মহাভারতের উদ্যোগপর্বে দেখতে পাওয়া যায় নারদমুনি দুর্যোধনকে অতিরিক্ত আগ্রহী বা জেদি হওয়া কেন ভালো নয় তা বোঝাতে গালবের কাহিনী বলছিলেন। গালবের কাহিনীতেই উঠে আসে যযাতির কন্যা মাধবীর কথা। গুরুর ঋণভারে যখন গালব যযাতির কাছে এসে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন, তখন যযাতি তাঁকে জানান যে তাঁর কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই। তার বদলে যযাতির কন্যা মাধবীকে যযাতি গালবের হাতে দান করেন যদি কোনো রাজা সেই কন্যার বিনিময়ে গালবকে অর্থসাহায্য করেন। গালব মাধবীকে বিভিন্ন রাজার কাছে নিয়ে যান এবং তাঁদের সাহায্যে অবশেষে ঋণমুক্ত হয়েছিলেন।
গালব ছিলেন বিশ্বামিত্রের শিষ্য। একদিন বিশ্বামিত্রের কাছে স্বয়ং ধর্ম, বশিষ্ঠের রূপ ধরে আসেন। তারপর তাঁর কাছে খাওয়া দাওয়া করে যাবার সময় তাঁকে বলে যান যতদিন তিনি ফিরে না আসেন ততদিন যেন বিশ্বামিত্র তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন। সেই কথা অনুযায়ী বিশ্বামিত্র প্রায় না খেয়ে কঠিনভাবে জীবন যাপন করছিলেন। সেই সময়ে তার শিষ্য গালব তাঁর ক্রমাগত পরিচর্যা করে তাঁকে সুস্থ রাখেন। এক বছর পরে ধর্ম ফিরে এসে জানান তিনি বিশ্বামিত্রের ওপর খুশি। আর বিশ্বামিত্র গালবকে জানান তিনিও গালবের ওপর বেজায় খুশি। তিনি আরও জানান এরপর গালব যেখানে খুশি যেতে পারেন, গুরুকুলে গালবের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু গালব গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলেন। বিশ্বামিত্র তাঁকে বোঝালেন যে এর কোনো দরকার নেই। কিন্তু গালব নাছোড়বান্দা, তিনি গুরুদক্ষিণা দেবেনই। তখন বিশ্বামিত্র বিরক্ত হয়ে তাঁকে বলেন এতই যখন তিনি গুরুদক্ষিণা দিতে চান তাহলে তিনি যেন আটশোখানি ঘোড়া এনে গুরুকে দেন। তবে যেমন তেমন ঘোড়া নয়, সেই ঘোড়ার একদিকের কান হবে কালো রঙের এবং গায়ের রং হতে হবে চাঁদের মত শুভ্র। গুরুর এই দাবী শুনে গালবের মুখ শুকিয়ে গেল। যতই গুরুদক্ষিণা দেবে দেবে করুক, এই ঘোড়া সে পাবে কোথায়!
অগত্যা গালব বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণুর বাহন গরুড় তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর দুজনে আলোচনা করে তাঁরা রাজা যযাতির কাছে সাহায্যের জন্য এলেন। রাজা যযাতি তখন জানালেন তাঁর কাছে সেই মুহুরতে ওইরকম ঘোড়া বা অত পয়সা নেই। তবে তাঁর এক কন্যা আছে, যার নাম মাধবী। যদি তাঁকে গালব কোনো রাজাকে দিয়ে সেই রাজার থেকে ঘোড়া বা পয়সা পায়, তাহলে যযাতি তাঁর কন্যাকে দিতে পারে।
গালব মাধবীকে নিয়ে প্রথমেই গেলেন ইক্ষবাকু বংশীয় রাজা হর্যশ্ব-এর কাছে। সেই রাজার কোনো পুত্র ছিল না। তাই পুত্র পাবার আশায় এবং সর্বোপরি মাধবীর রূপে মোহিত হয়ে রাজা মাধবীকে গালবের কাছে প্রার্থনা করলেন। কিন্তু তাঁর কাছে মাত্র দুশোটি ঐরকম এককান কালো আর চাঁদের মত সাদা ঘোড়া ছিল। রাজা তখন দুশোটি ঘোড়ার পরিবর্তে মাধবীকে বিয়ে করার অনুরোধ করলেন। তিনি মাধবীকে অন্তত কিছুদিনের জন্য তাঁর কাছে রাখতে বললেন যাতে তাঁর সাথে সঙ্গমে তিনি মাধবীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে পারেন। গালব কি করবে ভাবতে ভাবতে মাধবীই তাঁকে বললেন যে তাঁর একটা বর আছে যে সন্তান প্রসবের পরেও তিনি তাঁর কুমারীত্ব ফিরে পাবেন। তখন গালব তাকে হর্যশ্ব-এর কাছে রেখে কিছুদিন রেখে গেলেন। এরপর রাজার ঔরসে মাধবীর গর্ভে বসুমনা নামের এক পুত্র জন্ম নিলেন। তখন গালব এসে রাজার থেকে দুশো ঘোড়া এবং মাধবীকে নিয়ে চললেন অন্য রাজার কাছে। এরপর তারা গেলেন কাশীপতি দিবোদাস রাজার কাছে। তাঁর কাছেও মাত্র দুশোটি ঘোড়াই ছিল। তিনিও কিছুদিনের জন্য মাধবীকে বিয়ে করলেন। তাঁর ঔরসে মাধবীর গর্ভে জন্মাল পুরাণ বিখ্যাত প্রতর্দন। এরপর তারা দুজন ভোজরাজ্যে এলেন। রাজা উশীনরের কাছেও ছিল মাত্র দুশোটি ঘোড়া। তিনিও মাধবীর গর্ভে ভবিষ্যৎ রাজা শিবিকে জন্ম দিলেন।
কিন্তু এরপর আর কোনো রাজার কাছে আর ঘোড়া পাওয়া গেল না। গুরুকে দেওয়ার জন্য গালবের দরকার আটশো ঘোড়া। কিন্তু তিনি মাত্র ছশোটি ঘোড়াই সংগ্রহ করতে পেরেছেন। আর উপায় না দেখে গালব সেই ছশোটি ঘোড়া নিয়েই বিশ্বামিত্রের কাছে হাজির হলেন। বাকি দুশো ঘোড়ার পরিবর্তে তিনি মাধবীকে দিতে চাইলেন। তখন বিশ্বামিত্র কিঞ্চিৎ রেগে শিষ্যকে বললেন আগেই তো মাধবীকে নিয়ে তাঁর কাছে আসতে পারতেন গালব। তাহলে মাধবীর গর্ভে বিশ্বামিত্র নিজেই চারটি পুত্রের জন্ম দিতে পারতেন। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী এখন তো তিনি মাত্র একটি পুত্রই পেতে পারেন। সে যাই হোক, মাধবীর গর্ভে বিশ্বামিত্র অষ্টক নামে একটি পুত্রের জন্ম দিলেন। তারপরে গালব মাধবীকে যযাতির কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন।
যযাতি মেয়ের স্বয়ংবরের ব্যবস্থা করলেন। যযাতিপুত্র যদু ও পুরু বোনকে নিয়ে গঙ্গা যমুনা সংলগ্ন আশ্রমে গেলেন। অনেক রাজরা এলেন স্বয়ংবরে, গন্ধর্বেরা এলেন। কিন্তু মাধবী কাউকে বিয়ে না করে বনবাস স্থির করলেন। সবকিছু ছেড়ে তপোবনে চলে এলেন। সেখানে হরিণদের মাঝে তিনিও হরিণীর মত বিচরণ করতে লাগলেন।
বহুকাল পরে যখন যযাতি দম্ভের কারণে স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন, তখন যযাতি প্রার্থনা করলেন মর্তে যেন তিনি সাধুজনের মাঝে থাকতে পারেন। সেই অনুযায়ী তাকে স্বর্গ থেকে মর্তে নৈমিষারণ্যে পাঠানো হল যেখানে প্রতর্দন, বসুমনা, শিবি এবং অষ্টক বাজপেয় যজ্ঞ করছিলেন। তাঁদের মাঝে যযাতি এলেও তাঁরা তাঁকে চিনতে পারলেন না। সেই সময়ে মাধবী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যযাতির সাথে তাঁর নাতিদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর নাতিদের সাহায্যে আবার যযাতি স্বর্গে যেতে পারলেন।
তথ্যসূত্র
- "মহাভারত সারানুবাদ", দেবালয় লাইব্রেরী(প্রকাশক সৌরভ দে, তৃতীয় প্রকাশ) - রাজশেখর বসু, উদযোগপর্ব পৃষ্ঠা ৩০৮-৩১১
- "মহাভারতের অষ্টাদশী", আনন্দ পাবলিশার্স, চতুর্থ মুদ্রণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, অধ্যায়ঃ মাধবী পৃষ্ঠাঃ ৭৪৭-৭৭৯
- thehindu.com/society/history-and-culture/madhavis-unusual-boon/