সববাংলায়

নিকোলাই গোগোল

নিকোলাই গোগোল (Nikolai Gogol) একজন রুশ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং নাট্যকার ছিলেন। রুশ এবং ইউক্রেনীয় সাহিত্যে তাঁর অপরিসীম অবদান রয়েছে।

১৮০৯ সালের ১ এপ্রিল (পুরনো পদ্ধতিতে ২০ মার্চ) ইউক্রেনের সোরোচিনৎসির কোসাক শহরে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত পোলটাভা গভর্নেটে নিকোলাই গোগোলের জন্ম হয়। তাঁর সম্পূর্ণ নাম নিকোলাই ভ্যাসিলিয়েভিচ্ গোগোল। তাঁর বাবার নাম ভাসিলি গোগোল-ইয়ানোভস্কি একজন শখের নাট্যকার ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন ১৭১০ সালের লুবনি রেজিমেন্টের আধিকারিক লিওন্টি কোসিয়ারোভস্কির বংশধর। গোগোল শৈশব থেকেই ইউক্রেনীয় ভাষায় লেখা নাটকগুলিকে মঞ্চস্থ করার কাজে তাঁর কাকাকে বাড়ির নাট্যশালায় সাহায্য করতেন।

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর ১৮২০ সালে গোগোল শিল্পে উচ্চশিক্ষার জন্য নিঝাইনের একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৮২৮ সাল পর্যন্ত সেখানেই শিক্ষালাভ করেন তিনি। মূলত এখানেই তাঁর সাহিত্যকর্মের সূত্রপাত হয়।

স্কুল ও কলেজজীবনে নিজের লেখা বেশ কয়েকটি কবিতা একত্রিত করে গোগোল নিজের খরচেই বের করলেন কবিতার বই। কিন্তু তাঁর কবিতার বই এক কপিও বিক্রি হল না। রাগে তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের সব কপি আগুনে পুড়িয়ে দেন। পরবর্তীকালে সেন্ট পিটার্সবার্গে স্বল্পবেতনের একটি সরকারি চাকরি পান। তবে মাসখানেক পরেই এর চেয়ে ভালো আরও একটি চাকরি পেয়ে গেলেন তিনি। এই চাকরি করার পাশাপাশি তিনি সাময়িক পত্রপত্রিকাতেও লিখতে শুরু করলেন। ইউক্রেনে তাঁর গ্রামের কথা, সেখানকার প্রচলিত রূপকথা-উপকথাগুলিকেই তিনি চমৎকার ভাষায় লিখে পত্রিকাতে প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁর লেখাগুলি ক্রমে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। পরে ১৮৩১-৩২ সালে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছোট গল্পগুলি গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হতে শুরু করে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ইংরেজি শিরোনামে ‘ইভনিং অন আ ফার্ম নেয়ার ডিকাঙ্কা’ (Evening on a farm near Dikanka) শিরোনামে দুঃখণ্ডে। বই দুটি প্রকাশের সাথে সাথে লেখকমহলেও পরিচিত হলে উঠলেন গোগোল। এই সময়ে লেখকমহলে যাঁদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি আলেকজান্দার পুশকিন এবং ভ্যাসিলি ঝুকোভস্কি, গল্পলেখক সেরগেই অ্যাক্সাকভ এবং সাহিত্য সমালোচক ভিসারিয়ন বেলিনস্কিসহ আরও অনেকে। বছর খানেক পরে তাঁর দ্বিতীয় সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে তিনি শিক্ষকতা শুরু করলেন এক বালিকা বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক।

আরও পড়ুন:  ডঃ বি আর আম্বেদকর

১৮৩৪ সালে তিনি স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। কিন্তু এই ভালো চাকরিটাও বেশিদিন করলেননা। চাকরি ছেড়ে দিয়ে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করলেন লেখালেখির কাজে। ১৮৩৫ সালেই প্রকাশিত হলো তাঁর পরপর দুটি বই – মিরগোরদ’ (Mirgorod) এবং ‘অ্যারাবেস্কি’ (Arabeski)। এর মধ্যে ‘মিরগোরদ’ ছিল এর আগে প্রকাশিত ‘ইভিনিং’ গ্রন্থেরই শেষাংশ। তিনি তার নিজের গাঁয়ের যে গল্পগুলোকে নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রকাশ করছিলেন, সেই ধারারই শেষগ্রন্থ ছিল ‘মিরগোরদ’।কিন্তু গোগোল পরবর্তী সময়ে যে বাস্তবধর্মী লেখা লিখে সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, সেগুলোর সাথে প্রথমজীবনের এই লেখাগুলোর ছিল দুস্তর ব্যবধান। তাঁর পরবর্তী গ্রন্থের নাম ইংরেজিতে ‘Story of the Quarrel between Ivan Ivanovich and Ivan Nikiforovich’। এটি ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ একটি ইতরজীবনের কাহিনী। তার সমকালীন রুশীয় সমাজের রূঢ় বাস্তবতা ফুটে উঠেছে তাঁর এই গল্পের ভেতর দিয়ে। তিনি এ গল্পে হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের একটি ক্লেদাক্ত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।তার আরেকটি গল্প Starosvetskiye Pomeshchiki (ইংরেজি নাম Old World Landowners) — এটিও একটি বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে এক বৃদ্ধ দম্পতির জীবনসংগ্রামের চিত্র দেখানো হয়েছে। এখানে একদিকে ফুটে উঠেছে লেখকের রসবোধ, তেমনি কঠোর বাস্তবতার ছবি। সমাজের নীচতা ও কদর্যতা ফুটে উঠেছে তার Zapiski Sumasshedshego (ইংরেজি নাম Dairy of Mad Man) গল্পেও। ১৮৩৬ সালে গোগোল তাঁর বন্ধু পুশকিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকায় কয়েকটি গল্প প্রকাশ করেন। Kolyaska (ইংরেজি নাম The Coach) এবং Nos (ইংরেজি নাম The Nose) সহ তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয় পুশকিন সম্পাদিত পত্রিকায়।আলেকজান্দার পুশকিনের এবং গোগোলের বন্ধুত্ব ছিল রুশ সাহিত্যের জন্য এক মণিকাঞ্চন যোগ। তাঁরা ছিলেন একে অপরের সহযোগী এবং পরিপূরক। গোগোল যেমন সর্বক্ষণ পুশকিনের কবিতার সমালোচক ও ভুল সংশোধন করে দিয়ে সহযোগিতা করতেন, তেমনি পুশকিনও তাঁর বন্ধু গোগোলকে অনেক গল্পের প্লটের যোগান দিয়ে সাহায্য করতেন। পুশকিনের দেওয়া প্লটের ওপর ভিত্তি করে গোগোলের দুটি উল্লেখযোগ্য রচনা হল Revizor এবং অপরটি হল উপন্যাস Myortvye Dushi। রোমে অবস্থানকালেই গোগোল রচনা করেন তাঁর সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস Myortvye Dushi ইংরেজিতে যার নাম ‘Dead Souls’। এটি ছিল গোগোলের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। অনেক সমালোচক বইটিকে একটি গদ্য-মহাকাব্য বলেও অভিহিত করেছেন। গোগোলের ‘ডেড সোলস’ রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে। এটি একটি অসমাপ্ত গল্প। আসলে গোগোলের ইচ্ছে ছিল দু’খণ্ডে বইটির কাহিনী শেষ করার। তাঁর জীবনীকারদের কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ডেড সোলসের দ্বিতীয় খণ্ডের রচনাও প্রায় শেষ করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশ করেননি। এরপর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়। সেই উন্মাদ অবস্থাতেই তিনি মৃত্যুর মাত্র দশ দিন আগে তাঁর ডেড সোলসের দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন। তাই আজও এটি একটি অর্ধসমাপ্ত গ্রন্থ। ‘ এরপর তিনি পরপর তিনটি গল্প রচনা করলেন। প্রথমটি Inferno । এখানে দেখানো হলো রাশিয়ার সমাজব্যবস্থাকে। এর পরের আরও দুটো গল্প হলো Purgatorio Fm এবং T Paradiso। এই তিনটি গল্পই মূলত চিচিকভের পাপময় অস্তরকে বিশুদ্ধ করে তাকে নরক থেকে স্বর্গে তুলে আনার কাহিনী। অর্থাৎ প্রতারক চিচিকভকে মন্দ থেকে ভালোর দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। গোগোল দেখলেন, তাঁর এ তিনটি গল্পের কোনোটাই সাহিত্যমানের দিক থেকে উৎরাতে পারেনি। তিনি ক্রমশ হতাশ পড়তে শুরু করেন। তাই মনের শাস্তি আনার জন্য তিনি ১৮৪৮ সালে প্যালেস্টাইনে গেলেন প্রভু যিশুর কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু তাতেও তাঁর মনে শাস্তি ফিরে এলো না। অবশেষে তিনি ফিরে এলেন মস্কোতে। এখানে এসেও শাস্তি ফিরে পেলেন না। তাঁর যেন সর্বক্ষণ মনে হতে লাগল, ঈশ্বরের ক্রোধ তাঁকে অনুসরণ করছে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি মস্কোর ধর্মযাজক ফাদার ম্যাভেয় কনস্টান্টিনোভস্কির শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। ম্যাভেয় তাঁর ওপর তন্ত্রমন্ত্র ও ঝাড়ফুঁক চালাতে লাগলেন। তিনি গোগোলকে এই বলে বিভ্রান্ত করতে লাগলেন যে, এমন মন্দ মানুষের গল্প রচনা করে গোগোল ঈশ্বরের বিরাগভাজন হয়েছেন। ঈশ্বরের অভিশাপ পড়েছে তাঁর ওপর। এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, এ ধরনের সাহিত্যচর্চা বন্ধ করা। ধর্মযাজকের প্ররোচনাতেই গোগোল তাঁর ডেড সোলসের দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন। শেষ হয়ে যায় সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ।

আরও পড়ুন:  ইব্রাহিম আলকাজি

এর মাত্র দশদিন পরেই ১৮৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিকোলাই গোগোলের মৃত্যু হয়।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

বাদল সরকারের জীবনী দেখুন

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন