সববাংলায়

নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলা

ভারতের ইতিহাসে প্রেম-পরিণয় ঘটিত হত্যাকাণ্ড সংখ্যায় কম নয়। তার বেশিরভাগ ঘটনাই জনমানসে সেভাবে দাগ কেটে যায়নি, মামলাও বেশি দূর গড়ায়নি, কিন্তু অনেকটা একই রকম ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক ও একটি খুনের মামলা ১৯৫৯ সালের ভারতকে সচকিত করে তুলেছিল। ভারতীয় বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন গণমাধ্যমের জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল ১৯৫৯ সালের বিখ্যাত নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলা। এটিই ছিল ভারতের জুরি ট্রায়াল হিসেবে শুনানির শেষ মামলা। এর পর থেকে সরকার বিচার ব্যবস্থায় জুরি পদ্ধতি বাতিল করে। ১৯৫৯ সালের সময়পর্বে ভারতবাসী প্রথম নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলাকে কেন্দ্র করে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের প্রত্যক্ষ সংঘাত পর্যবেক্ষণ করেছে। জনমানসের উত্তেজিত অবস্থাকে সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর হস্তক্ষেপকে বাধ্য করে তুলেছিল এই মামলা। ধনী ও প্রভাবশালীরা কীভাবে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ন্যায়বিচারকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল এই মামলায়।

১৯৫৯ সালে বম্বের উচ্চ আদালতে শুরু হয়েছিল নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলা। মামলায় প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন ভারতীয় নৌ-সেনার একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার কাওয়াস মানেকশ নানাবতী ওরফে কে এম নানাবতী। সেই সময়কার বিখ্যাত সিন্ধ্রি ব্যবসায়ী প্রেম আহুজাকে খুন করার অপরাধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০০ ধারা অনুযায়ী নানাবতীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বম্বে সেশন কোর্ট ৩০২ ধারা অনুযায়ী তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আবার বিচার শুরু হয়ে এবং বিচারের রায় অনুযায়ী তাঁকে তিন বছর কারাবাসও করতে হয়েছিল।

ভারতীয় নৌ-অফিসার কে এম নানাবতী তাঁর স্ত্রী সিলভিয়া ও এক পুত্র তনাজ্‌কে নিয়ে বম্বেতে বাস করতেন। ঐ একই শহরে জনৈক ব্যবসায়ী প্রেম ভগবান আহুজা তাঁর বোনের সঙ্গে একটি বাড়িতে থাকতেন। ১৯৫৬ সালে অগ্নিক নামে এক ব্যক্তির সৌজন্যে প্রেম আহুজা ও নানাবতীর মধ্যে আলাপ হয় প্রথম। আহুজার সঙ্গে নানাবতীর স্ত্রী ও সন্তানেরও পরিচয় ঘটে। অফিসিয়াল ডিউটিতে দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে থাকার সময় নানাবতীর স্ত্রী সিলভিয়ার সঙ্গে প্রেম আহুজার একটি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ক্রমেই নানাবতীর অনুপস্থিতিতে সেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। জাহাজের কাজ থেকে ফিরে নানাবতী স্ত্রীর সঙ্গে একান্ত মুহূর্ত কাটানোর সময় লক্ষ্য করেন যে তাঁর স্ত্রী সিলভিয়া আর আগের মত সংবেদনশীল নেই, বরং নানাবতীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমেছে। ১৯৫৯ সালের ২৭ এপ্রিল নানাবতী তাঁর স্ত্রীকে সরাসরি প্রশ্ন করেন যে তিনি সত্যিই তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত কিনা। সেই সময় সিলভিয়া এই কথায় অসম্মতি জানান এবং সেই দিনেই তিনি প্রেম আহুজার সঙ্গে তাঁর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক স্বীকার করেন। এই কথায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নানাবতী তাঁর জাহাজে ফিরে যান গুলিভরা একটি পিস্তল সংগ্রহ করার জন্য এবং সেই পিস্তল নিয়ে সোজা তিনি উপস্থিত হন প্রেম আহুজার অফিসে। সেখানে আহুজাকে না পেয়ে তিনি গাড়ি চালিয়ে পৌঁছান আহুজার বাড়িতে এবং সেখানেই পরপর তিনটি গুলি করে নানাবতী প্রেম আহুজাকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর নানাবতী নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দেন, কিন্তু বয়ানে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। ২৭ এপ্রিল রাত্রেই মেট্রো সিনেমা হলে টম থাম্ব নামের একটি চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়ার কথা ছিল সিলভিয়া আর তাঁর সন্তানদের, নানাবতী তাঁকে বারবার অনুরোধ করে না যাওয়ার কথা বললেও সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে সিলভিয়া সরাসরি সিনেমা দেখার বকলমে প্রেম আহুজার সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। আদালতে নানাবতীর দেওয়া বয়ান থেকে জানতে পারা যায় যে, সেই দিন আহুজার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে নানাবতী প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে সে সিলভিয়াকে বিবাহ করতে চায় কিনা। আহুজা তখন অসম্মতি প্রকাশ করেন এবং সিলভিয়াকে ব্যবহার করে আসলে তিনি যে নানাবতীর কাছে নিজের সম্পদের ক্ষমতা জাহির করতে চেয়েছিলেন তা স্পষ্ট জানান। এই উত্তরেই ক্ষুব্ধ হয়ে নানাবতী পরপর তিনটি গুলিতে বিদ্ধ করেন আহুজাকে। তারপর তিনি নিজেই ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। নানাবতীর বয়ান থেকে জানতে পারা যায় যে, জাহাজের সংগ্রহশালা থেকে পিস্তলে ছয়টি গুলি ভরেই নিয়ে এসেছিলেন তিনি, আহুজার ঘরে ঢুকে তাঁকে ঐ প্রশ্ন করার পরে উভয়ের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি চলে কারণ আহুজা নিজের রিভলবার বের করে গুলি করতে চেয়েছিলেন নানাবতীকে। এর প্রতিক্রিয়াতেই গুলি চালিয়েছিলেন নানাবতী। অন্যদিকে বিপক্ষীয় উকিল তথা সাক্ষীর বয়ানে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল যে তোয়ালে জড়িয়ে আহুজা সেই সময় স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তা ধ্বস্তাধ্বস্তির পরেও একই রকম অবস্থায় থেকে গেল কীভাবে! তাছাড়া বিপক্ষীয় উকিল এই হত্যার পিছনে নানাবতীর শীতল মস্তিষ্কের পরিকল্পনা ছিল বলে দাবি করেছিলেন।

আরও পড়ুন:  ইতিহাসে মানুষের নরখাদক হয়ে ওঠার কিছু ঘটনা

এই মামলায় মূলত আদালতের সামনে চারটি বিষয় উঠে এসেছিল। প্রথমত অপরাধ দণ্ডবিধির ৩০৭ নং ধারা অনুসারে সেশন আদালতে এই মামলাটিকে পাঠানোর জন্য উচ্চ আদালতের কাছে যথাযোগ্য এক্তিয়ারের অভাব ছিল। তাছাড়া এই দণ্ডবিধির সাহায্যে ভুল নির্দেশনার ভিত্তিতে উচ্চ আদালত চাইলে জুরির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে। ফলে আদালতের কাছে প্রমাণ করার কাজ ছিল যে আবেগের বশে এই খুন করেছেন নানাবতী নাকি এটা একটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বম্বে সেশন আদালতে প্রথমে জুরির রায়ে নানাবতীকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করা হয়, মোট ৮ জন জুরি এই মতের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও সেই সময়কার সংবাদমাধ্যম ও জনগণের চাপে পড়ে জুরির রায় পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে এই মর্মে সেশন বিচারপতি রতিলাল ভাইচাঁদ মেহেতা জুরির রায় অস্বীকার করে এই মামলাকে বম্বে উচ্চ আদালতে পুনর্বিবেচনার জন্য সাব্যস্ত করেন। বম্বে উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলার রায় শুনানি করে প্রথমে। সেই ডিভিশন বেঞ্চের সদস্য ছিলেন শেলাত, নায়েক এবং জে জে। শেলাত ও নায়েক উভয়েই সম্মত হন যে অভিযুক্ত নানাবতী ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ নং ধারা অনুযায়ী প্রেম আহুজাকে খুনের জন্য দোষী এবং তাঁর বাকী জীবনের জন্য কারাবাস করা উচিত। নানাবতীকে বম্বে আদালত পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রেম আহুজার হত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় এবং ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্টও নানাবতীকে দোষী সাব্যস্ত করে।

নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলা ভারতের ইতিহাসে এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যেখানে অভিযুক্ত নানাবতীকে ঘিরে জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থনকে প্রচারের কাজে লাগিয়েছিল একটি সংবাদপত্র। এই মামলা সমগ্র দেশকেই আলোড়িত করেছিল। আর কে করঞ্জিয়ার মালিকানাধীন সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ‘ব্লিটজ’ এই মামলার বিষয়ে পরপর কভার-স্টোরি প্রকাশ করতে থাকে যাতে একপাক্ষিকভাবে নানাবতীর প্রতি সমর্থন সুপ্ত ছিল। আসলে আর কে করঞ্জিয়া নিজেও একজন পার্সি সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় নিজের সম্প্রদায়ের নানাবতীকে বাঁচানোর একটা অলিখিত দায় অনুভব করেছিলেন তিনি। এই পত্রিকাতে আহুজাকে একজন চরিত্রহীন হিসেবে অঙ্কন করে তাঁর বিপরীতে নানাবতীকে একজন সচ্চরিত্র মূল্যবোধ সম্পন্ন নৌ-অফিসার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। মামলা চলাকালীন এই পত্রিকার প্রতি কপি স্বাভাবিক দামের থেকে ২৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হত এবং এর পাশাপাশি ‘আহুজা-তোয়ালে’ আর খেলনা নানাবতী পিস্তল বিক্রি হতে থাকে। বম্বেতে পার্সিদের নিয়মিত সমাবেশ হত এই মামলা চলার সময় এবং প্রাথমিভাবে পার্সি জনপ্রিয় উকিল কার্ল জামশেদ খাণ্ডালাওয়ালা নানাবতীর হয়ে আদালতে সওয়াল-জবাব করতে রাজি হন। নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলায় নানাবতীর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে এবং নানাবতীকে আদালত ক্ষমা না করা পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ এই বিষয়টিকে জনমানসে জিইয়ে রাখতে ‘ব্লিটজ’ পত্রিকা প্রভূত সহায়তা করেছিল। তিন বছর কারাবাসের পরে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত নানাবতীকে ক্ষমা করেন এবং তারপরে নানাবতী তাঁর স্ত্রী সিলভিয়া ও তিন সন্তানকে নিয়ে চলে যান কানাডায়। অণ্টারিও বার্লিংটনেই জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন কাওয়াস মানেকশ নানাবতী।             

আরও পড়ুন:  কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন

তথ্যসূত্র


  1. https://indiankanoon.org/
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://blog.ipleaders.in/
  4. https://www.news18.com/
  5. https://theprint.in/

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন