ইউএসজি

আলট্রাসোনোগ্রাফি ।। ইউএসজি ।। USG

আল্ট্রাসোনোগ্রাফি  বা ইউএসজি একটি মেডিক্যাল ইমেজিং পদ্ধতি যেখানে অত্যন্ত উচ্চ কম্পাঙ্কবিশিষ্ট শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে থাকা বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও টিস্যুর হাই রেজল্যুশন ছবি তোলা হয়। এটি অস্ত্রোপচারহীন এবং ব্যথাহীন একটি পরীক্ষা পদ্ধতি যার সাহায্যে শরীরের ভেতরে থাকা অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলির সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। রেডিওলজি বিভাগের একটি অন্যতম অংশ হল এই আল্ট্রাসোনোগ্রাফি।

আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হল শরীর মধ্যস্থ অঙ্গগুলির বিশদ ছবি তুলতে এটিতে এক্স -রে ও সিটি স্ক্যানের মত আয়নিত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করা হয় না। পরিবর্তে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে এখানে ছবি তোলা হয়ে থাকে। ফলত রোগীদের বিশেষ করে গর্ভবতী নারী এবং শিশুদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং সুরক্ষিত মাধ্যম। 

ইউএসজি প্রযুক্তির ইতিহাস: রোগ নির্ণয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহার শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, যখন বিজ্ঞানীরা প্রথমবার ইমেজিংয়ের মাধ্যম হিসেবে শব্দ তরঙ্গের ব্যবহার শুরু করেন। ১৯১৭ সালে ফরাসি পদার্থবিদ পল ল্যাঙ্গেভিন আল্ট্রাসনিক ট্রান্সডুসার আবিষ্কার করেন যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জলের নিচে কোন বস্তুর অবস্থান ও দিক নির্ণয় করতে ব্যবহার করা হত। এই পদ্ধতি সোনার (SONAR – sound navigation and ranging) ডিটেকশন পদ্ধতি নামে পরিচিত।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

পঞ্চাশের দশক থেকে গবেষকরা মেডিকেল ইমেজিংয়ে আল্ট্রাসনিক তরঙ্গের ব্যবহার সম্ভব কিনা সে বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৪২ সালে অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট কার্ল দুসিক মস্তিষ্কের টিউমার চিহ্নিতকরণের জন্য আল্ট্রাসনিক তরঙ্গ ব্যবহারের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তিনি মানব মস্তিষ্কের ছবি তুলতে মাথার খুলির মধ্যে দিয়ে শব্দ তরঙ্গ প্রেরণ করেন।  এই পদ্ধতিটির নাম দেন তিনি ‘ইকোগ্রাফি’।

ষাটের দশক থেকে গবেষকরা কীভাবে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের এই প্রক্রিয়াকে আরও উন্নতমানের করা যায় সে বিষয়ে জোরদার গবেষণা করতে শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ইয়ান ডোনাল্ড ও তাঁর সহকর্মীরা গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের জন্য শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের একটি পন্থা আবিষ্কার করেন। তাঁরা এই প্রক্রিয়াটির নাম দেন ‘আল্ট্রাসনিক ফীটাল সেফালোমেট্রি’ (ultrasonic fetal cephalometry)। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা গর্ভস্থ ভ্রূণের মাথার আকার পরিমাপ করতে সক্ষম হন।

পরবর্তী বছরগুলিতে ইউএসজি প্রযুক্তি ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে। সত্তরের দশকে গবেষকরা রিয়েল-টাইম ইউএসজি প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন যার ফলে চিকিৎসকরা সরাসরি দেহ অভ্যন্তরের ছবি দেখতে সক্ষম হন। এই প্রযুক্তিটি প্রসূতিবিদ্যা এবং স্ত্রীরোগবিদ্যায় প্রথম ব্যবহার করা হয়। এই রিয়েল-টাইম ইউএসজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিকিৎসকরা গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশে নজর রাখতে পারতেন যেমন, তেমনই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি ও ডিম্বাশয়ের সিস্টের অবস্থান ও অবস্থা নির্ণয় করতে পারতেন।  

আশি এবং নব্বইয়ের দশকে রঙিন ডপলার এবং পাওয়ার ডপলার প্রযুক্তির আগমন  ইউএসজি প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করে তোলে। এই ডপলার প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসকরা এখন থেকে রিয়েল-টাইমে শরীরের ভেতর রক্ত ​​প্রবাহ দেখার সুযোগ পান যা ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস এবং পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজিসের মত অবস্থা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে।

ইউএসজি পদ্ধতির ব্যবহার: অবস্টেট্রিক্স, গাইনোলজি, কার্ডিওলজি এবং ইউরোলজি সহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ব্যবহার হয়ে থাকে।  এছাড়াও লিভার, কিডনি এবং থাইরয়েডের সমস্যা নির্ধারণে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।   

অবস্টেট্রিক্স বা প্রসূতিবিদ্যায় আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ভ্রূণের বিকাশ পর্যবেক্ষণ করতে এবং কোনও অস্বাভাবিকতা পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এটি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। গাইনোলজি বা স্ত্রীরোগবিদ্যায় আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ডিম্বাশয়ের সিস্ট এবং জরায়ু ফাইব্রয়েডের অবস্থা নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়।

আল্ট্রাসোনোগ্রাফি সাধারণত কার্ডিওলজিতে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে এবং হৃদরোগ আছে কিনা তা চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়। এই পরীক্ষার সাহায্যে হৃদপিণ্ডের চেম্বার, ভালভ এবং রক্তনালীর বিশদ চিত্র তোলা যেতে পারে। 

ইউরোলজির ক্ষেত্রে ইউএসজি কিডনিতে পাথরের অবস্থান ও পরিমাণ এবং মূত্রনালীর সংক্রমণের পরিমাণ নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়। এটি মূত্রতন্ত্রের কিডনি, মূত্রাশয় এবং অন্যান্য অংশের বিস্তারিত চিত্র প্রদান করতে পারে।

ডায়াগনস্টিক ব্যবহার ছাড়াও, এই পদ্ধতি ন্যূনতম অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যেমন বায়োপ্সি, নিডল অ্যাসপিরেশন  প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।  এই ইউএসজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অস্ত্রোপচারটি সঠিক ভাবে হচ্ছে কিনা সেটি লক্ষ্য করা যায়। 

ইউএসজি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা: আল্ট্রাসোনোগ্রাফির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যার মধ্যে একটি হল এই প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রক -নির্ভর। অর্থাৎ ইউএসজি’র মাধ্যমে তোলা ছবিগুলির গুণমান অনেকাংশে নিয়ন্ত্রকের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার জন্য অনেক চিকিৎসাকেন্দ্র ইউএসজি নিয়ন্ত্রকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করে থাকে।

ইউএসজি ব্যবহারের আরেকটি সমস্যা হল এই প্রক্রিয়ায় শরীরের নির্দিষ্ট কাঠামোর ছবি তোলা বেশ অসুবিধেজনক হয়ে পড়ে, যেমন হাড়ের পিছনে থাকা অংশ বা বাতাসে পূর্ণ অঙ্গ। এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য ইমেজিং প্রক্রিয়া যেমন সিটি স্ক্যান বা এমআরআই ব্যবহার করা যেতে পারে।

বর্তমানে  ইউএসজি একটি বহুল ব্যবহৃত মেডিকেল ইমেজিং প্রক্রিয়া  যা রেডিওলজির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিনা অস্ত্রোপচারে নিরাপদভাবে রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা আল্ট্রাসোনোগ্রাফিকে রেডিওলজি বিভাগের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

আপনার মতামত জানান