সববাংলায়

উত্তমকুমারের নাট্যজীবন

উত্তম কুমার শুধু সিনেমার নায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অনবদ্য থিয়েটার অভিনেতাও।উত্তমকুমারের নাট্যজীবন নিয়ে বাঙালী খুব কমই জানে। আজ এই পরিসরে মহানায়কের নাট্যজীবন নিয়ে আসুন কিছু আলোচনা করা যাক।

সাহিত্যিক নিরুপমা দেবীর ‘শ্যামলী’ উপন্যাস নিয়ে তৈরি ‘শ্যামলী’ নাটকটির নায়ক ছিলেন উত্তমকুমার আর নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। দেখা গেল, শুধু জনপ্রিয়তা নয়, এই নাটক বাংলা থিয়েটারেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। অন্য দিকে ১৯৫৬ সালে এই নাটককেই পর্দায় নিয়ে এলেন পরিচালক অজয় কর। উত্তমকুমার ও কাবেরী বসু অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি দর্শকদের কাছে হয়ে গেল আর এক বিস্ময়।

স্টারে ‘‌শ্যামলী’‌ নাটকটিতে অভিনয় করার পরে উত্তমকুমারের নাম হয়ে গিয়েছিল শ্যামল। নামটি দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়। এ নাটক দেখে তিনি এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে নাটক শেষে গ্রিনরুমে গিয়ে উত্তমকে জানিয়ে আসেন যে এরপর থেকে তিনি উত্তমকে ‘‌শ্যামল’‌ বলেই ডাকবেন।

নাটকে অবশ্য উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রটির নাম ছিল অনিল। নিরুপমা দেবী লিখিত কাহিনীতে এ চরিত্রটি আধুনিক–‌মনস্ক, সংস্কারমুক্ত এক যুবা, যে এক অসহায় বোবা মেয়েকে বিয়ে করছে, সেই মেয়েই শ্যামলী। চরিত্রটি করতেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। শত প্ররোচনাতেও অনিল অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রী শ্যামলীকে ছাড়তে রাজি নয়। আবার এই নাটকে অনিলের মা সরলার চরিত্র করতেন নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালা দেবী। যাঁকে উত্তম ‘‌সরযূ মা’‌ বলে ডাকতেন। শোনা যায়, এ নাটক দেখার পর বহু মহিলা দর্শকই বলতেন, আমার যদি উত্তমের মতো একটা ছেলে থাকত।

‘‌শ্যামলী’‌ প্রথমবার মঞ্চস্থ হয় ১৯৫৩ সালের দুর্গাপূজার সময়।১৫ অক্টোবর তখন পুজোতে নতুন নাটক নামত ‘‌বোর্ড’‌ মানে বাণিজ্যিক থিয়েটারে। তখনও পর্যন্ত উত্তমের হিট বলতে দুটোই ছবি— ‘‌বসু পরিবার’‌ আর ‘‌সাড়ে ৭৪’‌। দায়িত্ববান স্বামী আবার একই সঙ্গে নিষ্ঠাবান পুত্র— এমন একটি রসায়নে ভেজা চরিত্র অনিল, সন্দেহ নেই উত্তমের ‘‌পারিবারিক হিরো’‌র কেরিয়ারে বাড়তি আঁচ জুগিয়েছিল। টানা তিন বছর জুড়ে এই নাটকের ৪৮৪ রজনীর নায়ক হয়েছিলেন উত্তম। যখন শো করা বন্ধ করেন, তখন তিনি বাংলা ছবির ‘‌সুপারস্টার’‌

পাঁচশো রজনী পূর্ণ হতে তখন আর মাত্র ১৬টি শো বাকি। সপ্তাহে চারটি করে শো হত এ নাটকের। মানে আর এক মাস শো হলেই ‘‌মাইলস্টোন’‌টি ছুঁড়ে ফেলত ‘‌শ্যামলী’‌। তখনও এ সৌভাগ্য কোনও নাটকের হয়নি। অথচ এমন সময়ে কেন এ নাটক ছাড়লেন উত্তম?‌

সে সময়ে একটি ‘‌গুজব’‌ বাজারে উড়ছিল। উত্তমের সঙ্গে নায়িকা সাবিত্রীর সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। রটেছিল পারিবারিক অশান্তির জেরে নাকি মঞ্চ ছাড়লেন উত্তম। কিন্তু যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা হল মঞ্চেই উত্তমের অসুস্থ হয়ে পড়া। শো কোনওরকমে শেষ করেই তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। বন্ধু ডাক্তার লালমোহন মুখোপাধ্যায় পরীক্ষা করে বোঝেন উত্তমের ‘‌প্যারাটাইফয়েড’‌ হয়েছে। এতে শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে উত্তমের যে মঞ্চের ধকল নেওয়া আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে ‘‌শ্যামলী’‌র অনিল বদলায়। উত্তমের জায়গায় আসেন নবকুমার। নবকুমার ছিলেন মঞ্চের নামী অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ীর ছেলে। বেশ কিছু সিনেমাও করেছেন। কিন্তু ওই চরিত্রে উত্তম ছাড়া আর কাউকেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না দর্শক। ফলে, টিকিট বিক্রি কমল। উত্তম সে খবর পেয়ে ‘‌স্টার থিয়েটার’‌–‌এর প্রতি মমত্ববশতঃ ফিরে আসেন বটে আবার এ নাটকে, তবে তা সামান্য কিছুদিনের জন্য।

‌স্টার থিয়েটারে উত্তমের যোগদান নিয়ে দুটো ঘটনার কথা জানা যায়।

মঞ্চে মহানায়ক

এক, অ্যামেচার থিয়েটারের ব্যাপারে কয়েকটি বিরক্তির কথা উত্তম একবার জহর গাঙ্গুলিকে বলেন, তখন তাঁরা বিখ্যাত নাটক থেকে তৈরি চিত্রনাট্য ‘‌মানময়ী গার্লস স্কুল’‌–‌এর শুটিং করছেন। জহরবাবু উত্তমকে পরামর্শ দেন, বাণিজ্যিক থিয়েটারে যোগ দিতে। বলেন, এখানে একেবারে সরাসরি দর্শকের হাটে অভিনেতা নিজের অভিনয় ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার পরিমাপ করে নিতে পারেন। স্টার কর্তৃপক্ষকেও তিনি উত্তমের কথা বলেন।

দুই, উত্তমকে স্টারে আনার ব্যাপারে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়েরও একটা ভূমিকা ছিল। ছবি বিশ্বাস তখন স্টার থিয়েটার ছেড়ে মিনার্ভা থিয়েটারে যোগ দিয়েছেন। এই দুই থিয়েটারের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সর্বজনবিদিত। ছবিবাবু তখন করছেন মিনার্ভায় ‘‌ঝিন্দের বন্দী’‌। নিজে প্রধান দ্বৈত চরিত্রে আর ময়ুরবাহনের চরিত্রে আনবেন ভাবছেন উত্তমকে। এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে স্টার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সাবিত্রী উত্তমকে আনান ‘‌শ্যামলী’‌–‌তে।

‘‌শ্যামলী’‌তে অভিনয় করতেন উত্তমের একদা অভিনয়–‌শিক্ষক সন্তোষ সিংহও। নাট্যকার ছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। যিনি এর আগে উত্তমের ‘স্ট্রাগলিং’‌ পিরিয়ডেই ফিল্মের সেটে তাঁকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন দুর্গাদাসের পরে বাঙালি নতুন নায়ক পেতে চলেছে। রঙমহলের সফল নাট্যকার দেবনারায়ণ সেই প্রথম এসেছেন স্টারে। নতুন চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে। আর বহু খরচ করে সেই প্রথম মঞ্চে ‘‌রিভলবিং ডিস্ক’‌ লাগিয়েছেন স্টারের মালিক সলিল মিত্র (‌এ জন্য এই নাটকের বুকলেটের প্রচ্ছদে থাকত একটি ঘূর্ণায়মান বৃত্তের ছবি।)‌ ফলে খরচ তোলার চ্যালেঞ্জ সলিলবাবুর সামনেও।

