প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরী করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যেই একটি হল বিশ্ব আলঝাইমার্স দিবস (World Alzheimer’s Day)
প্রতিবছর ২১ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বজুড়ে ডিমেনশিয়া বা আলঝাইমার্স রোগ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বিশ্ব আলঝাইমার্স দিবস পালিত হয়। কোথাও কোথাও এই রোগের গুরুত্ব অনুসারে সারা মাসব্যাপী আলঝাইমার্স মাস পালন করা হয়ে থাকে।
১৯৮৪ সালে ‘আন্তর্জাতিক আলঝাইমার ব্যাধি’ নামে একটি সংস্থা স্হাপিত হয় যারা সারা পৃথিবীতে আলঝাইমার রোগীদের সাহায্য করার জন্য তৈরী হয়েছে। এই সংস্থার দশম প্রতিষ্ঠা দিবসে ১৯৯৪ সালে ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রথম বিশ্ব আলঝাইমার্স দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আলঝাইমার্স একটি স্নায়বিক অবক্ষয়মূলক রোগ যা সাধারণত বৃদ্ধ বয়সেই দেখা যায় বেশি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে পঁয়ষট্টি বছরের বেশি ব্যক্তিরাই বেশি এই রোগের শিকার। প্রথমদিকে স্মৃতিভ্রংশ হওয়া এই রোগের প্রথম লক্ষণ। এরপর ধীরে ধীরে রোগের প্রকোপ বাড়লে রোগীর মধ্যে অস্হিরতা বাড়ে ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে। এর সাথে রোগীর শারীরিক দুর্বলতা দেখা যায় এবং শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকর্মগুলিও ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে। খাওয়ার প্রতি অনিচ্ছা এবং রাগ বৃদ্ধি পায়। প্রথমদিকে দৈনন্দিন কাজগুলি মনে থাকে না। পরবর্তীতে রোগের প্রকোপে নিজের নাম ও ঠিকানাও মনে রাখতে অক্ষম হয়ে পড়ে রোগী। এইভাবে একসময় রোগীর মৃত্যু হয়।
মনোচিকিৎসক আলোইস আলঝাইমার ১৯০১ সালে সর্বপ্রথম এই রোগটিকে চিহ্নিত করেন বলে তাঁর নামানুসারেই এই রোগের নামকরণ করা হয়। এই রোগে আক্রান্ত তাঁর প্রথম রোগী ছিলেন অগাষ্টি ডেটর। গবেষণায় জানা গেছে এই রোগটির একশোটিরও বেশী ধরন হয়। ২০০৬ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে এই রোগে ২ কোটি ৬৬ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৮৫ জনে একজন এই রোগের শিকার হবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে সারা পৃথিবীতে প্রতি ৬৮ সেকেন্ডে একজন এই রোগের শিকার হন। এই রোগের কোন স্হায়ী প্রতিকার নেই। আলঝাইমার্স রোগের কারণ এখনও সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবুও গবেষণার তথ্যানুসারে এই রোগটিকে মস্তিষ্কের প্লাক ও টেঙ্গুল যা হাইড্রোফসফোরাইলেটেড টাউ প্রোটিনের সমষ্টিগত সংশ্লিষ্ট রোগ। এই রোগের সম্ভাব্য কারণগুলি হল —–
১) আমাদের মাথার কর্টেক্সে ও সামনের অংশে বড় পিরামিডের মত অ্যাসিটাইলকোলিন নিউরণ থাকে যা বুদ্ধি বিকাশে সাহায্য করে। এই অ্যাসিটাইলকোলিন নিউরনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী অণুনালিকা থাকে। আলঝাইমার্স রোগে টাউ প্রোটিনের গাঠনিক পরিবর্তনের কারণে এই অ্যাসিটাইকোলিন নিউরনের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। সেই কারণে মানুষের বুদ্ধি ও বিচারশক্তি হ্রাস পায়।
২) আমাদের স্নায়ু রক্ষা করে ‘অ্যামাইলয়েড প্রিকারস’ নামে একটি প্রোটিন। অতিরিক্ত স্নায়বিক চাপের কারণে এবং কোন কারণে স্নায়ুতে চোট বা আঘাত লাগলে ‘অ্যামাইলড প্রিকারস’ ভেঙ্গে গিয়ে অ্যামাইলড বিটা নামক এক ধরনের প্রোটিন উৎপাদিত করে যা মস্তিষ্কের রক্তকণিকার মধ্যে দলা পাকিয়ে অ্যামাইলড প্লাক গঠন করে। এই অ্যামাইলড প্লাকই মস্তিকের স্নায়ুকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে রোগী ধীরে ধীরে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করে।
এখনও অবধি এই রোগের কোন প্রতিকার করা সম্ভব হয়নি। আক্রান্ত রোগীর উপযুক্ত যত্ন ও সাহচর্য বিশেষ প্রয়োজন। এই রোগ থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, যোগাসন, পুষ্টিকর খাদ্য যেমন বাদাম, আখরোট নিয়মিত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডে ‘ডিমেনশিয়া কানেক্ট’ নামে একটি সংস্হা কাজ করে যারা ঐ অঞ্চলের ডিমেনশিয়া রোগীদের অনলাইন পরিসেবা দিয়ে থাকে। এতে স্হানীয় তথ্য, সহায়তা, পরিষেবা প্রদানকারী ৪,০০০ সংস্হার নাম নথিভুক্ত করা আছে। ঐ নিদির্ষ্ট অঞ্চলের রোগীরা নিজের পোষ্টকার্ড বা জায়গার নাম অর্ন্তভুক্ত করলে ঐ অঞ্চলের কোন দাতব্য বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে ডিমেনশিয়া কানেক্ট’ পরিষেবা প্রদান করে থাকে।
আগে পৃথিবীর মধ্যে যে সমস্ত ঐতিহাসিক উঁচু সৌধ বা মিনার রয়েছে সেগুলিকে বেগুনী রঙের আলো দিয়ে আলোকিত করা হত বিশ্ব আলঝাইমার দিবসে। বর্তমানে বেগুনী রঙের ব্রেসলেট বাঁধা হয় হাতে। বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব আলঝাইমার্স দিবস উদযাপনের জন্য সভা, সমিতির আয়োজন করে থাকে সারা পৃথিবী জুড়েই। এই রোগ সম্বন্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একসঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে হাঁটা হয় বিভিন্ন জায়গায়। প্রবীণদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নে আরও বেশী সচেতন হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করা হয়।
প্রতি বছরই আলঝাইমার দিবস পালনে আন্তর্জাতিক আলঝাইমার ব্যাধি নামের সংস্থাটি কিছু বিশেষ থিম রাখে। ২০১২ সালের প্রথম থিম ছিল ‘ডিমেনশিয়া : একসাথে বাঁচা’ (Dementia : Living Together) ২০১৫ সালের থিম ছিল ‘আমাকে মনে রেখো’ (Remember me). ২০১৬ সালের থিমও ছিল ঐ একই ‘আমাকে মনে রেখো’ (Remember me)। ২০১৭ সালেও ছিল এই একই থিম। ২০১৮ সালের থিম ছিল ‘প্রতি তিন সেকেন্ডে’ (Every 3 seconds)। ২০১৯ সালের থিম ছিল ‘ডিমনেশিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হোক’ (Let’s talk about dementia)। ২০২০ সালের থিম ছিল ২০১৯ সালের মত একই ‘ডিমেনশিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হোক’ (Let’s talk about dementia)। ২০২১ সালের থিমও ‘ডিমেনশিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হোক’ (Let’s talk about dementia) ।