সৌরভ গাঙ্গুলী

সৌরভ গাঙ্গুলি

সৌরভ গাঙ্গুলি( Sourav Ganguly) একজন প্রাক্তন ভারতীয় বাঁ হাতি ক্রিকেটার ও ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক বর্তমানে যিনি BCCI এর সভাপতি।

১৯৭২ সালে ৮ জুলাই কলকাতার বেহালায় এক ধনী পরিবারে সৌরভ গাঙ্গুলির জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম সৌরভ চন্ডীদাস গাঙ্গুলি। তাঁর বাবা চন্ডীদাস গাঙ্গুলি ছিলেন কলকাতার একজন সফল মুদ্রণ ব্যবসায়ী ও অন্যতম ধনী ব্যাক্তি। তাঁর মায়ের নাম নিরূপা গাঙ্গুলি। সৌরভ হলেন বাবা ও মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর বড় দাদা স্নেহাশিস গাঙ্গুলিও একজন প্রাক্তন ক্রিকেটার। তবে ছোট ভাই সৌরভের মতো স্নেহাশিস গাঙ্গুলির আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রিকেট খেলার সুযোগ না হলেও তিনি বাংলার হয়ে প্রায় দশ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। বর্তমানে তিনি পারিবারিক মুদ্রণের ব্যবসা’র দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছেন। স্নেহাশিস গাঙ্গুলি ছিলেন সৌরভের ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণা। সৌরভ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন।

ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় সৌরভের ছোটবেলা বেশ বিলাসিতাতেই কেটেছে। বাড়িতে সৌরভের ডাক নাম ছিল মহারাজ। প্রথম দিকে সৌরভের ফুটবল খেলার প্রতি আকর্ষণ ছিল যা অবশ্য পরবর্তী কালে ক্রিকেটের প্রতি তৈরি হয়। তাঁর মায়ের ইচ্ছে ছিল সৌরভ খেলার পরিবর্তে পড়াশোনায় মন দিক। দাদা স্নেহাশিস গাঙ্গুলি’র অনুপ্রেরণায় সৌরভ ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান। দাদা স্নেহাশিস বাবার অনুমতি নিয়ে সৌরভকে গরমের ছুটির সময় ক্রিকেট কোচিং ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেন। গাঙ্গুলি সেই সময়ে দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন। এই সময় থেকেই তাঁর ক্রিকেট সাধনার শুরু। ডান-হাতি ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও সৌরভ গাঙ্গুলি বাঁ-হাতে খেলার চেষ্টা করতেন যাতে দাদার ক্রিকেট খেলার জিনিসগুলো তিনি ব্যবহার করতে পারেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাঁ হাতি ক্রিকেটার হিসাবেই নিজেকে ক্রিকেট জগতে প্রতিষ্ঠা করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

উপযুক্ত শরীর চর্চা ও ক্রিকেট প্র্যাক্টিসের জন্য বাড়ির ভিতরেই সৌরভের জন্য ছোট-খাটো কংক্রিটের ক্রিকেট মাঠ এবং জিমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে তিনি দাদার সাথে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস করতেন। অবসর সময়ে সৌরভ দাদার সাথে পুরানো ক্রিকেট খেলার ভিডিও দেখতেন। এই পুরানো ভিডিওর মধ্যে সৌরভ ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ডেভিড গাওয়ারের খেলা’র খুব ভক্ত ছিলেন।

অনুর্ধ পনেরো বিভাগে বাংলার হয়ে উড়িষ্যার বিরুদ্ধে মাঠে নেমে, সৌরভ সেঞ্চুরি করার পর তাঁর স্কুল সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে তাঁকে স্কুলের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। সৌরভ অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে তাঁর অনেক সহপাঠী অভিযোগ করেন ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হওয়ার কারণে সৌরভের আলাদা অহংকার ছিল। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের অনান্য জুনিয়র টিমের সাথে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সফর করার সময় দলের অধিনায়ক হিসাবে সৌরভের কিছু দায়িত্ব ভার ছিল- যেমন খেলার দরকারি সরঞ্জাম ও পানীয় জল দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া। কিন্তু সৌরভ মনে করতেন এই কাজগুলি করলে দলের অন্য খেলোয়াড়দের সামনে তাঁর সম্মান হানি হবে। অধিনায়ক হিসাবে এই কাজগুলিতে সৌরভের অনীহা ছিল। কিন্তু একজন পেশাদার খেলোয়াড় হিসাবে সৌরভ নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে ১৯৮৯ সালে বাংলার হয়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই বছরই তাঁর বড়দাদা স্নেহাশিস গাঙ্গুলি বাংলা ক্রিকেট দল থেকে বাদ পড়ে যান।

সৌরভের ক্রিকেট জীবন শুরু স্কুল ম্যাচ এবং বাংলার হয়ে খেলার মাধ্যমে। নিজেকে প্রমাণ করার ব্যাকুল প্রচেষ্টায় তিনি একের পর এক ম্যাচে নজির গড়েছেন। ১৯৯০-৯১ সালে রঞ্জি ম্যাচে তিনি অংশ গ্রহন করেন। ১৯৯২ সালে ওয়ান ডে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিসের বিপক্ষে ভারতীয় দলে তিনি প্রথম খেলার সুযোগ পান। কিন্তু মাত্র তিন রান করায় তিনি দল থেকে বাদ পড়েন। এছাড়াও টিমের অন্য সতীর্থদের সাথে তেমন পরিচয় না রাখা ও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অহংকার তাঁর দল থেকে বাদ পড়ার অন্যতম আরও এক কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। ভারতীয় দলের হয়েও তিনি দলের অন্য সতীর্থদের পানীয় জল বাহক হতে অস্বীকার করেছিলেন।