সব চ্যালেঞ্জই উতরে দিয়েছিলেন উত্তমকুমার।

স্টার ছাড়বার সময় ‘‌শ্যামলী’‌র স্ক্রিপ্টটি সেখানে অফিসঘরে রেখে আসেন দেবনারায়ণবাবু। স্টারে যখন আগুন লাগে, ভস্মীভূত হয়ে যায় সেটাও।

উত্তমের গ্রুপ থিয়েটার ‘‌শ্যামলী’‌ শুধু উত্তমের বাণিজ্যিক মঞ্চে অভিষেক ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল আরও দুজনের। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মজার কথা হল, এটা অনেকেই জানেন না, এঁরা তিনজনেই এর আগে একই দলে থিয়েটার করেছেন। সে দলের নাম ‘‌কৃষ্টি ও সৃষ্টি’‌। দলের মহলাঘর ছিল শ্যামবাজারে। দর্পণা সিনেমার পাশের গলিতে। অফিস সেরেই দৌড়ে আসতেন উত্তর কলকাতায়। মহলায়। বন্ধু শম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌলতে এই দলে আসা তাঁর। দলের আগে নাম ছিল ‘‌হুজুগে সঙ্ঘ’‌। পরে নাম বদলে ‘‌কৃষ্টি ও সৃষ্টি’‌। এই দলে উত্তম আর সাবিত্রীর একসঙ্গে প্রথম নাটক ছিল ভানু চট্টোপাধ্যায়ের (‌বন্দ্যোপাধ্যায় নন)‌ ‘‌আজকাল’‌। সাবিত্রী তখন ‘‌উত্তর সারথী’‌ নামের এক দলের প্রযোজনায় অভিনয় করেন ‘‌নতুন ইহুদি’‌ নাটকে। তাতে অভিনয় করেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ভানুবাবুই একদিন বন্ধু উত্তমকে নিয়ে এলেন স্টেজ রিহার্সাল দেখাতে। তখন অরুণ চট্টোপাধ্যায় উত্তমকুমার হননি। সাবিত্রীর অভিনয় মুগ্ধ করল তাঁকে। সাবিত্রী দেবীর বাবার সঙ্গে কথা বললেন তাঁকে দলে পাওয়ার জন্য। বাবা বললেন মেয়েকে মহলায় নিয়ে যেতে হবে এবং পৌঁছে দিতে হবে কাউকে, স্বয়ং উত্তম বা অরুণই সেই দায়িত্ব নিলেন।

এই দলেই এরপর সাবিত্রী–‌উত্তম একসঙ্গে করেছেন ‘‌কঙ্কাবতীর ঘাট’‌। যাতে অভিনয় করতেন উত্তমের আরেক বন্ধু সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। করেছেন ‘‌কানাগলি’‌। এ নাটকে শেষ দৃশ্যে এত তন্ময় হয়ে অভিনয় করতেন উত্তম, শোনা যায় মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন!‌ ফলে ‘‌শ্যামলী’‌তে দুজনের সাফল্য ছিল আসলে অবাণিজ্যিক থিয়েটারেরই জয়।

উত্তম–‌সাবিত্রী আরেকবার অবাণিজ্যিক থিয়েটারে একসঙ্গে নেমেছেন। আর তা ‘‌শ্যামলী’‌–‌তেই!‌ আর সে নাটক করা নিয়ে স্টার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উত্তমের সম্পর্ক ভাঙে ভাঙে আর কি!‌ নাটক তখন সবে শত রজনী পার করেছিল। উত্তমের পাড়ার নাট্যদল ছিল লুনার ক্লাব। এখানেই নাটক নিয়ে তাঁর পরীক্ষা–‌নিরীক্ষার হাতেখড়ি। উত্তম পুরনো নাটক দেখতেন, বয়স্কদের সঙ্গে করতেনও, কিন্তু পুরনো থিয়েটারের ধরাবাঁধা ছক, লম্ফঝম্ফ আর কৃত্রিম স্বরক্ষেপণে অভিনয় তাঁর না–‌পসন্দ ছিল। চাইতেন সহজ স্বাভাবিক অভিনয়। যা ধরা আছে সত্যজিৎ রায়ের ‘‌নায়ক’‌ সিনেমার ভেতর এক মঞ্চাভিনয়ের দৃশ্যে। আর তাই সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে এই ‘‌লুনার ক্লাব’‌ গড়া। এখানে ‘‌সাজাহান’‌ নাটকে উত্তম হয়েছেন দিলদার, ‘‌কর্ণার্জুন’‌–‌এ শ্রীকৃষ্ণ, ‘‌দুই পুরুষ’‌–‌এ সুশোভন।

তা, এই লুনার ক্লাবের সে বছর সিলভার জুবিলি। উত্তম ঠিক করলেন ‘‌শ্যামলী’‌ হবে। সাবিত্রী থাকবেন, উত্তম নিজে থাকবেন। আর থাকবেন তাঁর বন্ধুরা। কথাটা জানতে পেরে সলিল মিত্র দুই পরিচালক শিশির মল্লিক আর যামিনী মিত্রকে দিয়ে বারণ করালেন। কিন্তু উত্তম বললেন এ নাটক করতে না দিলে তিনি দরকারে স্টার ছেড়ে দেবেন। সরযূবালা উত্তমের পাশে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়ালেন টেকনিশিয়ানেরা। ‘‌শ্যামলী’‌ হল শেষমেশ লুনার ক্লাবে।

১৯৬৮–‌তে দেবনারায়ণ গুপ্তকে ফোন করে উত্তম চেয়েছিলেন আরেকবার স্টারে ফিরে আসতে। বলেছিলেন একটা নাটক লিখতে যাতে তাঁর চার–‌পাঁচটা ‘‌এন্ট্রি’‌ থাকবে। সে নাটক অবশ্য হয়নি।

কিন্তু উত্তম তাঁর নাট্যক্ষুধা মিটিয়ে নিয়েছিলেন নবগঠিত ‘‌শিল্পী সাংসদ’‌–‌এর মাধ্যমে। প্রতি বছর নাটক নামত এই ব্যানারে। নাট্য–‌শিল্পীদের সংবর্ধনা দেওয়া হত। কোনও কারণে টাকা তোলার দরকার হলেই নাটক নামত।

১৯৭২ সালে বঙ্গরঙ্গমঞ্চের শতবর্ষ পূর্তিতে ‘‌শিল্পী সংসদ’‌ পর পর তিন সন্ধ্যায় নামাল তিনটি নাটক। বিশ্বরূপা মঞ্চে। তিনটিরই পরিচালক উত্তমকুমার‘‌চারণকবি মুকুন্দ দাস’‌, ‘‌সাজাহান’‌ (‌এতে নাম ভূমিকায় ঠাকুরদা মিত্র, ঔরঙ্গজেব মহেন্দ্র গুপ্ত আর দিলদারে বিকাশ রায়)‌, ‘‌চরিত্রহীন’‌। তিনটিই ‘‌ক্লাসিক’‌ নাটক। এর কোনওটাতে অভিনয় করেননি অবশ্য উত্তম। তবে সে খেদ মিটল পরের বার। ‘‌আলিবাবা’‌ নাটকে। এ নাটকে জয়শ্রী সেন  মর্জিনা। আর দু’‌দৃশ্যের মজার চরিত্র বাবা মুস্তাফা স্বয়ং উত্তমকুমার। রবীন্দ্রসদনে শো হল। নাটককে ভালবেসে রোমান্সের রাজা তখন মঞ্চে কুৎসিতদর্শন এক বৃদ্ধ মুচি!‌ চমকে গিয়েছিল দর্শক।

তথ্যসূত্র


  1. আজকাল পত্রিকা, ২১শে জুলাই ২০১৮ সাল।
  2. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে জুলাই ২০১৯ সাল।
  3. ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় উত্তমকুমার স্মরণে শ্রী সত্যজিৎ রায়ের লিখিত নিবন্ধ।
  4. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে জুলাই ২০১৭ সাল।
  5. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই জুন ২০১৭ সাল।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

বাদল সরকারের জীবনী দেখুন

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন