এক কথায় ইরানীয়দের নববর্ষ সূচিত করে ‘নওরোজ’ (Nowruz)। বাঙালিদের যেমন পয়লা বৈশাখ, ইংরেজদের নিউ ইয়ার, চিনের বসন্তকালীন উৎসব তথা চৈনিক নববর্ষ পালনের রীতি রয়েছে; তেমনিই সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইরানীয়দের মধ্যে নওরোজ পালিত হয়। ফার্সি বর্ষপঞ্জীর প্রথম মাসের প্রথম দিন এটিই। তাই নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে নানাবিধ সংস্কার ও রীতি-নীতি প্রচলিত রয়েছে ইরানীয়দের মধ্যে। তাঁদের সংস্কৃতিতে এই নওরোজ তাই এক বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এই নওরোজই উত্তর গোলার্ধে নিয়ে আসে বসন্তের পেলব ছোঁয়া।
‘নওরোজ’ হল ইরানি সৌর বর্ষপঞ্জী অনুসারে পালিত ইরানি নববর্ষ। এই উৎসবকে ‘পারস্য নববর্ষ’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ফার্সি ভাষায় ‘নওরোজ’ শব্দের অর্থ হল ‘নতুন দিন’। এই দিনটি ইরানি বর্ষপঞ্জীর প্রথম দিন। সাধারণত মহাবিষুব তথা বসন্ত বিষুবের দিন অর্থাৎ ২১ মার্চ দিনটিই নওরোজ হিসেবে পালিত হয়। সৌর হিজরি বর্ষপঞ্জীর প্রথম মাস ‘ফারভারদিন’ সূচিত হয় এই বিশেষ দিনটির মাধ্যমে। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে মানুষ এই বিশেষ দিনটি উদ্যাপন করে থাকে। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জীতে ২১ মার্চের আশেপাশেই পড়ে নওরোজের দিনটি। ইরানীয়দের জরাথুষ্ট্রীয় ধর্মে এই নববর্ষ পালনের রীতি রয়েছে এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া, কৃষ্ণ সাগর অববাহিকা, বলকান ও দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে প্রায় ৩ হাজার বছর ধরে এই নববর্ষের রীতি ও ঐতিহ্য বহমান।
ফার্সি শব্দ ‘নওরোজ’ মূলত ‘নিউ’ অর্থাৎ নতুন এবং ‘রুজ’ অর্থাৎ দিন এই দুটি শব্দের মিশেলে নির্মিত। ইরানে মূলত সৌর হিজরি বর্ষপঞ্জীর মাধ্যমে এই নওরোজের দিনটি গণনা করা হয়ে থাকে। ইরানীয় উপকথা ও পুরাণে বিভিন্ন কাহিনী ছড়িয়ে আছে এই নওরোজকে কেন্দ্র করে। ‘শাহনামা’ মহাকাব্যে বলা আছে পৌরাণিক ইরানীয় রাজা জামসিদই প্রথম বিধ্বংসী শীতের হাত থেকে মানব সমাজকে রক্ষা করতে এই নওরোজ উৎসব পালনের রীতি চালু করেন। শীতের শীতল-মারণ স্পর্শ থেকে বাঁচতে তিনি মণি-রত্ন দিয়ে একটি সিংহাসন নির্মাণ করেন। দানবেরা তাঁকে পৃথিবীর উপরে স্বর্গে স্থান দিয়েছিল যেখানে তিনি সূর্যের মত জাজ্জ্বল্যমান ছিলেন। ক্রমে তাঁকে দেখে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুল একত্রিত হয় এবং তাঁর চারধারে অলংকার ছড়িয়ে রাখে এবং এই দিনটিকেই সকলে নতুন দিন (New Ruz) হিসেবে অভিহিত করে। সেই থেকেই ইরানীয় বর্ষপঞ্জীর প্রথম মাস ফারভারদিনের প্রথম দিন হিসেবে নওরোজ পালিত হয়। জরাথুষ্ট্রীয়দের উৎসব পালনের রীতির মধ্যে ছয় গাহাম্বার এবং নওরোজের উল্লেখ পাওয়া যায় যা কিনা বসন্ত বিষুবের সময়ে উদ্যাপিত হত। দশম শতাব্দীতে ঐতিহাসিক আল-বিরুণীর বইতেও ইরানীয়দের পালনীয় উৎসবের মধ্যে নওরোজের উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দে মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের পরে নওরোজ আব্বাসীয় শাসনকালে একটি রাজকীয় ছুটিতে পরিণত হয়। ইরানীয় বুয়িদ শাসক আদুদ আল দৌলা নওরোজ উৎসবকে স্বাগত জানাতেন রাজকীয় সম্মানে। জাঁকজমকপূর্ণভাবে সজ্জিত একটি বিশাল প্রেক্ষাগৃহে সোনা ও রূপার থালায় ফল ও রঙিন ফুলে সজ্জিত ফুলদানি দিয়ে এই বিশেষ দিনকে স্বাগত জানানো হত। নওরোজ উপলক্ষ্যে রাজ দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার সামনে এগিয়ে এসে মাটিতে চুম্বন করে নতুন বছরকে অভ্যর্থনা জানাতেন। পরবর্তীকালে তুর্কি ও মোঙ্গলদের শাসনকালেও এই নওরোজের প্রথা অটুট ছিল। ১০৭৯ সালে সেলজুক রাজবংশের আমলে ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে আটজন পণ্ডিতের একটি দল নওরোজ থেকে শুরু হওয়া নতুন বছরের হিসেবে এক নতুন বর্ষপঞ্জী নির্মাণ করে। আধুনিক কালে ২০১০ সালে এই নওরোজের দিনটি ইউনেস্কোর মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (UNESCO List of the Intangible Cultural Heritage of Humanity) তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়।
এই নববর্ষের দিনটির আগের দিনটিকে ফার্সি ভাষায় বলা হয় ‘ছারশানবে সুরি’ (Charshanbe Suri) অর্থাৎ উৎসবমুখর বুধবার। ইরানে নওরোজের ঠিক আগের বুধবারেই এটি পালন করা হয়। সাধারণভাবে আগুনের উপর দিয়ে লাফ দেওয়া কিংবা আতশবাজি ও পটকা ফাটানোর মধ্য দিয়ে নববর্ষের আগের সন্ধ্যাটি পালিত হয়। আজারবাইজানে আবার এক মাস আগে থেকেই নওরোজের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সেখানে নওরোজের ছুটির আগে চার সপ্তাহ ধরে প্রতি মঙ্গলবার নানাবিধ সংস্কার ও উপচার পালিত হয়। এই চার সপ্তাহের প্রত্যেক মঙ্গলবার দিনকে যথাক্রমে জল, আগুন, পৃথিবী ও বায়ু এই চারটি প্রাকৃতিক উপাদানের জন্য উৎসর্গ করা হয়। নওরোজের সন্ধ্যায় আত্মীয়দের সমাধিস্থলে গিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন আপামর ইরানীয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইরানীয়রা বলে থাকেন – ‘My yellow is yours, your red is mine’ এই ছড়ার পংক্তিটি যার অর্থ হল আমার দুর্বলতা তোমাকে দিলাম আর তোমার সকল শক্তি ধারণ করলাম আমি নিজে। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে সেই উৎসবের সন্ধ্যায় সকল ইরানীয় প্রার্থনা করেন যেন সেই অগ্নিশিখা তাঁদের জীবন থেকে সকল দুঃখ-বেদনা-রোগ হরণ করে আর সুস্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি এবং ভরপুর প্রাণশক্তিতে তাঁদের উজ্জীবিত করে তোলেন। আশ্চর্যজনকভাবে ছারশানবে সুরির রাতের অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল চামচ ভাঙা। ইরানে এই দিন মানুষেরা ছদ্মবেশ ধারণ করে দরজায় দরজায় ঘুরে বাটি কিংবা প্লেটে চামচ বাজিয়ে চলে আর গৃহস্থদের থেকে প্যাকেটবন্দি খাবার উপহার পায়। আজারবাইজানে একইভাবে শিশুরা খুব মজা করে তাঁদের আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের বাড়ির সামনে স্লিপ খায় আর তাঁদের দরজার সামনে টুপি কিংবা ঝুড়ি রেখে লুকিয়ে থাকে যতক্ষণ না বাড়ির ভিতর থেকে কেউ এসে ক্যান্ডি বা বাদাম কিংবা পেস্ট্রি রেখে যায়। টানা ১৩ দিন ধরে নওরোজের ছুটি চলে ইরানে। এই ছুটির একেবারে ত্রয়োদশ দিন অর্থাৎ শেষ দিনে বাড়ি-ঘর ছেড়ে ইরানীয়রা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাইরে যায় এবং বাইরে নানা জায়গায় বনভোজনও করে থাকেন। এই রীতিটি আসলে ‘সিজদেবেদার’ (Sizdebedar) অনুষ্ঠানেরই একটি বিশেষ অংশ। এপ্রিল ফুল পালনের মত এই দিনেও মানুষেরা মজার মজার জোক বলেন কিংবা নকল কিছু সেজে বা নকল কোনও দৃশ্য রচনা করে আনন্দ উপভোগ করেন।
পার্সিদের মধ্যে এই উৎসবটির জনপ্রিয়তা খুব। পার্সিরা মনে করে তাদের ধর্মের প্রাণপুরুষ জরাথুষ্ট্র প্রথম এই উৎসবটির প্রচলন করেন। পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই দিনটিতে টেবিল জুড়ে বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যান সম্বলিত বই, সারিবদ্ধভাবে জ্বালানো মোমবাতি, সেরামিক প্লেটের ওপর অঙ্কুরিত গম বা বিনস্,একটি ছোট্ট বাটিতে কিছু রূপোর কয়েন, ফুল, হাতে আঁকা ডিম, গোলাপ জল এবং একটি কাঁচের জলভর্তি জারে একটি গোল্ডফিশ সাজিয়ে রাখেন। পার্সিরা মনে করেন এইভাবে টেবিল সাজালে গৃহে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বজায় থাকবে। টেবিল সাজানোর এই পদ্ধতিকে বলে ‘হাফত-সিন’ (Haft-sin)। টেবিল সাজানোর ক্ষেত্রে মূলত সাতটি উপাদান অবশ্যই থাকে – সবজি, সামানু, পারস্য অলিভ, ভিনিগার, আপেল, রসুন এবং সুমাক। জরাথুষ্ট্রীয়রা মনে করেন ‘জেন্দ-আবেস্তা’য় কথিত রয়েছে হাফত-সিন পদ্ধতিতে টেবিল সাজানোর এই পদ্ধতিতে সাতটি উপাদানের এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে যা আসলে আগুন, জল, বায়ু ও মাটি এই চারটি প্রাকৃতিক উপাদান এবং মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ এই তিন জীবকুলকে বোঝায়। নওরোজ উপলক্ষ্যে বাড়ি-ঘর ভালভাবে পরিস্কার করার রীতি রয়েছে ইরানীয়দের মধ্যে এবং এই বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে নতুন জামা-কাপড় পরার পাশাপাশি হায়াসিন্থ ও টিউলিপ ফুল কিনে থাকেন তারা। এই দিন বহু মানুষ তাঁদের পরিচিত আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের বাড়িতে যান, সামান্য কিছু সময় কাটান এবং গৃহস্থবাড়িতে অতিথিদের পেস্ট্রি, কুকি, শুকনো ফল, বাদাম ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয়। নওরোজ উপলক্ষ্যে প্রধানত যে খাবারটি বানানো হয়ে থাকে তা হল ‘সামানু’ (Samanu)। গমবীজ দিয়ে তৈরি এই খাবারটি বহু দেশেই নওরোজের দিনে বানানোর রীতি রয়েছে। তুর্কমেনিস্তান, উজিবেকিস্তান, আফগানিস্তান ইত্যাদি অঞ্চলে রাত্রে এই সামানু প্রস্তুত করা হয় এবং তা খাওয়ার সময় স্মৃতি থেকে বহু গান গেয়ে থাকেন ইরানীয়রা। এই দিনের অন্যতম খাবার হল নুডলস্। পার্সিরা মনে করে নুডলস্-এর ঢেউ এর মত আকার জীবনের অসংখ্য সম্ভাবনার পরিচায়ক। এই খাবারকে পার্সিরা ‘আশ- রেশতে’ বলে। এই দিন বাড়িতে মানুষজন ‘হাফট-মেওয়া’-ও (Haft-mewa) বানিয়ে থাকেন।
আফগানিস্তান, আলবানিয়া, জর্জিয়া, ইরান, কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানে নওরোজের দিনটি সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। একমাত্র ইরান বাদে বাকি বেশিরভাগ অঞ্চলেই কোথাও পাঁচদিন, কোথাও চারদিন ছুটি থাকে নওরোজ উপলক্ষ্যে। শুধু তাই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস, ফিনিক্স, টরন্টো, কোলোন ও লন্ডনের ইরানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উৎসব পালনের রেওয়াজ আছে।