দিল্লীর ‘আসোলা ফতেপুর বেরি’- গ্রাম যার ঘরে ঘরে বাউন্সার। কিংবা হরিয়ানার ‘সংসারপুর’ যার ঘরে ঘরে জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্তরের হকি প্লেয়ার। পশ্চিমবঙ্গেও এমনই এক গ্রাম আছে যেখানে ঘরে ঘরে জাতীয় স্তরের ভারলোত্তক (Weightlifter) পাওয়া যাবে খুঁজলে। হয়তো দেখছেন সাইকেল নিয়ে একটা মেয়ে আপনার সামনে দিয়ে গেল যে গত সপ্তাহে ‘খেলো ইন্ডিয়া’ থেকে মেয়েদের ৭৮ কেজি বিভাগে সোনা জিতেছে। টোটোয় যাচ্ছেন, আপনার উল্টোদিকের রোগা দুবলা ছেলেটি সবে টোকিও থেকে ফিরেছে ছেলেদের জুনিয়র বিভাগে দেশকে রুপো এনে দিয়ে। বিশ্বাস করুন, এমন নিপাট গোবেচারাভাবে ছেলে মেয়েগুলো আপনার সামনে দিয়ে যাতায়াত করবে যে ঘুণাক্ষরেও আপনার মনে হবে না এরা আমার আপনার যৌথ ওজনের সমান ওজন তুলে দেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরে এবং আমাদের রাজ্যকে জাতীয় স্তরে সোনা রুপো ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছে। ভালো করে দেখলে যেন মনে হবে – খানিকটা যেন লজ্জাই পেয়েছে এরকম সোনা কিংবা রুপো জিতে। গ্রামটির নাম ‘দেউলপুর‘, হাওড়া জেলার পাঁচলা ব্লকে অবস্থিত। এই গ্রামেরই ভূমিপুত্র অচিন্ত্য শিউলি (Achinta Sheuli)।
গত কয়েক বছর ধরেই ভারতীয় ভারোত্তোলন জগতে অচিন্ত্য শিউলি নামটি যথেষ্ট আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। শেষ কয়েক বছরে উল্কার বেগে অচিন্ত্যের উত্থান দেশজুড়ে তাঁকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। খেলো ইন্ডিয়া ইয়ুথ গেমসে সোনা, জুনিয়র কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা, বিশ্ব জুনিয়র ভারোত্তোলনে রুপো, কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। সোনা জেতা যেন অভ্যেসে পরিণত করে ফেলেছেন হাওড়ার দেউলপুরের অচিন্ত্য শিউলি।
খাঁটি সোনা যেমন আগুনে পুড়েই তৈরী হয়, সোনার ছেলে অচিন্ত্য শিউলি ও তেমনি দারিদ্র, জীবন সংগ্রাম ও স্বজন বিয়োগের আগুনে রোজ পুড়েছেন যত, ততই ধীরে ধীরে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন। জরির কাজ করে দিন চলে শিউলি পরিবারের। ২০১৩ সালে ভ্যানচালক বাবার আকস্মিক মৃত্যু তাঁদের জীবনে যে প্রবল দুর্যোগ নিয়ে আসে তা সামলাতে অচিন্ত্যও একসময় মায়ের সঙ্গে জরির কাজে হাত লাগাতে বাধ্য হন।
ভারোত্তোলনে তাঁর হাতেখড়ি দেউলপুরের কোচ অষ্টম দাসের কাছে। অষ্টম দাস করাতকলে কাজ করেন। চরম দারিদ্রের মধ্যেও সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় তিনি সাধারণ কার্বন থেকে হিরে কেটে বের করেন, রোগা প্যাঙলা ছেলে মেয়েগুলোকে হারকিউলিস বানিয়ে ছাড়েন। জ্যোতি মাল, শ্রাবণী দাস, সুকর্না আদক, শম্পা শেঠ দেশ বিদেশের ভারলোত্তন প্রতিযোগিতায় এর আগে ঝুড়ি ঝুড়ি সোনা রূপো এনেছে। অচিন্ত্য সেই দ্রোণাচার্যেরই একান্ত একলব্য।
অচিন্ত্যের নিত্য দিনের অভাবের সংসারে দাদা অলোক দমকলে চুক্তিভিত্তিক একটি সামান্য চাকরি করেন। কিন্তু অচিন্ত্যের সাফল্যে তাঁর দাদার অবদান অপরিসীম। রেলের অভীষ্ট চাকরির সুযোগে হেলায় ছেড়েছেন অচিন্ত্য কেবল প্র্যাকটিসের জায়গা ছোট বলে। হাওড়ায় জন্ম, বেড়ে ওঠা, ভারোলোত্তনে হাতে খড়ি হলেও বর্তমানে তিনি পুনেতে থাকেন এবং প্র্যাকটিস করেন পাতিয়ালার জাতীয় শিবিরে। হাওড়া ছেড়ে পুণেতে ছিলেন বলেই তিনি ২০২২ সালের বার্মিংহ্যাম কমনওয়েলথে যোগদান করতে পারলেন কারণ জাতীয় ভারোলোত্তন মিটে সাসপেনশন হওয়ার কারণে হাওড়ার অনেক ভারোলোত্তকই যোগদান করতে পারেননি।
মিরাবাই চানুর কোচ বিজয় শর্মার কাছে পাতিয়ালাতে ট্রেনিং নিয়েছেন অচিন্ত্য। তাঁর মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা দেখে তাঁকে ‘টপস’ (টার্গেট অলিম্পিক পোডিয়াম স্কিম) প্রকল্পেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরপর ২০১৯ সালে রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন ইয়ুথ স্পোর্টস সঙ্গে যুক্ত হন অচিন্ত্য। বাংলা থেকে ন্যূনতম সরকারি সাহায্য না পেলেও দমে যাননি তিনি। নিজের জেদে জিতে নিয়েছেন একের পর এক পদক।
সেই অচিন্ত্য শিউলি বার্মিংহ্যাম কমনওয়েলথ ২০২২ এ ভারোলোত্তনে পুরুষদের ৭৩ কেজি বিভাগে সামগ্রিক ৩১৩ কেজি ওজন তুলে সোনা জিতে প্রমাণ করে দিলেন কেবল সংসারের ওজন নয়, ১৪০ কোটি ভারতবাসীর চাওয়া পাওয়া আশা আকাঙ্খার ওজনও তিনি নিজের কাঁধে অনায়াসে তুলে নিতে পারেন।