বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান কল্পকাহিনী লেখক আইজ্যাক আসিমভ (Issac Asimov)। আনুমানিক পাঁচশোটিরও বেশি বই লিখেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তাঁর লেখা ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ সেরা সর্বকালীন সিরিজ হিসেবে হুগো পুরস্কারে ভূষিত হয়। আসিমভের লেখা গ্যালাক্টিক ‘এম্পায়ার’ সিরিজ এবং ‘রোবট’ সিরিজ আজও রসিক পাঠকের কাছে খুবই জনপ্রিয়। ‘পল ফ্রেঞ্চ’ ছদ্মনামে কিশোরদের উপযোগী ‘লাকি স্টার’ সিরিজও লিখেছেন আইজ্যাক আসিমভ। আমেরিকান হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ‘গ্র্যান্ডমাস্টার অফ সায়েন্স ফিকশন’ নামেও তিনি পরিচিত হয়েছিলেন সমগ্র বিশ্বে। তাঁর বই থেকেই বিখ্যাত সব কল্পবিজ্ঞানধর্মী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘নাইটফল’ তাঁর লেখা অন্যতম বিখ্যাত একটি ছোটগল্প।
আনুমানিক ১৯১৯ সালের ২ জানুয়ারি রাশিয়ার পেট্রোভিচিতে একটি রুশ-ইহুদী মিলার পরিবারে আইজ্যাক আসিমভের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল আন্না রাসেল এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল জুডাহ আসিমভ। তাঁর মাতামহ আইজ্যাক বার্মানের নামানুসারে তাঁর নামকরণ করা হয় আইজ্যাক। ১৯২১ সালে আসিমভ এবং পেট্রোভিচির আরও ১৬ জন শিশুর নিউমোনিয়া রোগ দেখা দেয়। তাঁদের মধ্যে কেবলমাত্র আসিমভই বেঁচে ছিলেন। আইজ্যাক আসিমভের আরও এক বোন ও এক ভাই ছিল যাদের নাম যথাক্রমে মার্সিয়া এবং স্ট্যানলি। স্ট্যানলে পরবর্তীকালে লং আইল্যান্ড নিউজডে’র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে লিভারপুল হয়ে তাঁর পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়। তাঁর বাবা-মা সবসময় তাঁর সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন বলে রাশিয়ায় জন্ম হলেও রুশ ভাষা শিখতে পারেননি তিনি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পড়তে শিখে গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তাঁর বোনকেও তিনিই পড়তে শেখান এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্কুলে ভর্তি করানোর যোগ্য করে তোলেন। তাঁর মা আসিমভকে স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করান এবং তাঁর জন্মতারিখ হিসেবে ১৯১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দিনটির কথা বলেন। পরে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে এই ভুলের সম্পর্কে অবগত হয়ে আসিমভ স্কুলের খাতায় সেই তারিখ পরিবর্তন করে ২ জানুয়ারি করার জন্য জোর দিতে থাকেন। ১৯২৮ সালে মাত্র আট বছর বয়সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন তিনি। তাঁর বাবা-মায়ের একটি মিষ্টদ্রব্য ও লজেন্সের দোকান ছিল। সেই দোকানেই ছোটবেলা থেকেই দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল আসিমভকে। অন্য অনেক পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে পত্র-পত্রিকা আর কিছু সংবাদপত্রও বিক্রি হত সেখানে। এর মাধ্যমেই এক বিপুল জ্ঞানের ভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর সামনে। দোকানে আসা সব পত্রিকা এবং সংবাদপত্র পড়ে ফেলতেন আইজ্যাক আসিমভ। এইসব পত্র-পত্রিকার মধ্যে ‘পাল্প সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন’ও ছিল যা তিনি গোগ্রাসে পড়তেন এবং মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই এইরকম কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়তে শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯৪২ সালের ২৬ জুলাই গারট্রুড ব্লুগারম্যানের সঙ্গে প্রথমবার বিবাহ হয় আইজ্যাক আসিমভের। তাঁদের দুই সন্তানের নাম যথাক্রমে ডেভিড ও রবিন জন। পরবর্তীকালে তাঁদের বিচ্ছেদ হলে আসিমভ একজন মনোবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখিকা জ্যানেট ও জেপসনকে বিবাহ করেন।
