মধুসূদন গুপ্ত

মধুসূদন গুপ্ত

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভারতীয় হিসেবে প্রথম আধুনিক পদ্ধতিতে শব ব্যবচ্ছেদ করেন মধুসূদন গুপ্ত (Madhusudan Gupta)। ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতা মেডিকেল কলেজের শবব্যবচ্ছেদের ঘরে প্রথম মানুষের শবদেহ ছুরি হাতে ব্যবচ্ছেদ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। তাঁর আগে মৃত পশুর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে বহু কষ্টে মানব শরীরের আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি শিখতে হতো শিক্ষার্থীদের। জাতধর্ম না বিচার করে মৃতদেহ ছোঁয়ার জন্য মধুসূদন গুপ্তকে সমাজচ্যুত করা হয়েছিল। শুধুই শব ব্যবচ্ছেদ নয়, ১৮৫৩ সালে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বই ‘অ্যানাটমি’। এছাড়াও ‘লণ্ডন ফার্মাকোপিয়া’ এবং ‘অ্যানাটমিস্টস’ গ্রন্থ দুটির বাংলা অনুবাদও করেছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান মধুসূদন গুপ্ত পারিবারিকভাবে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে পারদর্শী হলেও নিজ দক্ষতায় তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিও আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বাঙালি ছাত্রদের সুবিধের জন্য ডাক্তারির বাংলা বিভাগ খোলা হলে তার অধ্যক্ষরূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন মধুসূদন গুপ্ত।

১৮০০ সালে হুগলী জেলার বৈদ্যবাটিতে এক ব্রাহ্মণ বৈদ্য পরিবারে মধুসূদন গুপ্তের জন্ম হয়। গ্রামে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চার জন্য তাঁদের পরিবারের বেশ সুখ্যাতি ছিল। তাঁর ঠাকুরদাদা হুগলির নবাব পরিবারের গৃহচিকিৎসকের কাজ করতেন। তাঁর প্রপিতামহের উপাধি ছিল ‘বক্সী’। বাল্যকালে দুরন্ত মধুসূদন পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন এবং তাঁর বাবা এই কারণে তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিয়েছিলেন।

১৮২৬ সালে সংস্কৃত কলেজের বৈদ্যক বিভাগে ভর্তি হন মধুসূদন গুপ্ত। এই কলেজে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র চর্চা করতে শুরু করেন তিনি এবং তার পাশাপাশি সংস্কৃত, ন্যায়শাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদিতেও দক্ষ হয়ে ওঠেন মধুসূদন গুপ্ত। কলেজে পড়াকালীন আয়ুর্বেদের একজন কবিরাজ ও চিকিৎসক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন তিনি। এই কলেজে পড়ার সময় কাঠ ও মোমের তৈরি মানুষের হাড়-গোড় কিংবা জীব-জন্তুর মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করতেন তিনি। এমনকি জানা যায় যে, আয়ুর্বেদ চর্চার পাশাপাশি কেবলরাম কবিরাজ নামে জনৈক আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখতেও যেতেন মধুসূদন। এই সময় সংস্কৃত কলেজের পাশেই একতলা একটি বাড়িতে ১৮৩২ সালে একটি হাসপাতাল গড়ে ওঠে আর এই হাসপাতালেই ডাক্তার টাইটলার এবং জন গ্রান্টের ঔষধশাস্ত্র বিষয়ক বক্তব্যগুলি খুব মন দিয়ে শুনতেন তিনি।

১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজে ছাত্র থেকে তাঁকে শিক্ষকের পদে নিযুক্ত করা হয়। আসলে আয়ুর্বেদ বিভাগের অধ্যাপক খুদিরাম বিশারদের অবসর গ্রহণের পরে খুদিরাম তাঁর প্রিয় ছাত্রকে নিজের জায়গায় নিযুক্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করলে সংস্কৃত কলেজের কর্তৃপক্ষ তাতে সম্মত হয়। কিন্তু একদিনের সহপাঠী মধুসূদনকে শিক্ষকের পদে দেখে কেউই মেনে নিতে না পারায় ছাত্রমহলে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীকালে মধুসূদনের দক্ষতায় আর নৈপুণ্যে সেই বিক্ষোভ প্রশমিত হয়। ১৮৩৪ সালে মধুসূদন গুপ্ত হুপারের লেখা ‘অ্যানাটমিস্টস ভেড-ম্যাকাম’ বইটি বাংলায় অনুবাদ করার জন্য হাজার টাকা পুরস্কার পান। বাংলায় এই বইয়ের শিরোনাম দিয়েছিলেন তিনি ‘শারীরবিদ্যা’ যা পরে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। ১৮৩৫ সালে স্থাপিত হয় কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং তখন সংস্কৃত কলেজের এই আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বিভাগটি বন্ধ হয়ে যায়। দেশীয় চিকিৎসাপদ্ধতির বদলে পাশ্চাত্যের চিকিৎসা পদ্ধতির উপর জোর দিতে চাইছিলেন সেকালের বিদেশি অধ্যাপকরা। এই মেডিকেল কলেজে শারীরিবিদ্যা ও শল্যবিদ্যা বিভাগের প্রদর্শকের পদে যোগ দেন মধুসূদন গুপ্ত। ১৮৪০ সালে ডাক্তারির একটি পরীক্ষাতেও ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এই কলেজেই চিকিৎসক হেনরি গুডিভ, ডা. ব্রামলি এবং ডা. ব্রুকের সহকারী শিক্ষক হিসেবেও অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। এদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করার জন্য দেশীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের প্রয়োজন দেখা দেয়। এজন্য মেডিকেল কলেজে বিশেষ করে দেশীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন অধ্যাপকেরা। ইউরোপেও শবদেহের অপ্রতুলতার কারণে ভালোভাবে শব ব্যবচ্ছেদ করা যেতো না, কলকাতার আশেপাশে এই অসুবিধে না থাকায় মেডিকেল কলেজে শব ব্যবচ্ছেদ চালু করার কথা ভাবেন ডা. গুডিভ, লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক এবং আরো অনেকে। সে সময় দেশীয় চিকিৎসকেরা কেউই শব ব্যবচ্ছেদ করতে সাহস পেতেন না। সমাজে মৃতদেহ ছোঁয়া নিয়ে নানাবিধ জাতপাতের বেড়াজাল ছিল। মৃত জীবজন্তুর দেহ কাটা-ছেঁআর করে কোনোক্রমে মানুষের শরীরের আভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি চিনতে হতো। এভাবে বিদেশি অধ্যাপকদের শেখাতেও সমস্যা হচ্ছিল বিস্তর। একদিন মেডিকেল কলেজের শবদেহের ঘরে টেবিলের উপরে একটি মৃত মানুষের দেহ রেখে দেন ডা. গুডিভ। ছাত্রদের শব ব্যবচ্ছেদ করতে বললে প্রথমে কেউই এগিয়ে আসেননি। শব ব্যবচ্ছেদ কতখানি প্রয়োজনীয় তা বোঝালেও ছাত্রদের মন থেকে ভয় কাটেনি। কিন্তু মধুসূদন গুপ্তই প্রথম এবং একমাত্র যিনি শব ব্যবচ্ছেদে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদে ঘটে। ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করে ইতিহাস তৈরি করেন মধুসূদন গুপ্ত। তাঁর প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভারতের প্রাচীন চিকিৎসক সুশ্রুত শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু মধুসূদনের এই কাজে হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ তোলপাড় হয়ে উঠলো এবং মধুসূদনকে জাতিচ্যুত করা হল। কিন্তু এই বিরূপ ঘটনায় কোনোভাবেই দমে যাননি তিনি। ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গল দলের সদস্যরা তাঁকে সমর্থন করলেন এবং মধুসূদন গুপ্তের উৎসাহ ও প্রেরণায় ১৮৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারিকানাথ গুপ্ত, উমাচরণ শেঠ এবং নবীনচন্দ্র মিত্র শব ব্যবচ্ছেদ করেন। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, ডেভিড হেয়ার এবং রাধাকান্ত দেবও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে ১৮৩৭ সালে মেডিকেল কলেজে মোট ষাটটি শব ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল। এই দিন যাতে গোঁড়া হিন্দুরা কলেজে কোনো আক্রমণ না করতে পারে, সেই জন্য কলেজের সব ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৮৪৭ সালে ডা. গুডিভ চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকা ‘ল্যান্সেট’-এর সম্পাদকীয় অংশে শব ব্যবচ্ছেদের দিনের একটি অভিজ্ঞতা লিপিবচ্ছ করেছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে মধুসূদন গুপ্তই ছিলেন প্রথম হিন্দু শব ব্যবচ্ছেদকারী যিনি এক লহমায় সমস্ত সামাজিক বিধিনিষেধ ও কুসংস্কার দূর করে এই কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁকে প্রশংসা জানাতে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে পঞ্চাশ রাউণ্ড স্যালুট জানানো হয়। উনিশ শতকের সমাজে দ্বারকানাথ ঠাকুরও মেডিকেল কলেজের এই আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৮৩৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যা এবং শব ব্যবচ্ছেদের প্রতি আগ্রহী তরুণেরা একত্রিত হয়ে গড়ে তোলেন ‘সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ’। মধুসূদন গুপ্তের এই কাজকে স্মরণীয় করে রাখতে বেথুন সাহেব এস.সি.বেলনসকে নির্দেশ দেন মধুসূদন গুপ্তের একটি তৈলচিত্র আঁকতে যেখানে তাঁর এক হাতে একটি মানুষের মাথার খুলি থাকবে আর এই ছবিটি পরে কলকাতা মেডিকেল কলেজে টাঙানো হয়। ১৮৪৮ সালে ডা. গুডিভের বক্তব্য থেকে জানা যায় বিগত বছরে মোট ৫০০টি শব ব্যবচ্ছেদ ঘটেছে কলকাতায়।

১৮৩৬ সালে কলকাতায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমাতে ‘জেনারেল কমিটি অফ দ্য ফিভার হসপিটাল অ্যাণ্ড মিউনিসিপ্যাল ইম্প্রুভমেন্টস’-এর একটি সভায় ডাকা হয় মধুসূদন গুপ্তকে এবং তাঁরই পরামর্শে এই কমিটি কলকাতাকে রোগ-জ্বরমুক্ত করার কাজে নিয়োজিত হয়। তাঁর পরামর্শেই কলকাতায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, এমনকি নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতিসাধনের কথাও ভাবা হয়। ১৮৫০ সালের মার্চ মাসে স্মল কমিশনেও মধুসূদন গুপ্ত একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

১৮৩৬ সালে ‘লণ্ডন ফার্মাকোলজি’ বইটির বাংলায় অনুবাদ করেন মধুসূদন ‘ঔষধ কল্পাবলী’ নামে। চিকিৎসাশাস্ত্রে উপর তাঁর গভীর জ্ঞান এবং পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার দক্ষতা মিলেমিশে তিনি একজন দক্ষ অনুবাদকের মতো হিন্দু প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রের রচনাগুলিও অনুবাদ করতে থাকেন। তাঁর সহায়তা ডা. ওয়াইজ যে সুশ্রুতের রচনা অনুবাদ করেন, তা সম্পাদনা করেছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। ১৮৫৩ সালে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাশাস্ত্রের বই ‘অ্যানাটমি’।

১৮৫৬ সালের ১৫ নভেম্বর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মধুসূদন গুপ্তের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান