সৈয়দ আহমেদ খান

সৈয়দ আহমেদ খান

ব্রিটিশ শাসিত ভারতের একজন মুসলিম সমাজ সংস্কারক ছিলেন সৈয়দ আহমেদ খান (Syed Ahmad Khan)। তিনি ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় মুসলিমদের আধুনিক ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যদিও তিনি প্রাথমিকভাবে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্বন্ধে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত হয়েছিলেন। তিনিই মুসলিমদের সংস্কার বিষয়ক ‘আলিগড় আন্দোলন’-এর পথিকৃৎ।

১৮১৭ সালের ১৭ অক্টোবর তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লিতে সৈয়দ আহমেদ খানের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ আহমদ তাকভি বিন সৈয়দ আহমদ মুত্তাকি। তাঁর বাবার নাম ছিল সৈয়দ আহমেদ মুত্তাকি এবং মায়ের নাম ছিল আজিজ-উন-নিসা। এই পরিবারটি ছিল ভীষণভাবেই রাজপরিবার ঘনিষ্ঠ। আহমেদের বাবা ব্যক্তিগত ভাবে তৎকালীন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহকে চিনতেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে আহমেদই ছিলেন সবচেয়ে ছোট। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম ছিল সৈয়দ মহম্মদ বিন মুত্তাকি খান এবং বড় দিদির নাম ছিল সাফিয়াত-উন-নিসা। পরবর্তী জীবনে পারসা বেগম ওরফে মোবারক বেগম নামক এক মহিলার সঙ্গে আহমেদের বিবাহ হয়। এই দম্পতির সৈয়দ হামিদ এবং সৈয়দ মাহমুদ নামে দুই পুত্রসন্তান এবং আমিনা নামে এক কন্যাসন্তান ছিল। এদের মধ্যে তাঁদের কন্যাসন্তান আমিনা খুব ছোটবেলাতেই মারা যায়।

১৮২২ সালে তাঁর বাবার আধ্যাত্মিক গুরু শাহ গোলাম আলী কর্তৃক আহমেদের শিক্ষার সূচনা হয়েছিল। তাঁকে একজন মহিলা গৃহশিক্ষকের দ্বারা কোরান পড়তে এবং বুঝতে শেখানো হয়েছিল। তিনি দিল্লিতে মুসলিম আভিজাত্যের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পৈতৃক বাড়ি সংলগ্ন একটি বাড়িতে একজন শিক্ষিত পণ্ডিত মৌলভী হামিদুদ্দীন কর্তৃক পরিচালিত মক্তবে যোগদান করেন এবং ফারসি ও আরবি ভাষা শিখতে শুরু করেন। তিনি সাহাবী, জাউক এবং গালিবের মতো মুসলিম পণ্ডিত এবং লেখকদের রচনাগুলি পড়েছিলেন, এবং অন্যান্য শিক্ষকেরা তাঁকে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বীজগণিতের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আহমেদ হাকিম গোলাম হায়দার খানের অধীনে বেশ কয়েক বছর ধরে ঔষধবিদ্যা (medicine) অধ্যয়ন করেন। সৈয়দ আহমেদ সাঁতার, শুটিং এবং অন্যান্য খেলাধুলায়ও পারদর্শী ছিলেন। তিনি মুঘল আদালতের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং পার্টি, উৎসব এবং আবৃত্তিতে অংশ নিয়েছিলেন।
সৈয়দ আহমদের বড় ভাই দিল্লি থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সৈয়দুল আখবার’ চালু করেন, যা ছিল উত্তর ভারতের প্রথমদিকের উর্দু সংবাদপত্র। ১৮৩৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সৈয়দ আহমেদ একটি ধনী তরুণ মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির মতো প্রথাগত জীবন যাপন করতেন। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর, তিনি তাঁর দাদা এবং বাবার উপাধি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এবং সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর কর্তৃক ‘আরিফ জং’ উপাধিতে ভূষিত হন। আর্থিক সমস্যা সৈয়দ আহমেদের প্রথাগত শিক্ষার অবসান ঘটায়, যদিও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বই ব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যান।

মুঘল রাজনৈতিক শক্তির ক্রমাগত পতনের আভাস পেয়ে সৈয়দ আহমেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঔপনিবেশিক সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করতে পারেননি কারণ শুধু ১৮৬০ এর দশকেই ভারতীয়দের ভর্তি করা হয়েছিল। তাঁর প্রথম নিয়োগ ছিল সেরেস্তাদার বা দিল্লিতে সদর আমিনের কার্যালয়ে ফৌজদারি বিভাগের কেরানি। তাঁর কাজ ছিল রেকর্ড রাখা এবং আদালত বিষয়ক ব্যবস্থাপনা করা। ১৮৩৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে আগ্রায় বদলি করা হয় এবং কমিশনার অফিসে নায়েব মুন্সী বা ডেপুটি রিডার পদে উন্নীত করা হয়। ১৮৪১ সালে তিনি ফতেপুর সিক্রির মুন্সিফ বা সাব-জজ হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরে ১৮৪৬ সালে দিল্লিতে বদলি হন। তিনি ১৮৫০ এবং ১৮৫৩ সালে সদর আমিনের দায়িত্ব পালন করার সময় রোহতকে দুটি স্বল্পমেয়াদী বদলি ছাড়া ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে ছিলেন। ১৮৫৫ সালে তিনি বিজনরে সদর আমিন পদে উন্নীত হন।

উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত সৈয়দ আহমেদ আদালতে চাকরির সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজনীতি সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ভারতীয় বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের সময়, ১৮৫৭ সালের ১০ই মে সৈয়দ আহমেদ বিজনোর আদালতে প্রধান মূল্যায়ন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি বিজনরের ব্রিটিশ অফিসারদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বিদ্রোহী সৈন্যদের থেকে অনেক অফিসার এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। সংঘর্ষের ফলে বিপুল সংখ্যক অসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিল। দিল্লি, আগ্রা, লখনউ এবং কানপুরের মতো মুসলিম শক্তির পূর্ববর্তী কেন্দ্রগুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আহমেদও সিপাহী বিদ্রোহের হানাহানিতে বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে হারান। যদিও তিনি তার মাকে অশান্তি থেকে উদ্ধার করতে সফল হয়েছিলেন, তবে তাঁর মা যে আঘাত পেয়েছিলেন তার কারণে তিনি মিরাটে মারা যান।

১৮৫৮ সালে, তিনি মুরাদাবাদের আদালতে ‘সাদার-উস-সুদুর’ নামে একটি উচ্চ পদে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, ‘দ্য কজ অব দ্য ইন্ডিয়ান রিভোল্ট’-এর কাজ শুরু করেন। ১৮৬২ সালে, তিনি গাজীপুরে এবং পরে ১৮৬৪ সালে আলীগড়ে স্থানান্তরিত হন। ১৮৬৪ সালে তাকে বেনারসে পাঠানো হয় এবং সাব-জজ পদে উন্নীত করা হয়। ১৮৬৯ সালের এপ্রিল মাসে, তিনি তার দুই পুত্রের সঙ্গে বিদেশ যান। তাঁর পুত্র সৈয়দ মাহমুদ ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি পেয়েছিলেন এবং সৈয়দ হামিদও একই সাথে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন।

সৈয়দ আহমেদ ১৮৭৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং আলীগড়ে স্থায়ী হন। ১৮৭৮ সালে, তিনি ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের অতিরিক্ত সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ১৮৭৮ সালের জুলাই মাস থেকে ১৮৮০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি দ্বিতীয় মেয়াদ পান যা ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তিনি ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের আইন পরিষদের দায়িত্ব পালন করেন।

সৈয়দ আহমেদ ভারতের পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের সার্বিক উন্নতি ঘটানোর জন্য অনেক কাজ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলিমরা ‘আলিগড় আন্দোলন’-এ সামিল হয়। তিনি মুসলিমদের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’। এই শিক্ষায়তনে ইংরেজ শিক্ষকরা মুসলিম যুবকদের কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেক-এর চেষ্টায় আহমেদ ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব বিস্তার আটকাতে ‘এডুকেশনাল কংগ্রেস’, ‘ইউনাইটেড পেট্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্ধী তিনটি সংস্থা গঠন করেন। এছাড়াও মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য আহমেদ ‘তাহজিব-উল-আকলার্ক’ এবং ‘পাইওনিয়ার’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য গড়ে তোলেন ‘বিজ্ঞান সমিতি’, ‘অনুবাদ সমিতি’, ‘কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং অ্যামং দ্য মহামেডান অফ ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি সংস্থা। গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়।

মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি নারীমুক্তি আন্দোলনেও সৈয়দ আহমেদের বড় ভূমিকা ছিল। তিনি বিজ্ঞানের আলোতে মুসলিমদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘কোরান শরীফ’-এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার আলোতে আনার কথা বলেন। মুসলমান সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা যেমন তালাক প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পর্দা প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। এই সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।

সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি সৈয়দ আহমেদ একজন সুলেখকও ছিলেন। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম হল, ‘দ্য কজেস অফ দ্য ইন্ডিয়ান রেভল্ট’, ‘আসর-উস-সানাদিদ’, ‘এ ভয়েজ টু মর্ডার্নিজম’, ‘দ্য মহামেডান কমেন্ট্রি অন দ্য হোলি বাইবেল’, ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ দ্য লয়াল মহামেডানস অফ ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি। আহমেদ আবুল ফজল রচিত সম্রাট আকবরের জীবনচিত্র ‘আইন-ই-আকবরি’-এর একটি সটীক এবং সচিত্র সংস্করণ রচনা করেছিলেন। মুসলিম ধর্মের প্রবক্তা হজরত মহম্মদের জীবনের উপরেও তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।

সৈয়দ আহমেদ খান তাঁর কৃতিত্বের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁকে ‘অর্ডার অফ দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া’র একজন সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত করা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের জন্য এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ‘এল.এল.ডি’ ডিগ্রি পেওদান করে। তিনি ‘খান বাহাদুর’ পদবি লাভ করেন এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতীয় এবং পাকিস্তানি ডাক বিভাগ সৈয়দ আহমেদ খানের সম্মানে তাঁর ছবি সম্বলিত ডাকটিকিট চালু করেছিল।

১৮৯৮ সালের ২৭শে মার্চ ৮০ বছর বয়সে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের অন্তর্গত আলিগড়ে সৈয়দ আহমেদ খানের মৃত্যু হয়।

3 comments

  1. স্যার সৈয়দ আহমেদের সংস্কারগুলির প্রধান উদ্দেশ্য কি ছিল

আপনার মতামত জানান