪ অক্টোবর লিউয়েনহুকের জন্ম হয় নেদারল্যান্ডের ডেলফ্ট (Delft) শহরে। লিউয়েনহুকের বাবা ছিলেন একজন ঝুড়ি বিক্রেতা যিনি লিউয়েনহুকের শৈশব কালেই মারা যান। লিউয়েনহুকের পড়াশোনা শুরু হয় ওয়ারমৌন্ড (warmound) এর একটি স্কুলে। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় মানুষ করে তোলার। সে আশা তাঁর পূরণ হয়নি। মাত্র চোদ্দ বছর বয়েসে পড়াশোনা ছেড়ে লিউয়েনহুককে আমস্টারডামের (Amsterdam) একটি কাপড়ের দোকানে কাজে ঢুকতে হয়। এখান থেকেই তাঁর কর্মজীবনের সূত্রপাত।
১৬৫৪ সালে তিনি তাঁর নিজের শহর ডেলফ্ট ফিরে আসেন এবং সেখানেই একটি কাপড়ের দোকান শুরু করেন। সেই বছরই স্থানীয় এক মহিলা বারবারা দে মে (Barbara de Mey) এর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৬৬৬ সালে লিউয়েনহুকের স্ত্রী মারা যান। তখন তিনি পাঁচ সন্তানের বাবা। এই সময়ে একটি ঘটনা তাঁর বাকি জীবনের পথকে চিরতরে বদলে দেয়। কাপড়ের ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে তাঁকে কাপড়ের উপাদানের গুণমান পরীক্ষা করতে হত। এই সূক্ষ্ম কাজের জন্যে ব্যবহৃত হত লেন্স । যেকোনও জিনিসের আকারকে বিবর্ধিত করার লেন্সের বিশেষ ক্ষমতাই লিউয়েনহুকের নজর কাড়ে। লিউয়েনহুক খুব মনোযোগের সঙ্গে লেন্সের খুঁটিনাটি সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করেন। কাঁচ ঘষে কী উপায়ে একটি বিবর্ধক লেন্স বানানো হয় সেটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়।
১৬৬৫ সালে রবার্ট হুক কোষের ব্যাপারে প্রথম ধারণা দেন তাঁর বই “মাইক্রোগ্ৰাফিয়া” (micrographia) তে। যদিও তাঁর পর্যবেক্ষণ করা কোষগুলি ছিল মৃত এবং নিউক্লিয়াস বিহীন। লিউয়েনহুকের হাতেও এই বইটি আসে। এই বইটি মূলত তাঁকে অনুপ্রাণিত করে লেন্সের সাহায্যে অণুজীবদের পর্যবেক্ষণ করতে। বাকিটা ছিল নিখাত অধ্যবসায়। বলা হয় অন্তত পক্ষে ৫০০ টা অণুবীক্ষণ যন্ত্র তিনি তৈরি করেন বিভিন্ন লেন্স কাজে লাগিয়ে যাদের মধ্যে মাত্র ১০ টার ব্যবহারিক প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। এর আগে তৈরি হওয়া সমস্ত অণুবীক্ষণযন্ত্রগুলি ছিল যৌগিক এবং দুটি লেন্স দ্বারা নির্মিত। এগুলি দিয়ে যেকোন বস্তুকে ২০ গুন বা তার চেয়ে বেশি বিবর্ধিত করে দেখা যেতে পারতো। লিউয়েনহুকের যন্ত্রটি ছিল অপেক্ষাকৃত সরল এবং মাত্র একটি লেন্স দ্বারা নির্মিত। আশ্চর্যের বিষয় এই একটি লেন্স দিয়ে যেকোন বস্তুর ২০০ – ২৫০ গুন বিবর্ধিত প্রতিবিম্ব তৈরি হত। লেন্সটির ফোকাল দূরত্ব খুব কম থাকায় এটি সম্ভব হয়। কোনরকম পুঁথিগত বিদ্যা বা উচ্চশিক্ষা ছাড়া শুধু অধ্যবসায়ের মাধ্যমে লিউয়েনহুক বানিয়েছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী লেন্স যা তাঁর কৃতিত্বের শোভা বাড়ায়। প্রথমে তাঁর বানানো যন্ত্র দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন পোকামাকড়ের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। যেমন মৌ মাছির হুল, উকুনের পা, মাছির মাথা ইত্যাদি। এবং এই সমস্ত কিছু তাঁকে উৎসাহিত করে নতুন কিছু খোঁজার জন্যে। যে দুটি বিশেষ জিনিস লিউয়েনহুককে তাঁর সমসাময়িক পর্যবেক্ষকদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল তার একটি হল উন্নত এবং শক্তিশালী লেন্স এবং অন্যটি হল প্রত্যেকটি পর্যবেক্ষণকে চিত্রায়িত করার প্রবণতা। এই জন্যে পরে তিনি একজন অঙ্কন শিল্পী নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে এই ছবিগুলিই তাঁর পর্যবেক্ষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণী হিসেবে কাজ করে।
সেটি ছিল ডেলফ্ট শহরে আগস্টের একটি দিন। হল্যান্ডে তখন গ্রীষ্ম। লিউয়েনহুক দেখলেন জলাশয়গুলিতে সবুজ মেঘের মতো কিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি একটি কাঁচের জারে সেগুলির নমুনা সংগ্রহ করলেন এবং পরের দিন মাইক্রোস্কোপে তা পর্যবেক্ষণ করলেন। লিউয়েনহুক দেখলেন বেশ কতগুলি সর্পিলাকারে সজ্জিত সবুজ রেখা গ্লোবিউল (globule) এর মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত আছে। তাঁর দেখা অণুজীবটি ছিল স্পাইরোগাইরা। এই ঘটনাটির মাধ্যমেই অণুজীবের জগতে তাঁর প্রথম পদার্পণ ঘটে। ডেলফ্ট শহরের এক স্বনামধন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন রেগনার দে গ্রাফ ( Regnier de Graaf)। লিউয়েনহুক তাঁকে সর্বপ্রথম নিজের পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে বলেন। রেগনার দে গ্রাফ ছিলেন সদ্য স্থাপিত “রয়েল সোসাইটির” সদস্য এবং লিউয়েনহুকের আবিষ্কারের সত্যিকারের সমঝদার। তাঁর পরামর্শ মতোই ১৬৭৩ সালে লিউয়েনহুক রয়েল সোসাইটিকে চিঠি ও ছবি মারফৎ জানান নিজের আবিষ্কার এবং প্রাথমিক কিছু পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে। প্রথম দিকে লোকেরা এই ব্যাপারে বিশেষ আমল দিত না। কিন্ত হতোদ্যম না হয়ে তিনি পুনরায় মাইক্রোস্কোপে নিজের পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এবার তিনি হল্যান্ডের এগারো জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিজের আবিষ্কার এবং পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে জানান। একজন স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তির এহেন কার্যকলাপ দেখে তাঁরা সকলেই বিস্মিত হন এবং লিউয়েনহুকের পর্যবেক্ষণকে সঠিক বলে একটি সম্মতিপত্র তাঁকে পাঠান। এই সময় তিনি সিলিয়েট (ciliate) নামের প্রোটোজোয়ার সন্ধান পান। এবার তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ চিঠির আকারে লিখে সম্মতি পত্রের সঙ্গে পাঠান রয়েল সোসাইটিকে। এবার আর তাঁরা লিউয়েনহুকের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি। ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে রই রই পরে যায়। এভাবেই বিজ্ঞানীদের জগতে পদার্পণ হয় এমন এক ব্যক্তির যাঁর প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও পাওয়া সম্ভব হয়নি।
১৬৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আরেকটি চিঠি পাঠান যাতে ছিল মানুষের দাঁতের ওপর করা তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ। এক্ষেত্রে তিনি দুটি মহিলা এবং দুটি অপরিচ্ছন্ন বয়স্ক লোকের দাঁতের থেকে তাঁর প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনি মাইক্রোস্কোপের নিচে নমুনাগুলিকে দিয়ে দেখতে পান ব্যাকটেরিয়াদের বিশাল জগৎ যাদের তিনি নাম দেন “অ্যানিম্যালকিউল “(animalcules)। এভাবেই তিনি নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন ড্রেনের জল, বৃষ্টির জল, পুকুরের জল, মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্র ইত্যাদি থেকে এবং প্রতিবার তাঁর পর্যবেক্ষণ চিঠি ও ছবি মারফৎ জানাতে থাকেন। ১৬৭৭ সালে তাঁর মাইক্রোস্কোপের নিচেই ধরা দেয় স্পার্মাটোজোয়া। ১৬৮০ সালে তিনি ইস্টের গোলাকৃতি কোষগুলি দেখতে পান। ১৭০২ সালে তিনি প্রথম লোহিত রক্ত কণিকার নিখুঁত বিবরণ দেন। লিউয়েনহুকের আরেকটি বিশিষ্ট কাজ হলো তিনি পিঁপড়ের ডিম নিয়েও গবেষণা করেন এবং বলেন যেটিকে আমরা পিপড়ের ডিম বলে জানি সেটি আসলে পিপড়ের পিউপা অবস্থা । পরের দিকে তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয় বস্তু ছিল সামুদ্রিক প্রাণীরা যেমন ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি। তখনকার দিনে মানুষের ধারণা ছিল সমুদ্রে প্রাণের উৎপত্তি বালি কাদা ইত্যাদি থেকে। লিউয়েনহুক এই সমস্ত কিছু ভ্রান্ত প্রমাণ করেন এবং বলেন এই সমস্ত জীব সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে কোনো না কোনো জীবের অবদান।
রয়েল সোসাইটিকে তাঁর পাঠানো চিঠির সংখ্যা ছিল ৩৭৫। জীব বিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৬৮০ সালে রয়েল সোসাইটির স্থায়ী সদস্যপদ পান তিনি। একটি সামান্য যন্ত্র এবং নাম মাত্র শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানের জগতে এহেন অবদান রাখার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। ইউরোপের সমস্ত বিজ্ঞানী মহল লিউয়েনহুকের আবিষ্কারকে একযোগে স্বীকৃতি দেয়। বিস্ময়কর ব্যাপার এইটাও যে তিনি কখনোই তাঁর কাজের কোনো স্বীকৃতি নিতে দেশের বাইরে যাননি। রাশিয়ার জার পিটার প্রথম, ইংল্যান্ডের রাজা জেমস দ্বিতীয়, এবং প্রুসিয়ার রাজা ফ্রেডরিক দ্বিতীয় স্বয়ং লিউয়েনহুকের শহরে এসে তাঁকে সন্মানিত করে যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মহান বিজ্ঞানী তাঁর লেন্স তৈরির কৌশল এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নির্মাণ পদ্ধতি বহির্বিশ্বের কাছে গোপন রাখেন। তাঁর কাজকে পর্যালোচনা করে তাঁর জীবদ্দশাতেই দুটি বই দুটি ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি রয়েল সোসাইটিকে একটি পত্র মারফত কৃতজ্ঞতা জানান তাঁর মতো এক অতি নগণ্য ব্যক্তিকে এতো সন্মান দেওয়ার জন্য যা রয়েল সোসাইটি এখনও সংরক্ষণ করে রেখেছে।
১৭২৩ সালের ২৬ আগস্ট তাঁর নিজের শহর ডেলেফ্টে অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুকের মৃত্যু হয়।