পাঁচ বছর বয়স থেকে ব্রুকলিনের বয়েজ হাই স্কুল সহ নিউ ইয়র্ক সিটি পাবলিক স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করেছিলেন আইজ্যাক আসিমভ। ১৫ বছর বয়সে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তিনি কিছুদিন নিউ ইয়র্কের সিটি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন এবং তারপর ব্রুকলিনের ডাউনটাউনে অবস্থিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা সেঠ লো জুনিয়র কলেজে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্ত ইহুদি ও ইতালীয়-আমেরিকান ছাত্ররা পড়ার সুযোগ পেত না, তারা সকলেই এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হত। প্রথমে প্রাণীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করার পরে তিনি রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে পড়তে শুরু করেন প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষার পর থেকে। ১৯৩৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে আইজ্যাক আসিমভ ভর্তি হন মর্নিংসাইড হাইটস ক্যাম্পাসে এবং সেখান থেকেই ১৯৩৯ সালে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ সালে রসায়নশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি এবং ১৯৪৮ সালে রসায়নে ‘ডক্টর অফ ফিলোসফি’ অর্থাৎ পিএইচডি ডিগ্রি পান আসিমভ। রসায়ন অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি ফরাসি ও জার্মান ভাষাও শিখেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিন বছর আইজ্যাক আসিমভ ফিলাডেলফিয়া নেভি ইয়ার্ডের ন্যাভাল এয়ার স্টেশনে বেসামরিক রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয় তাঁকে। কিন্তু ১৯৪৬ সালেই একটি আমলাতান্ত্রিক সমস্যার কারণে তাঁকে টাস্কফোর্স থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে অনুষদ হিসেবে পাঁচ হাজার ডলার মাসিক বেতনে কাজ করতে শুরু করেন আইজ্যাক আসিমভ। সেখানে তিনি জৈব রসায়ন পড়াতেন। এদিকে লেখালিখিতে বেশি মনোযোগ দেওয়ার কারণে গবেষণা বন্ধ করে দিয়েছিলেন আসিমভ, তাই ১৯৫৭ সালে তাঁকে শিক্ষকের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রতি বছর জৈব রসায়নের ক্লাসে একটি করে উদ্বোধনী বক্তৃতা দিতেন এবং অন্যদিকে তাঁর লেখার জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়তে থাকায় তাঁর লেখাকে সম্মান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জৈব রসায়ন বিভাগের পূর্ণ সময়ের স্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করে।
এগার বছর বয়সেই কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখা শুরু করেছিলেন আইজ্যাক আসিমভ। ১৬ বছর বয়সে তাঁর বাবা তাঁকে একটি টাইপরাইটার কিনে দিয়েছিলেন। পরে ১৮ বছর বয়সে আসিমভ ‘ফিউচারিয়ান্স সায়েন্স ফিকশন ফ্যান ক্লাব’-এর সদস্য হন। ১৯৩৪ সালে বয়েজ হাই স্কুলের সাহিত্য-পত্রিকায় তাঁর ভাইয়ের জন্য একটি হাস্যরসাত্মক গল্প লিখেছিলেন আইজ্যাক আসিমভ। সাল তারিখের হিসেবে এটাই তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা। তারপর ১৯৩৭ সাল থেকে পেশাদারিভাবেই লিখবেন বলে মনস্থির করেন তিনি এবং জীবনের প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনীটি লিখে ফেলেন আইজ্যাক আসিমভ ‘কসমিক কর্কস্ক্রু’ নামে। সেই গল্পটি শেষ করার পরে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকার সম্পাদক জে ডব্লিউ ক্যাম্পবেলের কাছে তা পাঠিয়ে দেন ছাপার জন্য, কিন্তু অমনোনীত আকারে একটি ব্যাখ্যা সহ লেখাটি ফেরত আসে। ঐ বছরই তিনি আরেকটি গল্প লেখেন ‘স্টোয়াওয়ে’ নামে, কিন্তু এই গল্পটিও ক্যাম্পবেল খারিজ করে দেন। তারপর দীর্ঘ এক বছর ধরে বহু গল্প লেখা অভ্যাসের পরে ১৯৩৮ সালে ‘মেরুনড অফ ভেস্তা’ নামে একটি গল্প লিখে তা ‘অ্যামেজিং স্টোরিস’ পত্রিকার সম্পাদক রেমন্ড এ পামারের কাছে পাঠিয়ে দেন তিনি। সেই গল্পটি ১৯৩৯ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং সাম্মানিকস্বরূপ তিনি ৬৪ ডলার পেয়েছিলেন সেই সময়। সেই বছর ‘অ্যামেজিং স্টোরিস’-এ আরেকটি গল্প ছাপা হয় তাঁর ‘দ্য ওয়েপন টুউ ড্রেডফুল টু ইউজ’ নামে আর ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকার জুলাই সংখ্যাতেও ‘ট্রেন্ডস’ নামে তাঁর আরেকটি গল্প ছাপা হয়। ১৯৪০ সালের পর ২৫ মাস সময়ের মধ্যে তিনি ২২টি গল্প লিখেছিলেন যার মধ্যে মাত্র ১৩টি গল্প ছাপা হয়। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর থেকে কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি এতটাই বেড়ে যায় যে এমন কোনও গল্প নেই তাঁর যা অপ্রকাশিত থেকে গিয়েছে। ১৯৪১ সালে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকায় ‘নাইটফল’ নামে একটি দুর্ধর্ষ গল্প লেখেন আইজ্যাক আসিমভ এবং ১৯৬৮ সালে ‘সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা’ এই গল্পটিকে সর্বকালের সেরা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীকালে শুধু সায়েন্স ফিকশনই নয়, ফ্যান্টাসি, রহস্য-রোমাঞ্চ, ইতিহাসমূলক, জনপ্রিয় বিজ্ঞানকেন্দ্রিক এমনকি প্রবন্ধ-নিবন্ধের বইও লিখেছেন তিনি এবং তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় পাঁচশোটি। ১৯৫০-এর দশকে ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ লেখা শুরু করেন আইজ্যাক আসিমভ যার মধ্যে ‘ফাউন্ডেশন’, ‘ফাউন্ডেশন এন্ড অ্যান এম্পায়ার’ এবং ‘সেকেন্ড ফাউন্ডেশন’ নামের তিনটে বই তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উন্নীত করে। তারপরে বেশ কয়েক দশক তিনি এই সিরিজ নিয়ে অন্য কোনও লেখা লেখেননি, কিন্তু পাঠকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার দরুন ১৯৮০ সাল নাগাদ আইজ্যাক আসিমভ লেখেন ‘ফাউন্ডেশন এজ’, ‘ফাউন্ডেশন এন্ড অ্যান আর্থ’, ‘প্রিল্যুড টু ফাউন্ডেশন’, ‘ফরওয়ার্ড দ্য ফাউন্ডেশন’ নামে আরও চারটে বই লেখেন। বিজ্ঞানী হ্যারি শেলডনের মাধ্যমে ‘সাইকো-হিস্ট্রি’ নামে নতুন এক বিজ্ঞানের শাখার জন্ম এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন কীভাবে এগোবে তাই নিয়েই এই সিরিজের কাহিনী গড়ে তুলেছিলেন আইজ্যাক আসিমভ। তাঁর লেখা ‘এম্পায়ার’ সিরিজের ৩টি উপন্যাস আর ‘রোবট’ সিরিজের ৫টি উপন্যাসও খুবই বিখ্যাত।
সমগ্র জীবনে খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন আইজ্যাক আসিমভ। ১৯৫৫ সালে ত্রয়োদশ বিশ্ব কল্পবিজ্ঞান কাহিনী সম্মেলনের সম্মানীয় অতিথি ছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে হাওয়ার্ড ডব্লিউ ব্লেকস্লি পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৬৩ সালে তিনি হুগো পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়া ১৯৭২ সালে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের জন্য নেবুলা পুরস্কার, ১৯৭৩ সালে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের জন্য লোকাস পুরস্কার অর্জন করেছেন আসিমভ।
১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে আইজ্যাক আসিমভের মৃত্যু হয়।
One comment