সৌরভ ১৯৯৩-৯৪ সাল নাগাদ বাংলার রঞ্জি ট্রফি ও দলীপ ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। এই সময়ে সৌরভ নিজেকে প্রমাণ করে বিশ্বের কাছে নিজের পরিচিতি গড়তে মরিয়া হয়ে উঠেন। আরও একবার ভারতীয় দলে খেলার জন্য তাঁকে নির্বাচন করা হয়। ১৯৯৬ সালে ভারতীয় দলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গাঙ্গুলি প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে যান। মহম্মদ আজহারউদ্দিনের অধিনায়কত্বে ও লর্ডসের মাঠে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে গাঙ্গুলি সেঞ্চুরি (১৩১) করেন। লর্ডসের মাঠে জীবনের প্রথম টেস্টে বিশ্বে হাতে গোনা মাত্র কয়েক জন ক্রিকেটারই সেঞ্চুরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সৌরভের এই সেঞ্চুরি সবার নজর কাড়ে এবং তিনি ভারতীয় দলে শক্ত ভাবে নিজের জায়গা সহজেই তৈরি করে নেন। এরপরের শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতীয় দলে’র হয়ে খেলে তিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন।

১৯৯৬ সালের দুর্দান্ত ইংল্যান্ড সফরের পরের বছরেই সৌরভ তাঁর ছোট বেলার বান্ধবী ডোনা রায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই ঘটনায় সৌরভকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে হইচই পরে যায়। এই বছরেই অনুষ্ঠিত একদিনের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সৌরভ আবার সেঞ্চুরি করেন। ১৯৯৭ সালে পরপর চারটি ম্যাচে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হন তিনি যার মধ্যে তিনটি ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। সৌরভ বোলার হিসেবেও নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও সৌরভ সেঞ্চুরি করেন এবং রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে একসাথে ৩১৮ রানের পার্টনারশিপ গড়ে তোলেন। এটা ছিল কোন বিশ্বকাপের পার্টনারশিপ স্কোরে’র সর্বোচ্চ রান।

২০০০ সালে ভারতীয় দলের অন্য সতীর্থদের ম্যাচ গড়াপেটার কলঙ্কের পর শচীন দলের অধিনায়কের পদ থেকে ইস্তফা দেন। এই সময়ে সৌরভকে দলের সহ-অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। সৌরভের নেতৃত্বে ২০০০ সালে ভারতীয় দল আইসিসি (ICC) টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। এই টুর্নামেন্টে ১১ টি দল অংশ গ্রহণ করেছিল। এই সময়ে একজন সুদক্ষ অধিনায়ক হিসাবে সৌরভ নিজেকে প্রমাণ করেন।

২০০২ সালে ইংল্যান্ডে’র লর্ডসে অনুষ্ঠিত ন্যাট ওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে ভারত ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ট্রফি জিতে নেয়। ইংল্যান্ডকে হারানোর পর আগ্রাসী সৌরভ লর্ডসের ব্যালকনিতে নিজের জামা উড়িয়ে যেভাবে আনন্দ করেছিলেন তা সেই সময়ে সমালোচনার ঝড় তোলে।
২০০৩ সালে ভারতীয় দল অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার সুযোগ পায়।

কিন্তু অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও সৌরভের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ভালো না থাকায় ২০০৫ সালে সৌরভকে টিম থেকে বাদ দেওয়া হয়।

এছাড়াও এই সময়ে জাতীয় ক্রিকেট কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে সৌরভের বিতর্ক সংবাদ মাধ্যমে আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। গ্রেগ চ্যাপেল বিসিসিআই (BCCI) কে মেল করে জানান “সৌরভ শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ নয়। তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া উচিত। সৌরভের আচরণে টিমের অন্য সতীর্থদের অসুবিধা হচ্ছে”। কোচের এই মেল সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিতর্কের শুরু হয়। পরে বিসিসিআই এর সভাপতি রণবীর সিং মাহেন্দ্র এই পরিস্থিতির সামাল দেন। ২০০৬ সালে সৌরভ আবার নিজের দক্ষতায় দলে ফিরে আসেন।

২০১৫ সালে সৌরভ ক্রিকেট এসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (CAB) এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ২০১৯ সাল অবধি তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।

২০০৮ সালে আইপিএল (IPL) শুরু হলে শাহরুখ খানের টিম কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক নির্বাচিত হন সৌরভ। এই বছরেই অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচটি ছিলো সৌরভের শেষতম টেস্ট ম্যাচ।
২০০৯ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্স থেকে সৌরভকে বাদ দেওয়া হয়।

ক্রিকেট জীবন থেকে অবসর নিলেও সৌরভ নানা কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। দাদাগিরি নামে অসম্ভব জনপ্রিয় একটি প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তিনি।

বর্তমানে ইন্ডিয়ান সুপার লীগ (ISL) নামে আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্টে আটলেটিকো দে কলকাতা টিমের যুগ্ম মালিক তিনি।

২০১৯ সালে সৌরভ গাঙ্গুলি বিসিসিআই (BCCI) এর সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে একাধিক বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর তিনি।

One comment

আপনার মতামত জানান